কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৬ |
বাসা
মাঝরাতে ঘুম নেই। ধপধপে চাঁদের দিকে মুখ করে বসে আছে কার্নিশে একটা চড়াই। বোধহয় পথ ভুল করে। বাড়িটার পলেস্তারা ভেঙে পড়ছে। ধীরে ধীরে ফাটল ধরছে থামগুলোতে। কড়িবরগা আলগা হয়ে গেছে। সুশীলা দেবী এই বাড়ির বড়োবউ। চলে যেতে হবে। বাসা ছেড়ে গেছে তাকে। উপায় কী! জীর্ণ শরীর ছেড়ে নতুনে প্রবেশ। এখন ভাবনা কোন ট্রেন পাওয়া যাবে! গুছিয়ে নিতে হবে সব। সব কি আর নেওয়া যায়! খড় আর পাতার টুকরো উড়ে উড়ে ভাসছে সারা ঘরে। ঘর?
দুটো ডিম বুকের ওমে আগলে রাখাকে বলে ঘর! ভাবছে চলেই যাব। আঁচলে টান। আটকে কাঁটা গলায়। এই রাতে পথ ভিজে আছে। ‘কতদূর যেতে পারো তুমি আমাকে ছেড়ে? কতদূর?’ ‘পায়ের চিহ্ন চিনে চিনে যাব সেই পথে! গতস্য শোচনা নাস্তি’।
ট্রেন
না পেলে বাস, চলে যেতে গেলে অসময়ে, সে বড়ো অসম্মান। উড়ে যাওয়ার ডানা ভেঙে গেলে লজ্জা।
তবু বাসা চাই। চলে যাবার পর ঘর কি মনে রাখে? ঘুলঘুলির শালিখ খুঁজবে কি?
আলতা পরা পা, লাল চেলি মোড়া মেয়েটির গালে চন্দন দাগ, ফুটছে দুধ, মেয়েটি ভয় পায়, ওতেই পা ছোঁয়াতে হয়, উপছে গেলে সুখ। তপ্ত পাত্রখানি। শঙ্খ বাজে, উলুধ্বনি। মেয়েটির খিদে পায়। মা’র কথা মনে পড়ে, ছেড়ে আসা বাড়ি... সুশীলা কনে, সুশীলা মা, সুশীলা কর্ত্রী। পালক উড়ে পড়ে মাথায়।
এঘর সেঘর ধুলো পা। ভবঘুরে নিজের কাঠামোতে। পুরসভার গঙ্গা জলের কল অবিরত প্রাণ নষ্ট হয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে নয়ানজুলিতে। কী আর করতে পারি। যাবার পথে হোঁচট। এসব থাকেই।
ফাঁকা ঘরে মাঝে মাঝে শোনা যায় আষ্টেপৃষ্টে ভালোবাসার চুম্বন-শীৎকারের শব্দ। দু একটি বাসন খসে যাওয়া শোক। জলহীন-আলোহীন ইট-কাঠ সিমেন্টর ইমারত। দেওয়ালের কান আছে, চোখ আছে।
সুশীলা দেবীর পায়ে আজও আলতা। গালে চন্দন। সেই নারী একা একা হেঁটে যাচ্ছে আকাশের দিকে। দুটো ডিম মাটি ছুঁয়ে খুঁজে চলেছে শিকড়।
একটা চড়াই চেয়ে আছে চাঁদের দিকে। বাসাহারা, বিস্ময়ে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন