মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২

অশোকতরু

 



দুর্গাপুরের সাহিত্য অশোক তাঁতী


প্রয়াত অশোক তাঁতী সাধারণের মধ্যে বিশেষ না হলে আমাদের কাছে তিনি বোধহয় স্মরণীয় হতেন না তাঁর মৌ্লিক রচনার দিকে যদি আমরা তাকাই তবে দেখব একটা গল্প সংকলন, একটা প্রবন্ধ সংকলন, তিনটে উপন্যাস এখনও যা বই আকারে প্রকাশ পায়নি, প্রচুর লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ অণুগল্প ছোটগল্প, ইংরাজীতে লেখা দুইশতাধিক হাইকুআমি জানি না তাঁর লেখালেখির এই পরিধিটুকুর মধ্যে কতটা আমরা তাঁকে আবিষ্কার করতে পারবো ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও তাঁর লেখা উপন্যাসগুলো পড়ে উঠতে  পারিনিতবে তাঁর লেখা সম্পর্কে আমার ধারণা, তিনি একেবারেই ভিন্ন ধারার লেখক লেখার ভাষায়, শব্দের বিন্যাসে, বাক্যের চলন, এমনকি ভাবনার  উল্লম্ফন সত্যি সত্যিই চমৎকৃত করে আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি মনে করি অবশ্যই তিনি আমাদের মধ্যে থাকবেন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই অশোকের লেখা উপন্যাসদ্বিতীয় জীবন’- তার থেকে একটা উদ্ধৃতি তুলে দিই-দ্বিতীয় জীবন কি একটা ভার্চুয়াল পৃথিবী? যে পৃথিবীর  বাস্তবে কোনো অস্বিত্ব নেই? অথচ বাস্তব প্রায়শই যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় এই পৃথিবীর আলো অন্ধকার আমাদের জীবনে আশা নিরাশা নিয়ে আসে বুকের মধ্যে দমবন্ধ আনন্দ বা চাপা দীর্ঘশ্বাস অথচ একে আমরা ছুঁতে পারি না স্পর্শহীন এক সম্ভাবনা তাই কি দ্বিতীয় জীবন? এই জীবনের জন্য লালায়িত হয় মানুষ? যেখানে সম্পর্কহীন সম্পর্ক, বোধহীন বোধ, অনুভূতিহীন অনুভূতি, যাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না তার প্রত্যক্ষরূপ!”

এই উপন্যাসের নায়ক অশোক, তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার জীবনের উদ্দেশ্য কী? সে উত্তর দেয়, দুটো উপন্যাস, তিনটে ছোটগল্পের বই, দুটো কবিতা আর দুটো প্রবন্ধের বই”।

মানুষ তার জীবনকে কীভাবে স্মরণীয় করে তোলে তার একটা ভাবনা খুব  সুন্দরভাবে প্রতিস্থাপন করে গেছেন অশোক তাঁর একটি প্রবন্ধে, সেই দার্শনিক উক্তিটি হল- “মানুষের জীবনের এলোমেলো অবস্থাকে গল্পে রূপান্তর করে  জীবনকে স্মরণীয় করা হয় ঘটনার এই সামাজিক রাজনৈ্তিক রূপান্তরের মাধ্যমে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ নিজেকে চেনাতে যেগল্পবলেন তা তার পারিবারিক, শিক্ষাগত বা রাজনৈতিক ইতিহাস ভবিষৎ সম্পর্কে তার আশা কল্পনা অর্থাৎ তার ব্যক্তিগত পরিচয় নির্দেশক ন্যারেটিভ এই ন্যারেটিভের অবস্থিতির জন্য মানুষকে মানুষ বলা হয় এই ন্যারেটিভ মানুষের শারীরিক মৃত্যুর পরও তাকে অমর করে রাখে যেখানে মানুষ তার কীর্তির দ্বারা প্রথমে দেবতায় পরে জ্যোতিষ্কে পরিণত হয়”।

এই সূত্রে একটা কথা এসেই যায়- ‘ঈশ্বর কখনো কবিতা পড়েন না, অথচ কোনো কোনো কবি ঈশ্বর হয়ে যান’। লেখক বড় না তাঁর সৃষ্টি বড়, এমন প্রশ্নের মুখেও মাঝেসাঝে পড়তে হয় আমাদের অশোক লিখেছেন- “কিছু গল্প আছে যেগুলো গভীরভাবে বোঝার জন্য লেখককে প্রাধান্য না দিয়ে তাঁদের গল্পকে প্রাধান্য দিলে আমরা বিষয়কে অনেক গভীরভাবে বুঝতে পারবো”। অর্থাৎ লেখা ছেড়ে নজর দেওয়া হবে পাঠ্যের বিষয়বস্তুতেতিনি এও মনে করতেন, কোনো  লেখাই একজন লেখকের পুরোপুরি নিজস্ব নয় লেখক বিভিন্ন ঘটনা, অনুষঙ্গের ঘাত প্রতিঘাতে যা জন্ম দেন তার অনেকখানিই তাঁর নিয়ন্ত্রাধীন নয়বরং পরিবেশ, পারপার্শিকতা, অবস্থান, উত্তরাধিকার ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত এমনই বোধ নিয়ে এসেছিলেন অশোক তাঁতী

ভয় হয়, যে মেধা নিয়ে অশোক আমরণ সাহিত্যচর্চা করে গেলেন তার উপযুক্ত মূল্যায়ণ হবে তো? না কি আমাদের পুর্বসূরীদের মত কালের গর্ভে তাঁর সৃষ্টি জড়বৎ চিরনিদ্রায় থেকে যাবে?

অকাল প্রয়াত অশোক তাঁতীকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই


1 টি মন্তব্য: