সমকালীন ছোটগল্প |
শহরের আকাশে এক বিশাল কালো রাত-পাখি
রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা মতন হবে। শেষবেলায় দু’-দুটো মদের পার্টিকে ছাড়তেই সময় পেরিয়ে গেল সনাতনের। বুকের ভিতরটায় কেমন একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করছে সে। কারণটা ওই পুলিশ; রাতের এই সময়টা থানা থেকে এখন পেট্রোলিং শুরু করে দেবে; মাঝেমধ্যে, ক্বচিৎ গাড়িতে স্বয়ং বড়োবাবু উপস্থিত থাকেন। আর নয়তো পেট্রোলিং-এর আগে থাকতেই থানার নিজস্ব স্টাফ অথবা খোচরগুলো প্লেন-ড্রেসে ঘোরাফেরা করে।
দোকান বলতে শহরের এক রাজপথের ধারে বহু পুরনো অভিজাত বাজারের প্রান্তসীমায় প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট গুমটি মতন। খরিদ্দার দু’টোকে ছেড়ে দেওয়ার পর, এই মুহূর্তে, হাত ধোওয়ার পরও সনাতন লক্ষ্য করে হাতের কব্জির ওপরে এবং পায়ের হাঁটুর নিচে তখনও রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে রয়েছে। যদিও, সে-দিকে আর ভ্রুক্ষেপ না-করে সে ডালার মুরগিগুলো ভালো করে গুনে নেয়— এ-দিনের শেষবারের মতো; ডালার মুরগিগুলো এখনও যে-কটা অবশিষ্ট রয়েছে— সঙ্গীরা পাশ থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের মধ্যে থেকে এক অব্যর্থ নির্বিকারতা কাজ করে; এদের কেউ কেউ ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে খুনসুটি করছে, কেউ মুখ হাঁ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে— নৈর্ব্যক্তিক তাদের চাহনি, কেউ-বা ওপরের তারায় ভরা আকাশের দিকে চেয়ে আছে… সনাতন এইমাত্র ডালাটিকে সামনে থেকে তুলে লোহার খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
মহামারির সময়। লকডাউনের কারণে অন্যান্যদের মতো প্রতিদিন সে-ও পুরোটা সময় দোকান খুলে বসতে পারে না। তবে হপ্তাখানেক হল, নির্বাচন এগিয়ে আসাতে লকডাউনের সময়সীমা কিছুটা শিথিল হয়েছে; এই সুযোগে ছোট ব্যবসায়ীরা একটু সুযোগ নিয়েছে মাত্র। তাছাড়া আজ, কোনও এক রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠন সন্ধ্য ছ’টা পর্যন্ত বন্ধ্ ডেকেছিল। এরপর বাজারের প্রান্তসীমায় থাকা মার্কেটের ছোটো ব্যবসায়ীরা আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত দোকান খুলে রেখেছিল। সনাতনরা ওই সময় পর্যন্ত দোকান করার পর পুলিশের তাড়ণায় বন্ধ করে দেয়; তারপর তারা পরস্পরে আড্ডা জমায়… তারা যখন বাড়ির পথে রওনা দেয় রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা।
জনমানবশূন্য রাস্তা। নিঃসঙ্গ সনাতন নিজের বাসার দিকে হেঁটে চলেছে; এখন তার মনে হচ্ছে, লকডাউনের এই শহরে যেন এক অদৃশ্য কালো পাথর শহরের শরীরের ওপর ক্রমশ চেপে বসছে। প্রায় সাড়ে দশটার শহর এখনই যেন মধ্যরাত।
সনাতনের দুর্ভাগ্যের ইতিহাসের এক ছোট্ট কাহিনি
বাসা বলতে সনাতনের তিন পুরুষের শরিকি বাড়ি। বাড়ির বয়স প্রায় নব্বই বছরের কম বেশি হবে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বলতে গেলে এখন ভগ্নপ্রায় দশা। আগে একান্নবর্তী পরিবার ছিল, অর্থাৎ দাদুর বাবা, অথবা তার সন্তান-সন্ততিদের এক হাঁড়ি ছিল। তারপর সময়ের সাথে সাথে তাদের মানসিক জগতে এক অদৃশ্য গভীর ফাটল ধরে। একই বাড়ির একই ছাদের নীচে একই পরিবারের মধ্যে যেন আলাদা অনেকগুলো পৃথিবী— এ-দুর্ভাগ্য দেখতে দেখতেই সনাতন বড়ো হয়েছে; বাকিটা সে তার মায়ের মুখ থেকে শুনেছে… সনাতনের বাবারা ছিল চার ভাই, তিন বোন। দুই পিসিদের অবস্থাপন্ন পরিবারে বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিল সনাতনের দাদু। জ্যাঠা-কাকারা কেউ তেমন উচ্চ শিক্ষিত নয়। বড়ো ও মেজো গ্রাজুয়েশন ফেল। যদিও তারা সরকারি কেরানি হিসেবে অবসর নিয়েছিল। সেজোজন পড়াশোনায় বেশি দূর না-এগোলেও ধুরন্ধর বুদ্ধি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে নিজেরটা ভালোরকম গুছিয়ে নিয়েছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে পয়সা করেছিল সেই-ই সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে ছোটোজন, অর্থাৎ সনাতনের বাবা ছিল ক অক্ষর গোমাংস। এসবের অন্যতম একটা বড়ো কারণ হল, তিন পিসির বিয়ে দেওয়ার পর সনাতনের দাদুর হঠাৎ করে ব্যবসার প্রথম শুরু হয়। দাদু সে-সময় শেয়ারবাজারের একজন নামকরা ব্রোকার ছিলেন; ছিল কয়লার ব্যবসা: উড়িষ্যার লিঙ্গরাজ টেমপেলের উল্টোদিকে পাথরের বিশাল বড়ো বাড়ি বানিয়েছিলেন… যাইহোক এসব তো এখন অতীত।
অতীত ধুয়ে জল খেতে গেলে বিশেষ করে সনাতনদের তেমন কোনও কাজে আসবে না। কারণ, সনাতনের বাবার বিদ্যের দৌড় মাত্র ছ'-ক্লাস পর্যন্ত; তাছাড়া সনাতনের বন্ধুবান্ধব, মেলামেশার জগত ওদের যৌথ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতে ‘রাস্তার ওই ছোটলোকগুলোর সঙ্গে’। শুধু পরিবারের লোকেরা কেন, প্রতিবেশীরাও আড়ালে-আবডালে সনাতনের বাবা সম্পর্কে বলত: ‘যেমন অপদার্থ, তেমনি হদ্দ বোকা।’ আর কেনই-বা বলবে না তারা। উঁচু বংশের ছেলে হয়ে প্রেমে পড়লি কি-না বস্তির এক মেয়ের সঙ্গে! যদি-বা পড়লি, তাকে আবার শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে ঘরে এনে তুললি!
একমাত্র মা ছাড়া বাবা-দাদারা সনাতনের বাবাকে ভিন্ন করে দিয়েছিল। শুধুমাত্র মায়ের জেদে সনাতনের বাবাদের স্থান হয়েছিল ছাদের চিলেকোঠার একমাত্র ঘরে। ঘরের লাগোয়া সনাতনের বাবা পায়খানা ও কলঘর বানিয়ে নিয়েছিল। ওই তখন থেকেই সনাতনেরা ওই ঘরটাতেই রয়ে গিয়েছে। সনাতনের বাবা বাড়ির আর কোনও অংশের ভাগ পায়নি।
কিন্তু সনাতনের মা হাল ছেড়ে দেয়নি। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যতই তার দিকে বিষ-নজরে তাকাক না-কেন, সেখানের নানারকম প্রতিকূলতাকে মানিয়ে নিয়ে নিজের মাথা ঠান্ডা রেখেছে— নিজের বাপের বাড়ির সমাজের কাছে তার মান-মর্যাদা বেড়েছে। কিন্তু সময়ের এমনই জবাব ছিল যে, ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপ শ্বশুরকে শেষমেশ তার ছোটো বউমার সেবা নিয়েই মরতে হয়েছিল…
রাত সাড়ে দশটার অতিমারির শহর
সনাতনের মনে হচ্ছে শহরের পুরো শরীরটাই যেন কোভিডের জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তাই এক অজানা আতঙ্ক এ-মুহূর্তে তাকে গ্রাস করতে থাকে। সনাতন একবার মাথা তুলে তাকায় উপরের দিকে। লকডাউনের সময় গাড়ি ঘোড়া না-চলাতে শহরের দূষণহীন আকাশ। সেই আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে অন্ধকার শূন্যতাকে ভেদ করে তার মনে হয় কোটি-কোটি গ্রহ-তারারা ঝুলে রয়েছে পৃথিবীর ওপর… নিঃসঙ্গ সনাতন রাস্তা দিয়ে হাঁটে আর বারবার উপরের দিকে তাকায়; তার যদি একটা বিশাল হাত থাকত তবে সে ছুঁতে পারত সেই সব গ্রহ তারাকে। এ-পৃথিবীকে যেন আর তার ভালোলাগে না; তার খুব ইচ্ছে করে বহু দূরের ওই গ্রহ-তারাদের যে-কোনও একটাতে যদি সে চলে যেতে পারত…
কিন্তু এখন, হঠাৎই সনাতনের মনে হয় শহরের শরীরটা যেন আরও ঘন কালো হয়ে উঠেছে! এতক্ষণ তার চারপাশে যে দু’-চারজন মানুষও দেখা যাচ্ছিল তারাও আর নেই! রাস্তার দু’ধারে বৈদ্যুতিক বাতির স্তম্ভগুলো কখন যে নিভে গেছে তার কোনো খেয়ালই করেনি সে। তার চারপাশের বাড়ি আর বহুতলগুলো যারা একটু আগেই দৃশ্যমান ছিল— তারা সবাই যেন এই অন্ধকারে উধাও! কেন জানি না, সনাতনের মনে হল— এখন, এই পৃথিবীতে সে ছাড়া কেউ-ই আর জীবিত নেই; যেন পুরো শহরটাই এখন মৃত, অথবা এক অন্ধকার চাদরের নীচে শহরের মৃতদেহ ঢাকা পড়ে আছে। শুধুমাত্র দূর আকাশের অজস্র তারার আলোয় এই মৃত্যুশহর আলোকিত…
রাজপথের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিঃসঙ্গ সনাতন বাঁদিকের গলিটায় ঢুকে পড়ে; অন্ধকার আরও গাঢ় হয়— এ যেন এক অন্ধকারের মহামারী… তখন হঠাৎ-ই সে পিছন থেকে এক মৃদু ধাক্কা খায়— আর ঘাড়ের কাছে শাণিত হিমের এক তীক্ষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে! এই রকমটা বোধ হওয়ার পর-পরই সনাতনের মনে হয় তার শরীরটা ক্রমশ হালকা হয়ে আসছে— পেঁজা তুলো বা পালকের মতো; হাত দুটোকে যেন আর হাত মনে হচ্ছে না। সে স্বচক্ষে দেখতে পেল সমগ্র হাত দু’টো থেকে ক্রমশ হালকা পালক গজাচ্ছে… আর, অবশেষে সে এক বিশাল ডানাওয়ালা পাখিতে পরিণত হল। বাড়ি না-গিয়ে এখন বরং তার ইচ্ছে হল দূর মহাশূন্যের শতকোটি নক্ষত্রদের জগতে ঘুরে আসার, অথবা তার ইচ্ছে হল, দূর তারাদের যদি কোনও একটাতে সে চলে যেতে পারে… কিন্তু হঠাৎই সনাতনের মনে হল তার দুই পা এখন মাটি থেকে সামান্য একটু ওপরে, অর্থাৎ মর্ত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সে; সে এখন ভাসছে, শূন্যে— পালক অথবা পেঁজা তুলোর মতো!...
সনাতন ঘোষ। উচ্চতা: ৫ ফিট সাড়ে এগার ইঞ্চি। গায়ের রং: শ্যামবর্ণ। বাঁ গালে তিল। ডান ভুরুতে একটা কাটা দাগ। বয়স: ৪৫।
পঁয়তাল্লিশের সনাতন অবশেষে উড়ান দিল— এই পৃথিবীর বুক থেকে, সমস্ত মায়াজাল কাটিয়ে, এক বিশাল ডানাওয়ালা পাখি হয়ে— নিজেকে ভাসিয়ে দিল মহাশূন্যের অনন্ত মহাসাগরে।
সনাতনের উড়ান মাত্রা, আর তার ফেলে যাওয়া পৃথিবী
মহামারির শহর। নিশ্চুপ নিরবছিন্ন অন্ধকার! সনাতন এখন ডানায় ভর করে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে। একমাত্র পৃথিবীর মাটি ছাড়া সনাতনের এই উড়ান-মুহূর্তের সাক্ষী তেমন কেউ ছিল না। মহাকাশের দিকে মুখ তুলেই সে উড়ান শুরু করেছিল। তার এই অনন্ত দীর্ঘ সফরের একমাত্র লক্ষ্য মহাকাশের ওই শতকোটি গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে এমন আরেক বাসযোগ্য পৃথিবীর সন্ধান করা। নাহ্, সে ঠিকই করে ফেলেছে তার উড়ান সে থামাবে না, যতদিন না সেই পৃথিবীর' আবিষ্কার করতে পারছে। সে এমন এক পৃথিবীর সন্ধান করবে যা তার জন্মগ্রহের মতোই সবুজ-পাহাড়-নদী আর সাগরে মোড়া থাকবে। নাহ্, কোনও মানুষকে সে সেখানে দেখতে চায় না। মানুষ বড়ো বিশ্বাসঘাতক, যা সে তার পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এই পৃথিবীতে নজর করে আসছিল— সে দেখে আসছিল সেখানে মানুষের প্রতি মানুষের লোভ-হিংসা আর নিষ্ঠুরতা; সে দেখে আসছিল সবুজ-পাহাড়-নদী-সাগর আর অগণিত জীবকুলের ধ্বংস হতে থাকা। উড়ান দিতে দিতে সনাতন মনে করে তার জন্মগ্রহে একমাত্র পয়সাওয়ালা ক্ষমতাবান মানুষগুলোই নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকার ভোগ করে, আর কাউকেই তারা চায় না— পাখি-কীটপতঙ্গ কাউকে না, গাছ-পাহাড়-নদী-সাগর কাউকে না, এমনকি তার মতো মানুষগুলোকেও তারা চায় না। তাই জন্যই তো সনাতনের এই উড়ান! তাই জন্যই তো সে চায়— দূর মহাকাশে শতকোটি নক্ষত্রের মাঝে সে এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করবে— সেখানে এক বিশাল ডানাওয়ালা পাখি হয়ে নতুন প্রাণের বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে…
মাটি ছেড়ে সনাতন এখন অনেকটাই ওপরে উঠে গেছে। পৃথিবীর অনেকটা ভূখণ্ড এখন তার চোখের সামনে চলে এসেছে। তার মা একবার তাকে বলেছিল— সত্যিকারের নরক হল পৃথিবীর মাটি, আর আকাশ হল স্বর্গ। আমাদের মহান মহাত্মারা সেই স্বর্গে স্থান পাওয়ার জন্যই আজীবন মানুষের জন্য সাধনা করে গেছেন।
মানুষ থেকে বিশাল ডানাওয়ালা পাখিতে রূপান্তরিত হওয়ায় সনাতনের এখন তার মা’র কথাই মনে পড়ল। কারণ, সনাতন তার জন্মগ্রহে যতটা না সুখে ছিল, তারচেয়ে পৃথিবী ছেড়ে উড়ান দেওয়ার মধ্যে লক্ষ-লক্ষ গুণ সুখের— তার এই সুখানুভূতির মধ্যে দিয়ে মায়ের বলে যাওয়া সেই স্বর্গসুখের ভাবনার সঙ্গে এই মিলে গেল এখন। এই অনাস্বাদিত স্বর্গসুখ যেন সত্যিই অপার্থিব।
কিন্তু সনাতন ডানা মেলে যতই ওপরে উঠতে থাকে ততই সে বুঝতে পারে মায়ার মাধ্যাকর্ষণ তাকে আবার পৃথিবীর বুকে নামিয়ে আনতে চায়। তার মগজ অজস্র স্মৃতিভারে ভারী হয়ে যায় তখন… তার চিলেকোঠার ঘরের সামনে ছাদটায় এসে বসা পায়রাদের সঙ্গে তার বোধহয় আর দেখা হয়ে উঠবে না; সেই কোন শৈশব থেকে ওরা ওর মনের সাথী। তবে তাদের সঙ্গ বিশ্বাসঘাতকতাও আছে। রিকশাচালক মনসুরের ছেলে ছিল কৈশোরের বন্ধু। কী বিশাল তাদের পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া উন্মুক্ত আকাশের তলায় বাড়ির ছাদটায় লেগেছিল এক ভালোলাগা চৈত্রের বিকেল। মুনসুরের ছেলে ছিল প্রায় ওরই বয়সি। সে একদিন এল সনাতনদের বিশাল ছাদটায় চিলেকোঠার ঘরে, ঢোলা হাফপ্যান্টের বাম-পকেটে বাম-হাত ঢুকিয়ে। সনাতনের কাছে একটু অস্বাভাবিক লাগলেও সন্ধ্যা অবধি সময় গেল: অবশেষে সে বার করল সাদা ধবধবে একটা পায়রা, আর পরক্ষণেই সে আবারও ওটাকে প্যান্টের পকেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখল!
সনাতন খুব সন্তর্পণে বলল, ‘কোথায় পেলি?’
‘ওই দত্তদের
বাড়ির দেওয়াল দিয়ে উঠে। ছাদের পাইপের ওই ঘুলঘুলিটায়।’
—
কীভাবে উঠলি?
‘ওই পাইপ
বেয়ে বেয়েই। একতলা তো, কী এমন ব্যাপার।’
—
তো এখন কী
করবি?
‘যাবি আমার
বাড়ি?’
— মা-বাবা
আজ আসবে না। তারাপীঠ গেছে; কী সবের মানত আছে যেন। আসলে তোর সাথে ঘুড়ি ওড়াবো বলে ‘ছক’ করে যায়নি।
‘তা’লে তোর এখানেই থেকে যাব?’
—
তোর তো ঘুড়ি
আনার কথা ছিল…
‘আরে ধুর! আজ ও-সব
থাক।’ ম—বলে মনসুরের ছেলে প্যান্টের পকেটের ভেতর থেকে পায়রাটাকে আবার
ওর চোখের সামনে মেলে ধরল। এর অর্থ সনাতন কিছুই বুঝল না। বিস্ময় ‘হাঁ’ করে সে আরও খানিক তাকিয়ে থাকে মনসুরের ছেলের
দিকে!...
পরদিন, একদম
ভোরবেলা, সনাতনের সেজকাকা উপরে এসেছিল পায়চারি করতে। বোধহয় নজর পড়েছিল সনাতনদের ঘরের
উল্টোদিকের ছাদের ওই কোণাটায়; দেখেছিল রক্তমাখা পালকের গুচ্ছ। কিন্তু কিছু না-বলে সেজকাকা চলে গিয়েছিল। একটু পরেই সেজকাকিমার গলার স্বর নীচ থেকে
ভেসে এসেছিল— ‘বাড়িটায় এবার অমঙ্গলের
বাসা বাঁধবে… তোমাদের বংশের কলঙ্ক… কাদের
সাথে মেলামেশা করছে দেখতে হবে তো? এ-বাড়ি
ছোটলোক আর ভদ্রলোকের মধ্যে কোনো ফারাক রইল না।’…
কত কথাই সনাতনের এখন মনে পড়ে…
মনে পড়ে তার চিলেকোঠার ঘরের দরজার উল্টোদিকের জানলার
বাবলিকে। জানলায় এই ওর দিকে তাকিয়ে থাকত। এক মেয়ের প্রতি সনাতনের জীবনের প্রথম
অনুরাগ! পরে, পাড়ার এক
বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিল বাবলি তাকে না-কি বলেছে—
‘ও যেন বামুন হয়ে চাঁদে হাত না-বাড়ায়’…
সত্যি, বাবলিরা খুবই বড়োলোক ছিল!
মনে পড়ছে এখন তার গালকাটা বকাদার কথা— ওয়াগন ব্রেকিং-এ বকাদাকে হেল্প করার জন্য তিন হাজার টাকা
পেয়েছিল। ওই দিনেই মায়ের গলব্লাডার অপারেশন হয়েছিল… চোলাই
খেয়ে খেয়ে বকাদা ওই গতবছর সিরোসিস অফ লিভার-এ মারা গেল।
গুন্ডা-মাফিয়া হলেও বকাদা এমনিতে খুব বড়ো মনের মানুষ ছিল।
সনাতনকে খুব ভালোবাসত।
কিন্তু সনাতনের সবচাইতে বেশি মনে পড়ে— বিশ্বকর্মা পুজোর কথা! বাবা কখন মারা
গেছে। মা
আয়ার কাজ করত। পুজোর হপ্তাখানেক আগেই লাটাই আর ঘুড়ি কেনার পয়সা দিত সনাতনকে। ও আর
মনসুরের ছেলে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছাদে বাঁশের খুঁটিতে সুতো বেঁধে মাঞ্জা দিত। তারপর উৎসবের দিন আসত। ছাদের আকাশ ভরে যেত
কত রঙের ঘুড়িতে; ঘুড়িগুলোকে মনে হতো স্বপ্ন— যেন পাখির মতো ডানা মেলে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। সনাতনের তখন মনে হতো সে
যদি ও’রম ঘুড়ি হতে পারত!...
সনাতন এখন মহাকাশের দিকে আরও একটু উঁচুতে ওঠার চেষ্টা করছে।
নাহ্, সে পারছে না; কিছুতেই পারছে না। তার প্রসারিত ডানার বিশালতায় অন্ধকারের
বাতাস কাটিয়ে যতই সে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা চালাক না-কেন তার মনে হয় অদৃশ্য কোনও হাত তার পা-দু’টো ধরে তাকে নীচে নামাতে চাইছে; অথবা, এমনটাও মনে হতে পারে, স্মৃতির মায়াদের
মাধ্যাকর্ষণের টান তাকে আবার পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করাতে বাধ্য করছে। কিন্তু সে তো ঠিক করেই নিয়েছে পৃথিবীতে সে
আর ফিরে আসতে চায় না। তাই সে এখন পার্থিব আর অপার্থিবের মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে…
ডানাওয়ালা সনাতনের মনে হচ্ছে— সে যেন এক অন্ধকার কৃষ্ণগহ্বরের টানে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাস্তবত
এখন সে মহানগরের মহাকাশ ছোঁয়া বিশাল বিশাল বহুতলের প্রেতাত্মাদের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে—
এর’মটা তার আপাতভাবে মনে হলেও বহুতলগুলোকে
যাদের তার মৃত বলে মনে হয়েছিল আদবে তা কিন্তু নয়। অন্ধকারের মহাসাগরের মাঝে সে আলোর মর্মর অস্তিত্ব
টের পাচ্ছে; টির পাশে যেন তারই মতো মানুষগুলোর মর্মর অস্তিত্ব।…
তাইতো সনাতন এখন যে আকাশছোঁয়া বহুতলের পাশ দিয়ে উড়ে
চলেছে তা বেশ বুঝতে পারছে-- প্রতিটা তলে
কালো কাচের দরজা; সেই দরজা ভেদ করে আসে পাতলা আলোর রোশনাই;
আর তাতেই ফুটে ওঠে মার্বেলের মেঝ, মাঝে ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের মতো বাগান
পেরিয়ে গ্র্যান্ড বলরুম, একাধিক ডাইনিং রুম— হঠাৎই তার নজরে
এল একটা রুমের মধ্যে শুধুই বরফ পড়ছে… কিন্তু সনাতন কোনো
মানুষকেই দেখতে পাচ্ছে না, অথচ ভেতর থেকে চাপা হৈ-হট্টগোলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে! তাহলে এরা কী সবাই মৃত মানুষ? প্রেতাত্মা?— কোনও
অস্তিত্ব নেই, অথচ আছে বলেই ধরে নিতে হবে! ঠিক তখনই, ভেতর থেকে ছায়া-ছায়া মতো এক জীবন্ত
মানুষ বাইরের বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়— তখন সে দেখে শহরের
সীমাহীন অন্ধকারের মাঝে ডানাওয়ালা এক বিশাল কালো পাখি নিঃশব্দে শহরের আকাশে ভেসে
বেড়াচ্ছে।
হ্যাঁ— ভেসেই চলে
সনাতন, বাতাসের স্বপক্ষে, কিংবা বাতাসের বিরুদ্ধেও হতে পারে… মাধ্যাকর্ষণের টান যতই সে অনুভব করুক, তবু সে আজ মুক্ত, স্বাধীন— তার অতীতের পঁয়তাল্লিশটা বসন্ত কেটে
যাওয়ার মধ্যে কোনদিনও নিজেকে এত স্বাধীন চাপহীন ভারমুক্ত বলে মনে হয়নি।
সনাতন এখন যে-জানালার পাশ বরাবর উড়ে চলে যাচ্ছে, তার চোখ হঠাৎই
চলে যায় জানালার কাচ ভেদ করে— মহানগরীর শরীর জুড়ে যতটাই
অতিমারীর জ্বর, এই বহুতলের ভেতরে ঠিক ততটাই যৌনতার উত্তাপ— পারিবারিক
যুথবদ্ধ যৌনতা— বয়স্ক থেকে তরুণ, সাতজন নারী-পুরুষের যুথবদ্ধ যৌনলীলা!...
টানা বিশ
বছরের দুই প্রান্ত সীমা
সনাতনের শরীর শিথিল হয়ে পড়ে, আর তাই জন্যই সে ডানাটাকে আরও টানটান করে নিজেকে ধরে রাখতে
চায়, আর দক্ষিণের হু-হু করা বাতাস তার বুকের ওপর আছড়ে পরে; কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সে তার লক্ষ্যে অবিচল থাকে, কারণ পৃথিবীর এই মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে অসীম শূন্যতার সমুদ্র পেরিয়ে তাকে
এমন এক স্বপ্নের গ্রহে পৌঁছতে হবে যেখানে স্বর্গসুখের অনন্ত জীবন পাওয়া যাবে। যদিও এখন তার এই মুহূর্তটায় বুকের ভেতরটা
ভাঙচুর হতে থাকে। তার মনে পড়ে যায় নিজের
প্রেম জীবনের কথা— যে-মেয়েটাকে সে ভালোবাসতে চেয়েছিল সে ছিল তার থেকে আর্থিক-মর্যাদায় অনেক ওপরে। তার গায়ের রং ছিল ফর্সা— দেখতে
ছিল সিনেমার নায়িকাদের মতো; সনাতনদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে কলেজে যেত।
যদিও সনাতন তার ঘরের আর্থিক অনটনের জন্য, অথবা পড়াশোনাতে খারাপ থাকার জন্য ভালো
না-লাগার কারণে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। সে তখন ক্লাস নাইনের
ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করেছিল। এর আগেও সে নীচের ক্লাসে দু’-তিনবার অকৃতকার্য হয়েছিল। নাইনে ফেল করাতে ওই ঘোর দুর্দিনে মনসুরের ছেলে রীতিমতো
পাশে ছিল— গাইড অ্যান্ড ফিলোসফারের ভূমিকায়, বলেছিল—
সনা, পড়াশোনা শিখে কী বাল ছিঁড়বি, তারচেয়ে কাম ধান্দা দ্যাখ। এই দ্যাখ না, আব্বা
মারা যেতে আমি এখন ওর রিসক চালাচ্ছি, পার
ডে হেব্বি ইনকাম...।’ এরপর সনাতন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল শহরের এক সিনেমাহলের এক
ডাকাবুকো ব্ল্যাকার। তখন মোবাইলের যুগ নয়, হিন্দি সিনেমার
বোম্বাইয়া সুপারস্টারদের ছবি সিঙ্গল-স্ক্রিন হলগুলোতে
দাপিয়ে চলছে— ব্ল্যাকার সনাতনের পকেট তখন বেশ গরম। মেয়েদের
রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে মোগলাই খাওয়ানোর ক্ষমতা তখন সে রাখে। প্রায় ছ’ফুট পাতলা শরীরে লম্বা মুখ আর গায়ের বাদামি চামড়ায় বেশ চেকনাই ছিল। ওই
সিনেমা হল এলাকার সনাতনের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘অমিতাভ বচ্চন’। আবার কেউ কেউ বলত ‘ব্ল্যাকার অমিতাভ’। কেউ-বা আবার আরও স্মার্ট উচ্চারণ করত— ‘ব্ল্যাক অমিতাভ’। কান-ঢাকা চুল ছিল সিনেমার অমিতাভ বচ্চনের মতো।
শুধু সনাতনের বন্ধুরা নয়, পাড়ার ভদ্রসমাজও জানত লাফাঙ্গা
সনাটা ওই বড়োলোক বাড়ির মেয়েটার পেছনে ঘুরঘুর করে— ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর
চেষ্টা আর কি!’…যদিও টুসু ও সনাতনের মধ্যে কে যে প্রথম কাকে
প্রেম নিবেদনের প্রস্তাব করেছিল তা আজও রহস্যময়। পাড়ার অন্যান্য ছেলেছোকরারা যারা সুন্দরী
টুসুর সাথে প্রেম করার জন্য দিনে আর রাতে স্বপ্ন দেখত, অথবা পাড়ার উঠতি দাদারা,
বলাবলি করত— টুসুকে তো আর পয়সা দিয়ে
সিনেমা দেখতে হয় না, বোম্বাইয়ের হিরোরা টুসুর মাথাটি বেশ ভালোই খেয়েছে!
সে-যাইহোক, লেখাপড়ায় আর বেশি কিছু হবে না ভেবে সুন্দরী টুসুর বি.এ-তে ফেল করার পর-পরই বাবা-মা
মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে ফেলে।
যদিও এ-ব্যাপারে
টুসুর নিজস্ব মতামত কী— সে-ব্যাপারে
কেউই কিছু জানতে পারে না, এমনকি ওর বন্ধুরাও না। তবে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে টুসু
ওর বন্ধুকে দিয়ে ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠিয়েছিল সনাতনের কাছে। সনাতন সেটা খুলে দেখেছিল— তাতে তেমন কিছুই লেখা নেই; ‘লেখা ছিল
পাঁচটা মাত্র শব্দ: আজ ভূতের গলিতে। সন্ধ্যে সাতটা।’
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মহানগরীর এই ভূতের গলিতে যেন তখন থেকেই
মাঝরাত শুরু হয়। গুলির একটু আগে খাল; দু’পাড়ে সারিবদ্ধ গাছ থাকার কারণে ও-ধারটা দেখা যায় না। খালের ওধারের রাস্তাটা পশ্চিমে সামান্য
বাঁক নিয়ে শেষ— তারই মুখে রায়চৌধুরীদের
মজে যাওয়া পুকুর। পুকুরের পাড়ে বসার শানবাঁধানো মলিন বেদিগুলো আজও প্রাচীন
অভিজাত ও ঔদ্ধত্যের প্রতীক। এ-সময়ের
প্রেমিকযুগল দু’-একজন প্রায় রোজই এখানে আসে একটু নির্জনতা
উপভোগ করার জন্য। পুকুরটাকে ডানদিকে ফেলে বাঁদিকে উপনিবেশ সময়ের প্রায় গা-লাগোয়া দু’টো বাড়ির ভগ্নস্তূপ। স্থানীয় মানুষদের মুখে শোনা কথা অনুযায়ী—
এই দুই বাড়ি আসলে এখানকার তৎকালীন জমিদার রায়চৌধুরীর দুই রক্ষিতার। উনবিংশ শতকের এই দুই বাড়ি আজ জরাজীর্ণ
ভগ্নপ্রায় অবস্থা। পুকুরের বাঁ-পাড় দিয়ে
আড়াআড়িভাবে এক সংকীর্ণ গলিপথ এই দুই বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গিয়ে খালের ধারে
গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সংকীর্ণ রাস্তাটাকেই বলে ‘ভুতের গলি’। পুকুরের বাঁদিক থেকে শুরু করে দুই ভগ্ন
জমিদার বাড়ির মধ্যে দিয়ে পুরো এলাকাটা বিশালদেহী প্রাচীন বট ও অশ্বত্থের নীচে
ঢাকা পড়ে আছে। কেন এই গলিটাকে ‘ভুতের গলি' বলা
হয় তা কারোরই সঠিক জানা নেই। এই ভূতের গলির মধ্যে যে প্রাচীন ভগ্ন স্থাপত্য রয়েছে, এবং তাদের ঘিরে বট ও অশ্বত্থ বহুকাল ধরে তাদের বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে—
তার কারণে দিনের আলো যেমন এখানে প্রবেশ করতে পারে না, রাতের জ্যোৎস্নাও এখানের এই অন্ধকারকে যেন স্পর্শ করতে পারে না। এই গলিতে
মাঝেমধ্যে যেমন গুমখুন হয়, তেমনি প্রেমিক-প্রেমিকারাও পরস্পরের দেহস্পর্শের
সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায় না। কেউ কেউ আবার প্রেতাত্মাদের দেখেছে, যাদের দেখতে
ছায়ার মতো। নিশাচর, বিড়াল আর সারমেয়দের এই গলি তাদের কাছে
স্বর্গ। আর,
তাই জন্যই হয়তো এই গলির নাম ‘ভুতের গলি’।
সনাতন এই গলিতেই এসেছিল। নির্জন অন্ধকার পুকুরপাড় পেরিয়ে ভুতের গলির মুখে আসতেই
গলির মাঝবরাবর সে এক নারী ও পুরুষের আবছায়া টের পায়; অথচ স্পষ্ট… কিন্তু টুসু কোথায়? সনাতন অন্ধকারের আলোয় ঘড়ি দেখার চেষ্টা করে। সাতটা থেকে অপেক্ষা করেও প্রায় চল্লিশ
মিনিট হয়ে গেছে!— তবে? সনাতন ভেতরে ভেতরে ভীষণই অধৈর্য হয়ে ওঠে; আর তখনই এক চাপা ফিসফিসানির
ডাক আসে, যেন মনে হয় বহু দূর থেকে তার নাম ধরে কেউ ডাকছে—
‘এই সনা এদিকে এসো! এসো এদিকে, আমিঃ এখানেই…’
এ তো নারীকন্ঠের হাতছানি! কিন্তু এই কণ্ঠস্বর একেবারে টুসুর মতো! তবে? সনাতন
কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়! তবুও সে সাহস করে উপস্থিত হয়
ওই যুগলবন্দির কাছে… দ্যাখে— দু’জনেই নগ্ন আর যৌনক্রিয়ায় মত্ত; যদিও তাদের শরীরে হাড়-মাংসের কোনো কিছুই আর উপলব্ধ হয় না! ছায়া ছায়া!... সমস্তটাই ছায়ার অবয়ব!
নারীকণ্ঠ এবার বলে উঠল, যেন আবারও ওই দূর থেকে ভেসে আসা
শব্দের মতো: আমাকে চাও! হা হা হা… তুমি তো একটা টিকিট ব্ল্যাকার। তোমার মতো মাথামোটা অশিক্ষিত ছেলের সাহস
হয় কি করে যে আমার মতোন একজন বড়োলোক বাড়ির মেয়েকে ভোগ করার? তোমার মতো গরিব লাফাঙ্গাদের জীবনে তো একটাই স্বপ্ন— সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখতে মেয়েদের সাথে প্রেম করার। বিনা-পয়সায় সিনেমা দেখব বলে ক’বছর তোমাকে নিয়ে একটু
খেলছিলাম মাত্র… তোকে এটা জানানোর জন্যই ডেকেছিলাম— যা গিয়ে নিজের ছেঁড়া বিছানায় গিয়ে স্বপ্ন দ্যাখ, আর…— বলতে বলতে টুসুর নগ্ন ছায়ামূর্তিটা পুরুষ ছায়ামূর্তির সঙ্গে এগিয়ে যায়…
যদিও অতর্কিত আক্রমণে সনাতন কেমন যেন হতবাক, দিকভ্রান্ত; কিন্তু, তবুও সে সাহসে ভর করে ওই ছায়ামূর্তি দু’টোর
পেছনে পেছনে ধাওয়া করে… ভূতের গলির শেষ প্রান্তে
ছায়ামূর্তি দু’টো এগিয়ে যায়— গলি পেরিয়ে তারা
খালপাড়ের জমিতে আসে, তারপর শূন্যে উঠতে থাকে, আর, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে খালের ওপরে মাঝবরাবর এসে মিলিয়ে যায়— ঠিক তখনই সনাতন ভীষণ ভয় পায়, তখনই সে বুঝতে পারে চারপাশ থেকে যেন আচমকা
এক ভয়ের মহামারী তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইছে, আর তা জীবনে এই প্রথম—
কোনোরকমে সে পেছনে ঘোরে, তারপর দিশেহারা, দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করতে থাকে… প্রাণপণে
ছোটে সে; ডাকাবুকো ব্ল্যাকার সনাতন জীবনে কোনোদিন এত ভয় পায়নি, ভয় করেনি কারোকেই। কিন্তু এই ভয়ের মহামারীতে সনাতন অসম্ভব লড়াই
চালিয়ে ছিল এই ভয়ের বিরুদ্ধে। এরপর, ধীরে ধীরে
তার জীবন এসে পৌঁছেছিল ভয়ে শূন্যতায়, যা সে পার হয়েছিল পাহাড়ের
চড়াই-উতরাইয়ের মতো। যদিও সনাতনের এই প্রথম ভয়ের প্রায় কুড়ি বছর পর, আবারও সে এক ভয়ঙ্কর ভয় পাবে, আর তা থেকে প্রথম ভয়ের
মতো আবারও সে মুক্তির উপায় খুঁজবে।
কিন্তু এখন সে দৌড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর জোরে— এই পৃথিবীতে তার যেন আর পা রাখতে ইচ্ছে করছে না; মনে হচ্ছে—
এই সময় উড়ান দিতে পারলে খুব তাড়াতাড়িই সে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে
যেতে পারবে। কিন্তু মর্ত্যের প্রবল আকর্ষণে কিছুতেই সে তা করে উঠতে পারেনি। কিন্তু
সে চেষ্টা চালিয়েই গিয়েছিল; চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল কীভাবে
এই ভয় বা দুঃখের অতিমারী থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়; তার জন্য
কী না করেনি সে: সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক ছেড়েছে, কিছু
সামান্য তন্ত্রচর্চা করেছে, পুরুষ যৌনকর্মী হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেছে, এমনকি
মেয়ে সাপ্লাইয়ের দালালিও করেছে, রাজনৈতিক দলের হয়ে ভোটে গুন্ডাগিরি করেছে, এরপর
বেশ কিছুটা লোন করতে হয়েছে— যার জন্য সেই মুরগির ব্যবসা
খুলে বসতে পেরেছে। আর, এসবই করতে করতে তাকে দীর্ঘ বিশ বছর
অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল শূন্যে উড়ান দিতে।
কাহিনির শেষ অধ্যায়
সনাতন উড়ছে এখন মহাকাশের কালো আকাশে; এখন সে কালো ডানা মেলে বাতাস কেটে কেটে উড়ান দিচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছে তার এই নিঃশব্দ উড়ান
রাতের শহর ধীরে ধীরে টের পেতে চলেছে। কারণ কানাগলির কুকুরগুলো ততক্ষণে ভয়ঙ্কর কান্না জুড়ে
দিয়েছে, আর এই কান্না ছিল শহরের মানুষগুলোর কাছে অমঙ্গলজনক—
এইটা দেখতে তারা কেউ কেউ তাদের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে উপস্থিত হয়েছিল,
অথবা শহরের প্রান্তিক মানুষেরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল— তাদের
কেউ কেউ জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল ওই কুকুরগুলোর গায়ে, কারণ
কুকুরের কান্নায় তারা স্বজন হারানোর অশনিসংকেত দেখতে পেয়েছিল, আর ওই মুহূর্তগুলোতেই তারা পরখ করেছিল রাতের আকাশে এক বিশাল ডানাওয়ালা রাতপাখিকে
আকাশে ভেসে বেড়াতে— তখনই তারা আশঙ্কা করে অতিমারীর প্রকোপ
ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পাবে— প্রচুর মানুষ মারা যাবে। কিন্তু তারা সবচাইতে বেশি ভয় পেয়েছিল
বিরাট ডানাওয়ালা বিশালদেহী পাখিটার আকাশে ভাসমান ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে নীচে
নেমে আবার উপরে উঠে যাওয়ার মতো দৃশ্য দেখতে। এই প্রান্তিক মানুষদের কেউ কেউ এমনও
ভেবেছিল এ-যেন বহু প্রাচীন মহাজ্ঞানী
এক প্রাগৈতিহাসিক পাখি দুঃখ বা ধ্বংসের বার্তা নিয়ে এসেছে। তারা জানে না, এই পাখিটার মধ্যে মর্ত্যের কোনো মায়াই আর অবশিষ্ট নেই— কিন্তু মায়া তাকে ত্যাগ করতে পারছে না। তাই বারবার তাকে পৃথিবীর মাটির
কাছাকাছি চলে আসতে হচ্ছে।
কিন্তু সনাতন এইরকমটা কতবারই না করল। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের
বিপরীতে অনেকটা দূরে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে তাকে
আবার নীচে নামতে হয়েছে। কিন্তু কার জন্য সনাতনের এই বন্ধন? এই মর্ত্যে তার মা ছাড়া আপন কেউ-বা ছিল? আর, তার মা তো এই বেশ কিছুদিন আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে
গেছে! তবে কার জন্য সন্তানের এই মর্ত্যে ফিরে আসা? সে যখন
তার ডানা দু’টো দিয়ে নিঃশব্দে ওপর থেকে নীচে, অথবা নীচ থেকে
ওপরে ওঠা-নামা করছে, আর, তা করতে করতে
সে আবার এক ভয়ংকর দৃশ্যের সম্মুখীন হয়— বছর বিশ আগে সে যে
ভয় আর দুঃখের মহামারীর সম্মুখীন হয়েছিল এই যেন তারই চূড়ান্ত রূপ:
দুর্বার গতিতে সে যখন ওপর-নীচ করছিল সেই সময়ই প্রত্যক্ষ
করল এক বীভৎস যৌনাচার। পারিবারিক যুথবদ্ধ যৌনতা। আকাশছোঁয়া টাওয়ারের পাশ দিয়ে উড়তে উড়তে
সবচেয়ে ওপরের তলে দেখতে পেল এই ‘অবাস্তব’
ঘটনাটা! লক্ষ্য করল মোট বয়স্ক-তরুণ-তরুণী মোট জনা নয়-দশেক— যাদের শরীরে
একফোটাও সুতো নেই—পরিবারের সকলেই পরস্পরে কামসুখে ব্যস্ত...
যেন এক প্রগাঢ় ঈর্ষার কুয়াশায় সনাতনকে আচ্ছন্ন করে তোলে।
মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে তার— আবারও মনে পড়ে যায় কুড়ি বছর আগের দুর্ভাগ্য জীবনটা
আর কথা... সেই যে দুর্ভাগ্যের মহামারি তার জীবনে শুরু হয়েছিল মহানগরীর আজ ঐই অতিমারির সমুদ্রে মিশে যায়। টাওয়ারের
চারপাশ বরাবর এখন চার-পাঁচবার চক্কর খেয়ে আবার সে অন্যদিকে ডানা ভাসিয়ে দিল...
কিন্তু নীচের কালো রাস্তাটার ওপর হঠাৎই তার নজর পড়ল— দেখতে পেয়েছে সনাতন— যাকে
সে এতক্ষণ ধরে খুঁজে চলছিল, যার কারণে সে মর্ত্যের এই মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম করতে
পারছিল না— পড়ে আছে শান্ত সমাহিত অবস্থায়—
ধড় আর মুণ্ডু আলাদা হয়ে। সনাতন কি তাকে চিনতে পারে? তার মনে হচ্ছে বহু কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে অদৃশ্যে কে যেন তাকে জি’জ্ঞেস করে চলেছে— চিনতে পারো সনাতন?
— না।
—
ভালো করে
চেয়ে দেখো, মনে কর, কে?
ওই লাশটা ওপর দিয়ে চক্কর কাটতে কাটতে মনে করতে থাকে সনাতন… অনেক মনে করে সে… স্মৃতিরা হঠাৎই ফিরে
আসে তার কাছে— যেন বহুদূর থেকে সে গুঞ্জন শুনতে পায়; তার দুর্ভাগ্যের
মহামারির অতীত থেকে গুঞ্জনেরা তারই মতো হাওয়ায় পাক মেলে,
তারই অস্তিত্বের অতি নিকটে চলে আসে:
‘সনা সনা, তুই তাহলে কবে দিবি?’ নেশাগ্রস্ত ক্ষয়া ওর চার-পাঁচজন চেলাকে নিয়ে আসে।
-আমি এখন পারছি
না…
-‘ওসব বললে শুনছি না। তোর যেমন দরকার, আমারও তেমনি। লকডাউনে অবস্থা বাঁড়া আমারও ঢিলা। টাকাটার অনেকদিন হয়ে
গেল… পাঁচ বছর প্রায়… সুদে-আসলে অনেক
হয়ে গেল… তোমার বালের কি অসুবিধা শুনে আমার লাভ নেই….’
—বাজার নেই। অবস্থা আমারও ঢিলা।
-‘অবস্থা
খারাপ তো মাগীবাড়ি যাওয়ার পয়সা জোটে কোত্থেকে?’
-ক্ষয়া মুখ
সামলে কথা বল!
-‘হাওয়ায়
সব খবর ভাসে…’
-তোর
পার্টির হয়ে কত খেটে দিয়েছি সে হিসাবটা বল। বোমা বাঁধা, কাউকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য তখন তো সনাকেই দরকার পড়ে। ভোটে পাবলিককে
হুমকি দেওয়ার জন্য তখন তো এই সনাকেই এগিয়ে দেওয়া হয়। সেসবের এক কানাকড়িও সনা
পেল না!
-‘অ্যাইব্বাঁড়া,
ছিলাম বলে তো মুরগির ব্যবসা করে খাচ্ছিস…’— আর, বলা মাত্রই ক্ষয়ার
সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি লেগে যায় সনাতনের… ক্ষয়ার চেলারা
ক্ষয়াকে সরিয়ে নিয়ে যায়; নেশাতুর ক্ষয়া হুমকি দেয়— ‘ক্ষয়াকে
মুরগি করা! দেখবি তুই যেন মুরগি না-হয়ে যাস!...’
ক্ষয়া চলে
যায়।
আর সনাতনও
মুরগির দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। বুঝতে পারে, কুড়ি বছর আগের ভয়-আতঙ্ক আর অপমান এখন
তার জগৎ জুড়ে মহামারীর মতো ছেয়ে গেছে। শ্মশান-শান্ত রাস্তা
দিয়ে হেঁটে চলে সনাতন। একদিন, দু’দিন, তিনদিন… সনাতনের মাথা থেকে ভয়ের আতঙ্ক আর যায় না!—
আর এই সে-দিনই রাতে ফেরার সময় সে তার ঘাড়ের
কাছে নিঃশব্দে শাণিত ইস্পাতের ধারালো ধারের স্পর্শ পায়…
হ্যাঁ, উড়ুক্কু সনাতন এখন তার নিজের মাথাটাকেই আবিষ্কার করে, যাকে
দেখার জন্য সনাতন বারবার এই মর্ত্যের মাধ্যাকর্ষণের টান অনুভব করছিল…
সনাতনের এখন নিজেকে অনেক হালকা বোধ হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে নিজের লাশের ওপর থেকে মায়ারা ক্রমশ উড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছে মর্ত্যের মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে সে মহাশূন্যের অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে—আর, ক্রমশ আজন্মের পৃথিবীটা তার ক্রমশ ছোটো হচ্ছে। নিজের চোখ দিয়ে দেখছে, পড়ে আছে তার লাশ— আর, তারই লাশের মতো অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে আছে সারা মর্ত্য জুড়ে— রোগ-শোক-দুঃখ-যন্ত্রণা আর আতঙ্কের দীর্ঘস্থায়ী মহামারীতে।
সনাতন এখন মহাশূন্যের অনেক গভীরে, ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে সে— নতুন এক বাসযোগ্য পৃথিবীর সন্ধানে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন