অশোক তাঁতী – একজন সার্থক অণুগল্পকার
তীব্র গর্জনকারী সাগরের বেলাভূমিতে নীরবে কালযাপন করছি আর মাঝে মাঝেই এক একটা কালান্তক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরভূমিতে আর কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে এক একটা প্রাণ। এই ২১–এর ২১শে এপ্রিল তেমনই এক কালান্তক ঢেউ আবারও এসে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল এক অতি মৃদুভাষী, সদা হাস্যমুখ, বিনয়ী, প্রতিভাবান এক কথাশিল্পীকে। তিনি আমাদের সবার প্রিয় অশোক তাঁতী।
অশোক তাঁতীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঠিক কবে, কীভাবে হয়েছিল তা আজ মনে পড়ে না। কিন্তু এটুকু মনে আছে যে কলকাতার রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বরের লিটিল ম্যগাজিন মেলাতেই সেই প্রথম পরিচয়। আমার পত্রিকার সামান্য সম্ভার সাজিয়ে মেলায় বসতাম শুরুর দিনগুলো থেকেই। সেই সূত্রে পরিচয়ের গন্ডী বেড়ে চলল লেখক-পাঠকের সঙ্গে। দুর্গাপুর শহরের যে সমস্ত কবি লেখকের সঙ্গে পরিচয় ক্রমে ঘনিষ্ঠ হল, তাদের অন্যতম অশোক তাঁতী। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠল। অশোক তাঁতী প্রথম আমার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য অণুগল্প পাঠালেন।
তাঁর আমার পত্রিকায় লেখা প্রথম অণুগল্প ‘অলীক মানুষ’। প্রকাশিত হয়েছিল নববর্ষ ১৪১২ (এপ্রিল ২০০৫) সংখ্যায়। সেই প্রথম লেখা থেকেই অণুগল্পে তাঁর শক্তিশালী কলমের পরিচয় পেয়েছিল পাঠক। সেই সময় বাংলা লিটিল ম্যগাজিনে অণুগল্প নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছিল। চলছিল অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য, আকর–আকৃতি ইত্যাদি নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক। আমার পত্রিকা এই সময় এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল,অতি অবশ্যই এর পেছনে ছিল অনেক প্রাবন্ধিকের মননশীল লেখালেখি। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অশোক তাঁতী। ওই বছরেই আমার পত্রিকায় (আশ্বিন ১৪১২/ অক্টোবর ২০০৫ সংখ্যায়) অশোক লিখলেন এক মূল্যবান প্রবন্ধ- ‘মুহূর্ত ভাবনা ও অণুগল্পঃ একটা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা।’
এই প্রবন্ধে তিনি অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করলেন। ওই সময়ের প্রেক্ষিতে সেই আলোচনা আমাদের প্রত্যেকের মনেই অণুগল্প সন্মন্ধে এক স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হল। এই প্রবন্ধ থেকে কয়েকছত্র উল্লেখ করাটা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তিনি লিখেছিলেনঃ … “একটা মাত্র ঘটনা বা মুহূর্ত ভাবনা এবং অনুক্তের অনুরণননের ডুয়ালিটি তৈরী হলে তাকে অণুগল্প বলা যাবে… । অণুগল্পের ন্যারেটিভে থাকবে একটা মাত্র ঘটনা। অনুক্তের অনুরণন হবে ন্যারেটিভ ডিসকোর্সেরর মাধ্যমে”।
এই প্রসঙ্গ বিস্তারে ব্যাখা করতে গিয়ে অশোক, বিমান চট্টোপাধ্যায়ের একটা অণুগল্প নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি লেখেন – “বিমান চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঘের লড়াই’ গল্পটা। যে গল্পের ঘটনা একটাই, জঙ্গলের রেঞ্জার ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বাঘের লড়াই দেখতে এসে দেখেন সম্পূর্ণ এক নগ্ন মা – নিজের পরিধেয় খুলে আপ্রাণ ঢেকে নিচ্ছে উলঙ্গ সন্তানের ঝড় খাওয়া মাথা। এখানে একাধিক স্বর অনুক্ত থাকে; যেমন লজ্জা ও স্নেহের দ্বন্দ্ব, বেঁচে থাকার লড়াই, মাতৃত্ব ইত্যাদি। এই অনুক্ত স্বর পাঠকের মনে অনুরণন তুলতে থাকে। সিদ্ধান্তের নির্দিষ্টতায় তিনি পৌঁছাতে পারেন না। ফলে তার আকাঙ্ক্ষাও সম্পূর্ণ মেটে না। এইভাবে বিমানের গল্পটা সার্থক অণুগল্প হয়ে ওঠে”।
এই মূল্যবান প্রবন্ধটি লেখার পর বেশ কয়েক বছর তিনি আমার পত্রিকায় আর লেখা পাঠাননি। দীর্ঘ নয় বছর পর আবার তাঁর লেখা পাই। এবার তিনি বেশ কয়েকটা অণুগল্প পরপর লিখে যান আমার পত্রিকায়। ঘোষিত অণুগল্পের পত্রিকাটি ঋদ্ধ হতে থাকে তাঁর লেখা অণুগল্প পেয়ে। কিন্তু পাঠকের এবং সম্পাদকের চাহিদা তিনি রক্ষা করতে পারেন না। মনে হয়, পার্ফেকশনিস্ট অশোক হয়ত নিজের লেখা থেকে নিজেই সন্তুষ্টি লাভ করছিলেন না। বইমেলা বা লিটিল ম্যগাজিন মেলাতে অবশ্যই এলে দেখা করতেন। কথা হত পত্রিকা নিয়ে, লেখালেখি নিয়ে। মনে হয় ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বছর তিনেক আগের এক বইমেলাতেই। লেখা চাইতে বলেছিলেন, মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বড়ো ব্যস্ত আছি। লেখালেখির একদমই সময় করে উঠতে পারছি না। একজন সত্যিকারের দায়িত্বপরায়ণ পিতা হিসাবে নিজের প্যাশনকে দূরে সরিয়ে রেখে লেখকজীবন থেকে সাময়িকভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর ওই লেখালেখির জগত থেকে সাময়িক দূরে সরে যাওয়াটা কষ্টকর হলেও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এই সুন্দর পৃ্থিবী থেকে পরিবার-পরিজনদের ফেলে রেখে চিরতরে তাঁর না ফেরার দেশে চলে যাওয়াটা একেবারেই মেনে নিতে পারছি না। অশোক তাঁতী আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু আছে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি। আমার পত্রিকায় প্রকাশিত সব ক’টা অণুগল্পের একটা তালিকা এখানে লিপিবদ্ধ করে দিলাম। আশাকরি ভবিষ্যতে তাঁর সুহৃদেরা বা কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর লেখা অণুগল্পগুলোর একটা সংকলন প্রকাশ করে তাঁর স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন। এই ব্যাপারে যে কোনো রকম সহযোগিতা করবার জন্য আমি পাশে থাকবার অঙ্গীকারবদ্ধ রইলাম।
অল্প কথায় ‘গল্প’ পত্রিকায় প্রকাশিত অশোক তাঁতীর লেখা অণুগল্প এবং প্রবন্ধের তালিকাঃ
পত্রিকার সংখ্যা অণুগল্পের নাম
নববর্ষ ১৪১২ ( এপ্রিল ২০০৫)
অলীক মানুষ
নববর্ষ ১৪২১ (এপ্রিল ২০১৪ ) মানুষ
শরৎ ১৪২১
( অক্টোবর ২০১৪)
ঊনবিংশতিপর্ব
শরৎ ১৪২৩
(অক্টোবর ২০১৬)
কর্কটক্রান্তি
শরৎ ১৪২৪
(অক্টোবর ২০১৭) পা
নববর্ষ ১৪২৫ (এপ্রিল ২০১৮) পাহাড়ি গান
শরৎ ১৪২১
(অক্টোবর ২০০৫)
প্রবন্ধ - মুহূর্ত ভাবনা ও অণুগল্প; একটা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা
‘ঊনবিংশতিপর্ব’ গল্পটি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নববর্ষ ১৪২৮ (এপ্রিল ২০২১) সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। অণুগল্পের এই নতুন ধারার সঙ্গে অশোক তাঁতী যে কতটা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তার উদাহরণস্বরূপ তাঁর লেখা ‘মানুষ’ নামের অণুগল্পটি পরিবেশন করা হল।
মানুষ
কারখানাতে কাজ করতে গিয়ে একদিন লোকটার একটা হাত মেশিনে জড়িয়ে যায়। লোকটা অবাক হয়ে তার কাটা হাতটাকে দিন কয়েক দেখল। অচেনা লাগে, বউ বা অন্য কোনো জিনিষ ধরতে গেলে কেমন বাতাস কেটে যাচ্ছে। তারপর একদিন লোকটা কিছু লোহার রডের টুকরো, পেরেক, স্ক্রু, আঠা দিয়ে চমৎকার একটা হাত বানিয়ে নেয়।
বেশ সুবিধা। মশা কামড়ায় না, আবার কাজও হয়। লোকটার অন্য হাতটার একদিন মজার খেয়াল চাপল। সে মেশিনের মধ্যে খেলতে চাইল। নাচতে চাইল। মেশিনটা হঠাৎ চলতে শুরু করে, যত্ন করে কাঁধ থেকে কেটে নেয় তার অন্য হাতটা। লোকটা আনন্দ পায়। নরম, তালগোল পাকানো হাতের বদলে দুটো বলিষ্ঠ হাত এখন তার।
প্রত্যেকদিন নিয়ম মেনে কাজ করতে করতে লোকটার একবার খুব রাগ হয়। একঘেয়ে শব্দ। একঘেয়ে প্রোডাকশন। ঘাম,ধোঁয়া। লোকটা জোড়া পায়ে মেশিনটাকে লাথি মারে।
এরপর আর লোকটার পায়ে ব্যথা হয়নি। দুটো শক্ত পা কেমন মেঝের ওপর দিয়ে টগবগিয়ে যাচ্ছে দেখে তার বেশ ভাল লাগে। রাস্তা দিয়ে সে গটগটিয়ে হাঁটে। তার চলন এখন বেশ স্মার্ট।
তার চোখদুটোতে শুধু হালকা কৌতুহল। আগুনের ফুলকি কেমন করে ওড়ে দেখতে গিয়ে তার চোখের মধ্যে ছিটকে পড়ে দু-টুকরো আগুন। এরপর সবাই যা দেখে সেও তাই দেখে। তার বেশ সুখের অনুভূতি, সে অন্যরকম কিছু দেখতে পাচ্ছে না বলে ভালই লাগে।
তবে লোকটার তখনও প্রচন্ড জেদ। যন্ত্রের নিঃশ্বাস তার বেশ আল্হাদী লাগে। যন্ত্রটা একদিন লোকটার মাথাটাকে জড়িয়ে ধরে কেড়ে নেয় তার নিঃশ্বাস। লোকটার আরো সুবিধে হল। সবার মত একটা মাথা বানিয়ে বসিয়ে দিল তার ধড়ে। সবাই মাথা নাড়ালে লোকটা মাথা নাড়ে। সবাই ডানদিকে ঘাড় বাঁকালে ডানদিক, বাঁদিক হলে বাঁদিক।
লোকটা
সবার মত মানুষ হয়ে ওঠে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন