অশোক তাঁতী : ভিড়ের মধ্যেও সহজে চেনা
যায়
কোনোদিন ভাবতেই পারিনি যে অশোক তাঁতীর স্মরণ সংখ্যায় আমাকে লিখতে হবে। প্রায় কুড়ি বছরের আলাপ। সম্ভবত কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন টেবিলে প্রথম পরিচয়। পরিচয়ের পর সখ্যতা এবং আমার সম্পাদিত ‘ইসক্রা’ পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত লেখালিখি। দুর্গাপুরে অণুগল্পের ওপর আলোচনায় তিনি এবং অঞ্জন মজুমদারের আহ্বানে একাধিকবার গেছি। অশোক তাঁতী, অঞ্জন মজুমদার, পার্থজিৎ ভক্ত, ঋভু চট্টোপাধ্যায়, অলক্তিকা চক্রবর্তী প্রমুখের সাথে আমার রীতিমত মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রত্যেকদিন সকালে হোয়াটস অ্যাপে ‘সুপ্রভাত’ আদান প্রদান হতো তাঁর সাথে। কলকাতা বইমেলায় ইসক্রা'র টেবিলে এসে বসতেন। পত্রিকা ও সমসাময়িক ছোটগল্প ও অণুগল্প নিয়ে বহু মতবিনিময় হয়েছে আমাদের মধ্যে। অশোক তাঁতীর গল্প একদম প্রথাবহির্ভূত। ছোটগল্পে থোড় বড়ি খাড়া তিনি একদম পছন্দ করতেন না। এ নিয়ে তিনি আমার সাথে অনেক আলোচনা করতেন। তাঁর সুচিন্তিত মতামত পেয়ে খুব ভালো লাগতো।
যে কথা বলছিলাম, অশোক তাঁতী প্রথাবহির্ভূত গল্পকার। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি তাঁর নিজস্ব শৈলী ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ একটা নিজস্বতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। সে অণুগল্পই হোক বা ছোটগল্প, তাঁর প্রতিটি লেখায় মেধার ছাপ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বহু গল্পকারকে দেখেছি, কিন্তু অশোক তাঁতীকে তাঁর লেখায় ভিড়ের মধ্যেও সহজে চেনা যায়। এটা অর্জন করা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য ছিল তাঁর গভীর অনুশীলন। বাংলা সাহিত্য ছাড়াও বিদেশী সাহিত্য নিয়ে চর্চা করতেন। আমাদের পত্রিকায় বিদেশী গল্পের অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করা খুব সহজ নয়। অনুবাদ যত প্রাঞ্জল হবে তত পাঠককে আকর্ষণ করবে। আর এক্ষেত্রে অশোক তাঁতীর দক্ষতা স্বীকার করতেই হবে।
তাঁর লেখার গুণে অসংখ্য পত্র পত্রিকায় লিখেছেন। বহু সম্পাদক, বিশেষত শারদ সংখ্যায় ফোন করে তাঁর কাছে লেখা চাইতেন। সেই দলে আমিও একজন। নিজের লেখা নিয়ে খুঁতখুঁতে ছিলেন। একবার আমাকে একটা অণুগল্প মেইল করার পর ক'দিন বাদে ফোন করে বললেন, অমুক প্যারার ঐ লাইনটা বাদ দিয়ে একটা লাইন ঢোকাতে হবে। অর্থাৎ সম্পাদককে লেখা পাঠানোর পরও তিনি সেটা নিয়ে ভাবতেন। সংশোধন করতেন। খুব কম লেখকের মধ্যে এমনতর গুণ দেখা যায়। বেশিরভাগ লেখককই লেখা দিয়ে দায়মুক্ত হন। অশোক তাঁতী ছিলেন ব্যতিক্রমী।
অশোক তাঁতীর লেখক সত্বার বাইরে তিনি মানুষ হিসেবেও স্বতন্ত্র। খুব ধীরে ধীরে কথা বলতেন। তাঁকে কখনো রাগতে দেখিনি। কিংবা রূঢ়ভাবে কাউকে কিছু বলেছেন বলে চোখে পড়েনি। অসম্ভব বন্ধুবৎসল ছিলেন। সভাস্থল থেকে নিজে ড্রাইভ করে সিটিসেন্টারে বাস ধরিয়ে দিয়েছেন। এসবই তাঁর সহজাত চারিত্রিক গুণাবলী। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম কবি অলক্তিকা চক্রবর্তীর কাছ থেকে। খবরটা শুনে বহুক্ষণ থম মেরে বসেছিলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে অশোক তাঁতী আর নেই। আর তিনি কোনোদিন আমাদের পত্রিকায় লিখবেন না। তাঁর সাথে আর বইমেলায় দেখা হবে না। বাংলা ছোটগল্পে তিনি যে স্বাক্ষর রেখেছেন তা ইতিহাস মনে রাখবে। লেখক বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। অশোক তাঁতী আমাদের কাছে তাঁর সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকবেন। লিটল ম্যাগাজিন একজন প্রথাবহির্ভূত শক্তিশালী গল্পকার এবং মহৎ হৃদয়ের মানুষ হারালো। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন