সমকালীন ছোটগল্প |
হল না হাতের সুখ
কাশীবিশ্বনাথ থেকে বেশ কিছু দিন হল শিশ্'রার (শিশির) গুরুদেব এসেছেন। গুরুদেব, গুরুদীক্ষা সম্প্র্তিই নিয়েছে। এই দু'একদিন হল। হঠাৎ আমাকে তলব কেন? আমি তো এসব থেকে শতহস্তেন! তবে কেন? যদিও শিশির আমার বাল্যবন্ধু তো সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই, আমরা একে অন্যের পাশাপাশি থেকেছি। বন্ধুরা যেমন থাকে। রাস্তায় মহাবীরের সঙ্গে দেখা,
--কিরে
ঠাকুর বহুৎদিন বাদ!
--এই
যে, শিশ্'রা ডাকল তাই।
--সব
ঠিকঠাক?
--হাঁ
ঠিকঠাক।
--ফির
মিলতে ঠাকুর।
মহাবীরের বরাবর এইরকম ছিপছিপে চেহারা, কিন্তু গোঁফটি দেখার মতো। ওর সঙ্গে হিন্দির মতো করে বললে বেশি খুশি হয়। বাংলার প্রকাশস্যার ওকে বলতেন, মহাবীর বাংলাভাষাটাও ভালো করে বলতে পারে না।
মহাবীর
বলে, স্যার আমি আপনা ভাষায় বলতে কশিস করি। কাহানি ঠিক ঠাক মুজওয়ানি বলতে পারি কিনা।
--আচ্ছা
বল।' তারপর শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা এমন হিন্দিফিল্মি কায়দায় মুখস্থ(মুজওয়ানি)
ঝাড়লো, থামতেই প্রকাশস্যার দম ছেড়ে বাঁচলেন। আমাদের স্কুল জীবনের বন্ধু মহাবীর। এককথায়
মহাবিচ্ছু ছিল। আমরা একটু তোয়াজ করেই চলতাম। ভয়ে ভক্তি। আমার অবশ্য একটু আলাদা ব্যাপার।
ঐ পাড়ায় আমার ভিক্ষে-মা থাকেন। তাই আমি আবার
ঠাকুর ঘরের ছেলে কিনা। ছোলা বাদাম জিলিপি খেতে
যেতুম জিতাষ্টমির সময়।
আমার
ভিক্ষেদাদাকে মহাবীর ভীষণ ভয় করতো। তাই সামন্য ইজ্জৎ মানসন্মান এই আরকি! শিশ্'রার
গুরু দর্শন গলির মুখে দুটি দরজা। একটি সোজা উঠোন রান্নাঘর হয়ে ঘরে প্রবেশ করতে হয়, অন্যটি
বৈঠকখানা। উঠোন হয়ে সাধারণত ঘরের লোকেরা যাতায়াত
করে। আমার এ্যালাউ আছে। শিশির আমার বাল্যবন্ধু। সামনে দিদির সঙ্গে দেখা।
--ঘদ্দিকে
পেরাঞ বোস, শিশ্'রা আসছে।'
আমি
গুডবয় মাফিক সন্তর্পনে ঘদ্দিকে দিকে পেরাঞ একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। শিশ্'রা ন্যাতা হাতে একবার উঁকি দিয়ে গেল।
ধুতি গলবস্ত্র করে। শিশ্'রা বেশ লম্বা, ছয়ের
কাছাকাছি, এখনো হিপ্পিচুল বচ্চনকাট্ জুলফি।
ভোলেবাবার
ভক্ত। শ্রাবণের ধারার মতো।
--গা'টোই
কাঁটা দিছে দ্যাখ দ্যাখ, রুয়াঁ গোলান খাঁড়া হঁঞে গেলো।
--আমার
হয় নাই রে!
--মনে
ভক্তি না থাকলে কী করে হবে? তাই হয় নাই।
শিশ্'রা এমনই। বৈঠকখানা ঘরে পোঁছা মেরে এলো। গরমকাল সন্ধ্যেবেলা শিশিরের স্ত্রী সন্ধ্যেবাতি দেওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনিও একবস্ত্রে গলবস্ত্রে। এরকমটা যে আগে দেখিনি তা নয়। ম্যাডম চললেন আগে গুরুজীর শৃঙ্গার করতে, স্নো পাউডার এসেন্স অগুরু। হাতপাখা, গুরু যেন ঘেমে না যান। এ কে রে! কে? যার জন্য এত দক্ষযজ্ঞ!
--চলে
যাবেন নাই কিন্তুক?
--না
না, আমি এখনই যাচ্ছি না।
শিশ্'রা
এসে বসলো, বুঝলি, গুরুজী একদম সাক্ষাৎ ঈশ্বরের অবতার। শরীর দিয়ে আলো বাহ্'রাইছে। জোড়হাত
কপালে ঠেকালো।
--তোরেই
পারা চক্কতী ঠাকুর বঠে। কাশী বাবা'বিশ্বনাথের থানে নিবাস।
বাইরে
কিসের যেন গুঞ্জন চলছে ক্রমশ ভলিউম বেড়েই চলেছে। শিশ্'রার চোখ বড়বড়, কানখাড়া।
--চ
দেখি কিসের বচসা!
শিশ্'রা
বাড়ির বড়ছেলে। বাবার বয়স হয়েছে। অগত্যা তাকেই, সঙ্গে আমিও বেরিয়ে এলাম।
--এই তো শিশ্'রা, ইসব কী হচ্ছে?
--কিসের
কী হচ্ছে?
--ঐ
সাধুটা হর-কাকির সোনার আংটি লিইলিলো কেনে?
--কাঢ়ে
তো লেই নাই, দিঞ্ছে তাই।
--
হিপনোটাইজ করৈ কাঢ়েছে।
--বঠে!
--তুঁইও
সব্বনাস না চাস, ভাগা।
--বঠে
বাবু, দেখছিস ঠাকুর?
--ঠাকুরকে
মাঝে টানিস না।
--উয়ার
বংশই আলাদা। সাধুকে বল আংটিটা ফিরত্ দিঞে মানে মানে ফুটুক ইখানলে।
বচসার তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। আমি বৈঠকখানা ঢুকতেই শিশ্'রার গুরুজীর মুখোমুখি। বৌঠান জোরে জোরে পাখার বাতাস করেই চলেছেন। গুরুজী ঘেমেই চলেছেন।
-ঙ্কী
হচ্ছে বলুন তো?
--বাবাজী
বাক্সোপ্যাঁটরা গুছান্।
--সে
কী!
--এই
তুফানের সামনে যাওয়ার চেষ্টাও করবেন না। এই নধরকান্তি চেহারার নক্সা বিগড়ে
যাবে আপনার। দয়া করে কেটে পড়ুন। এপাড়াই এরকম। অনেক বার দেখেছি। এ তুফান থামাবার
আশা নেই। না শিশিরবিন্দু না ঠাকুরবিন্দু। আপনি এই মূহূর্তে ছাদে ছাদে বাঁয়ে ঘুরলেই আটচালার
কাছে সিঁড়ি দিয়ে সোজা আমলাপাড়ার রাস্তা পেয়ে যাবেন।
--না,
আমি ঐভাবে পারব না। আপনি ওদের শান্ত করার চেষ্টা করুন না!
বাপ্'রে! ঐ তুফানে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কোথায় ফেলবে ঈশ্বরই জানেন। তবুও দেখি আরেকটি চেনামুখ, আমদের ক্লাশের বন্ধু তুলসী গিরগিটির মতো লাল-পিলা হচ্ছে উত্তেজনায়। গোরা রং, ভীষণ মারর্খন্ড। আমি বলতে গেলাম তো আমাকেই বলে বসলো,
--আব্বে
বাউন বাউন মিলে গিলি নাঃ?
--আমার
একটি কথা শোন।
--বল
ঠাকুর, তুই কী বলবি, বল!
--বলছি
শিশ্'রাকে গুরুপ্রহার পাপের ভাগী করা কি ভালো, বল? ও তো সত্যিকার ভক্তি দিয়ে শিষ্যত্ব
গ্রহণ করেছে, বল?
--হোঁ
হোঁ ঠাইগরা্ ঠিকেই বলছে।
--উয়ার
ঠিনে যে যা দিঞ্ছিস, লিয়ে লাও, দিয়ে ছাইড়ে দাও। বাউন মারার পাপ তুরাই বা কেন লিবি,
বল?
--ঠাকুর
তর গান্ধীগিরি তরেই কাছ্ রাখ। ঠগ্'টোকে হামদের হাওয়ালে কর। উয়কে ঠ্যাঙায়, বহুদিন
হাতের সুখ লিয়া হয় নাই।
--না
না তুলসী, তুলা একা একটা মানুষ কে অমন কত্তে নাই! ছাড়ে দে। উয়ার পাপের শাস্তি উপরওয়ালার
হাতে ছেড়ে দে!
ভিড়ের অর্ধেক লোকেরা আমার যুক্তি ঠিক্ মনে করল। এবং তাই স্থির হল। তবুও গলির ভিড়ে দু একজন সুন্দর চুল্ টেনে দিল। কেউ ওরই মধ্যে গাঁট্টা মেরে দিল। হাতের সুখ, এই আর কী!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন