বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

কাজল সেন

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৬


টাইগার হিল

অস্টিও আর্থারাইটিসের ব্যথায় ইদানীং বড়ই কাতর হয়ে থাকেন ভাগ্যশ্রী।  কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে অথবা কয়েক পা হাঁটলে পা’দুটো টনটন করতে থাকে। ডাক্তারবাবুও বারণ করেছেন, দশ মিনিটের বেশি কখনই দাঁড়িয়ে থাকবেন না অথবা হাঁটবেন না। বসে পড়বেন। অগত্যা ভাগ্যশ্রী ছেলে-বৌমার গাড়িতে বাইরে গেলেও পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে পারেন না। এদিক থেকে বরং তাঁর স্বামী জগন্ময়বাবু একদম ফিট আছেন। একসময়ে ময়দান কাঁপিয়ে ফুটবল খেলেছেন। হাঁটাহাঁটিতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ভাগ্যশ্রীর সঙ্গে প্রতিদিনের মর্নিংওয়াক বেশ কিছুদিন হলো মুলতুবি রাখতে হয়েছে।

ছেলে-বৌমা বেড়াতে খুব ভালোবাসে। প্রায়ই এদিক-সেদিক যায়। সঙ্গে মা-বাবাকেও জোর করে নিয়ে যেতে চায়। তবে ভাগ্যশ্রী শুধুমাত্র সেইসব জায়গায় যেতে রাজি হন, যেখানে হাঁটাহাঁটির কোনো ঝঞ্ঝাট থাকে না। এই যেমন দীঘা, পুরী বা মন্দারমনি। সৈকতে বসে বসেই সময় কেটে যায়। কিন্তু এবার ছেলে-বৌমা ঠিক করেছে, মা-বাবাকে দার্জিলিং-এ বেড়াতে নিয়ে যাবে।

দার্জিলিং! শুনেই ভাগ্যশ্রী সরাসরি জানিয়ে দিলেন, অসম্ভব! তোমরা তোমাদের বাবাকে নিয়ে যাও। আমি ঘরেই থাকব। বৌমা বোঝালো, সে কী মা! দার্জিলিং বেড়াতে না গেলে তুমি নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেবে কেমন করে? ছেলে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না মা, আমি তোমাকে আমার কাঁধে চাপিয়ে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখব। জগন্ময়বাবু বললেন, চল না, ঘুরেই আসি। দার্জিলিং তো নিজেই পাহাড়ের চূড়োয় বসে আছে। সেখানে যে কোনো জায়গা থেকে আমরা সূর্যোদয় দেখব। টাইগার হিলে আমরা নাই বা গেলাম!

ছেলে-বৌমা এর আগেও দার্জিলিং বেড়াতে এসেছে। তাই তারা জানে, গাড়িতে কোথায় কোথায় মা’কে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, আর কোথায় নয়। তবে একটু কষ্ট হয় বাবার জন্য, বাবা যে কোনো চড়াই উৎরাই অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু মা যেতে পারেন না বলে, তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। এইভাবে কোথাও বেড়াতে গিয়ে বাবা যে কত কিছু দেখতে যাননি, শুধুমাত্র মা দেখতে যেতে পারবেন না বলে! না হলে, একসময় মাঠে ময়দানে যে দুরন্ত গতিতে পায়ে বল নিয়ে ড্রিবল করতে করতে হামলে পড়তেন বিপক্ষ দলের রক্ষণভাগে, আজও অতটা না হলেও স্মার্টলি অতিক্রম করতে পারেন পার্বত্যপথ।

যেদিন শেষরাতে উঠে টাইগার হিলে যাবার বন্দোবস্ত ছিল, ভাগ্যশ্রী ছেলেকে  আগেই বলেই দিয়েছিলেন, তুই আর বৌমা যাস, আমি আর তোর বাবা  হোটেলেই থাকব। কিন্তু সেদিন কাঁচাঘুম থেকে জেগে উঠে কী যে পাগলামি চাপল ছেলে-বৌমার মাথায়, মা-বাবাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে বলল, তোমাদেরও যেতে হবে। দার্জিলিং-এ বেড়াতে এসে কেউ টাইগার হিলে সূর্যোদয় না দেখে ফিরে যেতে পারে না। আমাদের বদনাম হয়ে যাবে যে!

গাড়ি থেকে নেমে সূর্যোদয় দেখার জন্য পিক পয়েন্টে পৌঁছতে অনেকটাই খাড়া রাস্তা হাঁটতে হয়। অনেকেরই হাঁটতে কষ্ট হয়। ছেলে-বৌমা বলল, একবার চেষ্টা করেই দেখো না, যদি সম্ভব হয়! ভাগ্যশ্রী হঠাৎই এক অদম্য জেদে বললেন, চেষ্টা নয়, আমি যাব। আমি না গেলে তোর বাবারও তো যাওয়া হবে না!

  


২টি মন্তব্য: