সমকালীন ছোটগল্প |
নিছক একটি বৃষ্টিদিন
আজ দিনটি বৃষ্টির। টি ভি-তে দেখাচ্ছিল বটে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ হয়েছে, তার জেরে উত্তর পূর্বাঞ্চলে কয়েকদিন ধরে লঘু বৃষ্টিপাতের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। ভোরের দিকে আকাশ কালো ছিল, সকাল দশটার দিকে শুরু হলো হালকা বৃষ্টি। গাছের পাতায় পাতায় শেষ বসন্তে জমা ধুলোকে খুব যত্ন করে ধুয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। এসব দিনে কিছু করার থাকে না দেবরাজবাবুর। অবশ্য কোনদিনই আর কী করার থাকে তার? এই জীবনের দায়দায়িত্ব সবই পালন করেছেন। বৃদ্ধ মা বাবার দেখাশোনা করেছেন, তারা বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে কিছুদিন জমিয়ে সংসার করলেন। তারা প্রতিষ্ঠিত হলো, বিয়ে দিলেন। কর্মসূত্রে এবং বিবাহসূত্রে ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে। স্ত্রী একটু তাড়াতাড়িই চলে গেলেন। এখন দেবরাজবাবুর পালা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, জীবনকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তার সঙ্গে থাকতে থাকতে প্রফুল্লেরও বয়স হলো। ওনার অফিসের পিওন ছিল প্রফুল্ল। প্রায় দেবরাজবাবুরই সমবয়সী। দেবরাজবাবুর রিটায়ার হওয়ার পরের বছর প্রফুল্লেরও চাকরি শেষ হয়। ওর তিনকুলেও কেউ ছিল না। দেবরাজবাবু ওকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। এখন দুজন দুজনের সঙ্গী। ছেলেমেয়েরা অনেক দূরের মানুষ, প্রফুল্লই কাছের। দীর্ঘদিনের চাকরি জীবন আর এই অবসরকালীন জীবন, কত বছরের জানাশোনা তাদের। প্রফুল্ল অসুস্থ হলে দেবরাজবাবু উৎকন্ঠিত হোন। কী জানি কী হবে? প্রফুল্ল আগে মারা গেলে দেবরাজবাবু সত্যিই অসুবিধেয় পড়বেন। তিনি ওর জন্য কিছু টাকাও ডিপোজিট করে রেখেছেন, সেইসঙ্গে এই বাড়িতে থাকার অধিকার। তবে ওর মোটামুটি শক্তসমর্থ চেহারা দেখে তিনি খানিকটা আশ্বস্তই হন।
রেঁধেবেড়ে দেওয়া, দেবরাজবাবুর দেখাশোনা, বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সব দায়িত্বই প্রফুল্লের। সকাল সকাল তিনি একটু হাটবাজার ঘুরে আসেন অকারণে। দুজন মানুষের তেমন কোনো বাজারের দরকার নেই, তবুও রোজকার শাকসব্জি তিনি রোজ কেনেন। একটু হাঁটাহাঁটি হয়। পুরনো লোকজন কমে গেলেও কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়। তিনি চান না কারো সঙ্গে দেখা হোক। দেখা হলেই দীর্ঘশ্বাসের কথাবার্তা শুরু হয়। অসুখ বিসুখ, ছেলেমেয়েদের দূরে থাকা। কারো কারো ছেলেমেয়ে কাছে থাকলেও খুব অশান্তি। এইসব শুনলে তিনি হতাশায় পড়ে যান। বরং অনেক অপরিচিত মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তার ভালো লাগে। বিরক্তিকর আর বিষণ্ন এই বৃষ্টির দিনগুলো, সবার কাছে নয়, যাদের পরিবারে এখনো কচিকাঁচা আছে, লোকজন আছে, তারা হয়তো পাতলা মুসুড়িডাল, গরম গরম ডালের বড়া দিয়ে দিনটিকে সেলিব্রেট করেন, ছেলেমেয়েরা বারান্দার সিঁড়ির কাছে জমে থাকা জলে কাগজের নৌকো ভাসায়। সেইরকম একটি জীবন একদিন দেবরাজবাবুরও ছিল। কিন্তু এখন গতজন্মের স্বপ্ন মনে হয়। বাড়ির আনাচকানাচে কান পাতলে তিনি যেন এখনো শোনেন সেইসব সুখস্মৃতির মৃদু স্বর্গীয় আওয়াজ। নাহ্, আজ তিনি বড্ড বেশিই ভাবছেন।
এই
বাড়ি এখন তাকে গিলে ফেলবে। প্রফুল্লকে বললেন, ও যেন স্নানটান করে খেয়ে নেয়। তিনি একটু
ঘুরে আসছেন। ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। নিজের পাড়ার রাস্তাগুলোও কেমন যেন অচেনা হয়ে
পড়েছে আজকাল। এদিক ওদিক বাড়ি উঠছে নতুন নতুন। বৃষ্টিভেজা রাস্তা, গাছপালা দেখতে দেখতে
হাঁটছেন তিনি। দুটো মেয়ে আসছে, ছাতা নেই ওদের, খুব সম্ভবত কোচিং থেকে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ করেই নিজের
মেয়ের কথা মনে হলো। এসব ভাবলেই মন খারাপ হবে। ভাববেন না। শহরের এদিকটায় এখনো কিছু ফাঁকা
জায়গা রয়েছে। বাজারের রাস্তা যেখানে শেষ হয়ে এসেছে, সেখানে একটি চায়ের দোকান। এইসব
দোকানে তিনি চা খেতেন বহু যুগ আগে। যখন চাকরি পাননি। অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করতেন,
তখন তিনি প্রায়ই এধরনের চায়ের দোকানে বসে চা, কেক খেতেন। তাতে একটা কাজ হতো, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসিড হয়ে যাওয়ায়
পেট ভর্তি মনে হতো বেশ কিছুক্ষণের জন্য। আর
খিদে পেতো না। এরকম চায়ের দোকানে বসেই তিনি অনেক হাত ঘোরা সকালের ময়লা, কোঁচকানো দৈনিক
পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে চাকরির বিজ্ঞাপন, নতুন কোনো ব্যবসার খোঁজখবর পাওয়া যায়
কিনা তন্নতন্ন করে খুঁজতেন। তারপর একদিন সত্যিই ওনার সরকারি চাকরি হলো। প্রমোশন পেয়ে
পেয়ে উঁচুতেও উঠলেন। জীবনে চলার পথে এমন চায়ের
দোকান ছেড়েছেন বহুদিন হলো।
এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না। কেবল মেঘলা হয়ে আছে, ইচ্ছে হলো ঐদোকানটিতে বসে চা খেতে। এখন চাকরিও নেই, স্ট্যাটাস মেনটেন করেই বা কী, তবে সহ্য হবে তো?
হবে
হবে। লিকার চা খাবেন। দোকানের সামনে একটু টিনের
ছাউনি রয়েছে। বেঞ্চ পাতা। ভেতরে পাম্প দেওয়া গ্যাসের উনুনে চায়ের কেটলি বসানো। বয়ামের
মধ্যে বেকারির কেক বিস্কুট রাখা। চানাচুর আর চিঁড়ে ভাজার প্যাকেট ঝুলছে। বহুদিন আগের
দৃশ্যই যেন আবার উঠে এসেছে, তবে তখন প্যাকেটে চিঁড়েভাজা পাওয়া যেত না।
দেখলেন
দোকানদার খুব কাছে চোখ নিয়ে বিড়বিড় করে খবরের কাগজ পড়ছে। তিনি একটু কাশলেন।
চা
হবে?
হু।
পত্রিকা রেখে লোকটি উঠে দাঁড়ালো। গ্যাস ধরালো। পুরনো জল ফেলে আবার নতুন জল দিয়ে চা
বসালো।
স্যার
কি এদিকে নতুন?
না,
না। পুরনো লোক।
ও।
বিশ্বযুদ্ধ
লাগছে। পেট্রোলের দাম বাড়তাছে রোজ। জিনিসপত্রের দামও খুব বাড়ব।
ইউক্রেনরে
একদম গুঁড়া কইরা দিতাছে রাশিয়া। ভারতের স্টুডেন্টরার যে কী হইব এখন, ওই যে মেডিকেল পড়তে গেছল।
দেবরাজবাবু
বুঝলেন খবরের কাগজ পড়া বিদ্যা ঝাড়তে লোকটা বদ্ধ পরিকর। তা ঝাড়ুক। চ্যানেলে চ্যানেলে
এতো ঝাড়ছে, আর চায়ের দোকানদার কী দোষ করল!
তা
বাবু কি সরকারি চাকরি করতেন? এখন পেনশনে গেছেন?
হু।
ও
আইচ্ছা। কী চা খাইবেন, বৃষ্টির দিন আদা দিয়া ভালা কইরা বানায়া দেই!
না।
দুধ চিনি ছাড়া লিকার দাও।
খাইয়া
দেখেন স্যার। আবার আইবেন।
শিবুর
দোকানের চায়ের নাম আছে বাবু এই পাড়ায়।
হুম।
লোকটার বকবক বেশ ভালোই লাগছিল দেবরাজবাবুর। দুধ চা বানিয়ে দিয়েছে ঘন করে। এরকম চা ওনার স্ত্রী বানাতো। দুধ চিনি দিয়ে ঘন চা বানিয়ে মুড়ি চানাচুর দিয়ে খেতো।
আশ্চর্য
লোকটিও একটু মুড়ি চানাচুর ওনার সামনে এনে রাখল। বলল, সর্ষের তেল দিয়ে মাইখ্যা দিছি।
খান স্যার।
একটি
চামচ দাও তো।
লোকটা
একটু অবাক হয়ে একটি চামচ দিলো। মুড়িও চামচ দিয়া খায়, বাবু লোকেরা।
দূর
থেকে একটি টুকটুক আসছিল। চায়ের দোকানের কাছে এসে গতি শ্লথ হলো। টুকটুক থেকেই মুখটা একটু বাড়িয়ে, এক ভদ্রমহিলা
বললেন কয়েক প্যাকেট চিঁড়ে ভাজা দাও তো শিবু।
শিবু
একগাল হেসে বলল, টুকটুক ছাইড়া দেন, একটু চা খান বইয়া, এখনি বানাইছি, এই বাবুও খাইব।
ঘরে গিয়াও তো করবেন, আসেন দিদিমণি।
দেবরাজবাবুর একটু অস্বস্তি হলো, ভদ্রমহিলার বয়স বোঝা যাচ্ছে না। তাঁতের শাড়ি পরেছেন, পিওর তাঁত, হ্যান্ডলুম নয়। কপালে খয়েরি টিপ, এছাড়া ব্যাগ, ঘড়ি সবকিছু দেখে মনে হয় চাকরি বাকরি করেন। তা সেই দিদিমণিও দিব্যি টুকটুকের ভাড়া চুকিয়ে নেমে গেলেন, খুব সহজভাবেই বসে পড়লেন দেবরাজবাবুর পাশে। যেচে কথা বলার অভ্যাস দেবরাজবাবুর কোনোকালেই নেই, হঠাৎ তার খেয়াল হলো নিজের মেয়ে এবং ছেলের বউ ছাড়া দীর্ঘদিন তিনি কোনো মহিলার সঙ্গে কথা বলেননি, বিশেষ করে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর।
ভদ্রমহিলা
শিবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চায়ের কাপ হাতে নিলেন।
শিবুই
বলল, তিনি কিন্তু ডাক্তার, হোমিওপ্যাথিক, এক্কেরে অব্যর্থ ঔষধ দেয়,
বাজারে
চেম্বার আছে বাবু, আর এই পাড়ার সবাই তো আমরা দিদিমণির ঔষধ খাই।
এখন,
দেবরাজবাবুকে একটু ভদ্রতা করতে হলো। নমস্কার জানালেন, মুখে বললেন, বাহ্ ভালোই হলো আপনার
সঙ্গে পরিচিত হয়ে। তবে ঠাকুরের দয়ায় শরীর এখনো
তেমন ভেঙে পড়েনি।
ভদ্রমহিলা
এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু একটু হাসলেন, তারপর দেবরাজবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
ডাক্তার দেখলেই অসুখের কথা বলতে হয় বুঝি?
আপনি
তো বলতে পারতেন, বৃষ্টিদিনে এইভাবে বসে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।
যাহ্,
এতো দেখছি মুখকাটা মহিলা। সৌন্দর্যও এখনো ছেড়ে যায়নি তাকে।
দেবরাজবাবু
কিঞ্চিৎ মুগ্ধ হলেন। কষ্ট হয়ে গম্ভীর হয়ে রইলেন। তবে ভদ্রমহিলা নানান কথা বলছেন শিবুর
সঙ্গে। সজনে ডাঁটার দাম থেকে ইউক্রেন।
ভদ্রমহিলা
হঠাৎই বললেন, চলি রে শিবু আজ, তারপর দেবরাজবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কোনদিকে যাবেন,
চলুন যাওয়া যাক।
হ্যাঁ,
চলুন।
চারপাশে
বৃষ্টি জমে থাকা কিন্তু আপাতত বৃষ্টিহীন দিনে, দেবরাজবাবু একজন অপরিচিত মহিলার সঙ্গে
হাঁটাটাকে উপভোগ করছিলেন, অস্বীকার করতে পারছেন না যে, তার বেশ লাগছে।
আমার
নাম মিত্রা। মিত্রা দত্ত। আমি কিন্তু পাশ করা ডাক্তার। ভাববেন না হাতুড়ে হোমিওপ্যাথ।
সামনেই আমার বাড়ি।
দেবরাজবাবু
শুধু শুনছেন। তারপর ভাবলেন কিছু বলতে হয়। তিনিও নিজের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।
তবে মিত্রা দত্ত, অবিবাহিতা, বিধবা না ডিভোর্সি তার জানতে আগ্রহ হচ্ছিল। শাখা সিঁদুর
ইত্যাদি চিহ্নগুলো না থাকায় তিনি দ্বন্দ্বে পড়েছেন। আবার অতি স্বল্প পরিচিতা একজন মহিলাকে
এসব জিজ্ঞেস করাও চূড়ান্ত অভদ্রতা।
এই তো আমার বাড়ি।
দেবরাজবাবু
দেখলেন খুবই সাদামাটা একতলা একটি বাড়ি। গেটে নেমপ্লেটে, ডাঃ মিত্রা দত্ত, হোমিওপ্যাথ, লেখা আছে।
হঠাৎ
দেবরাজবাবুর মনে হলো, প্রফুল্লর শরীরটা ভালো যায় না। অ্যালোপ্যাথিক ঔষধও খেতে চায় না, ওকে মিত্রা দত্তের কাছে পাঠালে
মন্দ হয় না।
মিত্রা
দত্ত, এবার বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছেন।
হঠাৎ
দেবরাজবাবু বললেন, একটু শুনুন, কিছু না মনে করলে একটি অনুরোধ ছিল।
মিত্রা
দত্ত ঘাড় ঘোরালেন, হাসলেন, তারপর বললেন, ফোন নং দিতে ডাক্তারদের আপত্তি থাকলে চলে না
কিন্তু, পেশাদার আছি বুঝলেন, করে কম্মে খেতে হয়…
দেবরাজবাবু
বিপদে পড়লেন, এ তো দেখছি মনের কথা বুঝতে পারে!
নিন
আপনার ফোন বের করে সেইভ করুন, বলছি আমি।
দেবরাজবাবুও
অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন, বলুন!
মিত্রা
দত্ত, পাতলা ঠোঁটে সীমিত হাসি রেখে কেটে কেটে বললেন… ৯৪০২৩৪৮…
দেবরাজবাবু
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলেন, কী জানি হয়তো এই নাম্বারে সত্যিই কেউ একজিস্ট করে এখনো!
ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আমার
মুছুনখুব ভাল লাগল…
উত্তরমুছুন