রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

স্বপ্না রায়

 

স্নেহের পরশ



আর সবার মতো সৌমিত্র চ্যাটার্জি আমারও খুব প্রিয় শিল্পী! তাঁর অভিনয়, তাঁর আবৃত্তি, লেখা, বিশেষ করে তাঁর কবিতার আমি গুণগ্রাহী! সাক্ষাৎ কখনো আমার পরিচয় হয়নি ২০০১ সালের আগে! তবে তাঁর কথা ও তখনকার সিনেমার  অনেক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীদের কথা ও আসা যাওয়া ছিল আমাদের বাড়িতে এবং সেটা আমার কাকার সৌজন্যে! আমার কাকা, পরিমল সরকার, সিনেমার প্রোডিউসার ছিলেন! সেই সূত্রেই উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী, কানন দেবী, ছবি বিশ্বাস ইত্যাদি স্বনামধন্য মানুষেরা এসেছেন আমাদের বাড়িতে! সৌমিত্র চ্যাটার্জি আসেননি, কিন্তু আমার কাকা তাঁকে সাম্মানিক দিচ্ছেন সে ছবি (তপন সিনহাও রয়েছেন) আমার বাড়িতে সাজানো আছে!

এবার আমার সঙ্গে চাক্ষুস আলাপের কথা! ২০০১ সালে বস্টনে যখন বঙ্গ সম্মেলন হয় তখন আমরা (আমি ও আমার বর রাহুল) এখানের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলাম! আমার ওপর ভার পড়েছিল বিশেষ অতিথিদের দেখাশোনা করার! এই কাজটা আমি সবসময়ই করি! দেশ থেকে কোনো শিল্পী আসলেই আমরা আমাদের বাড়িতে অতিথি রাখতে চাই! তাঁদের সংখ্যা ২ থেকে ১৮ জনও হয়!

সে বছর ঠিক হল দেশ থেকে যতজন শিল্পী আসবেন তাঁদের দেখাশোনা করার জন্যে, তাঁরা যে হোটেলে থাকবেন আমাদেরও সেখানেই থাকতে হবে! বিশেষ  করে সৌমিত্রদা ও উষা উত্থুপের যাতে কোনো অসুবিধে না হয়! সৌমিত্রদা ১৯ জনের দল নিয়ে এসেছিলেন! হোটেল থেকে বাড়ির দূরত্ব অনেক তাই সব গুছিয়ে নিয়েই হোটেলে গেছিলাম! মনে আছে প্রচুর কচুরি আর ল্যাংচা করে  নিয়ে গেছিলাম! কারণ আমার অভিজ্ঞতা আছে, দেশ থেকে যাঁরা আসেন তাঁদের মাঝে মাঝে দেশের খাবার হলে ভালো লাগে! ভাগ্যিস করে নিয়ে গেছিলাম! উষা  উত্থুপ নিরামিষাশী! উনি যে তিনদিন ছিলেন শুধু ওই কচুরিই খেলেন আমের আচার দিয়ে!

সৌমিত্রদা আসার আগেই নাটকের জন্যে কী কী লাগবে তার একটা লিস্ট  পাঠিয়েছিলেন! অনেক বড় লিস্ট, তার মধ্যে দোতলা বাড়ির স্টেজ আর দাবা  খেলার বোর্ড দেওয়া একটা টেবিল, এই দুটোর তলায় দাগ দেওয়া (মানে চাইই-চাই)!

প্রথমদিন যখন আলাপ হলো হোটেলে তিনি বললেন যে আমি এসব  মাইক্রোওভেন বা অন্য গ্যাজেট ব্যবহার করতে জানি না, আপনি এসে আমাকে একটু খাবার গরম করে দেবেন! বলেই ফেললাম, আমাকে তুমিই বলবেন, আপনি আমার কাকার খুব পরিচিত! আমি পরিমলদার ভাইঝি বলে তাঁর একটু সোয়াস্তিও হল! বললেন, তাহলে কিছু লাগলে তোমাকেই বলবো!

ঠিক পরেরদিনই আমি সকালে ডাইনিং রুম থেকে তাঁর ঘরে ব্রেকফাস্ট নিয়ে গেছি! তিনি জানালেন যে একটা খুব ঝামেলা হয়ে গ্যাছে! তাঁর সহশিল্পীদের একজনদের (২-৩ জন করে একটা স্যুইটে ছিলেন) রুম ফ্লাডেড! তাড়াতাড়ি গেলাম তাঁর সঙ্গে, গিয়ে আমরা দুজনেই অবাক! কার্পেট ভিজে জব জব করছে! ডিস্ ওয়াসারে কাপ-ডিসের সঙ্গে ঝাড়নটাও পরিষ্কার হবার জন্যে কেউ দিয়েছিলেন, আর সেটা পাইপে আটকে গিয়েই এই কান্ড! যাহোক মেন্টেনেন্সের লোক ডেকে সব ঠিক করা হল! ঘরও চেঞ্জ করে দেওয়া হলো! আমাকে  বললেন, "দেখো দেশে তো ডিস্ ওয়াসার নেই তাই ওদের ভুল হওয়াটা খুব দোষের নয়! তবে তোমায় দেখতে ছোটোখাটো হলেও দেখছি তুমি বেশ কাজের মেয়ে তো!"

নাটকের দিন সে এক কান্ড! আমি খুব বকুনি খেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে! কী কী লাগবে তার লিস্ট আগেই দিয়েছিলেন! আমি সাধ্যমত তা জোগাড় করেছিলাম! শুধু দাবার ছকের টেবিল কোথাও পাইনি! দোতলা বাড়ি চেয়েছিলেন, সেটাও করা হয়েছে! আমি খুব খুশিতেই ছিলাম, সবার সামনে বেশ গর্বই হচ্ছিল, এমন একজন বড়মানুষ আমাকে ডেকে এটা ওটা চাইছেন!

হঠাৎ শুনলাম তিনি গ্রিনরুম থেকে স্টেজে এসে খুব জোরে জোরে আমার নাম  ধরে ডাকছেন! কাছে গিয়ে দেখি মুখ গম্ভীর, রেগে বললেন, "চারটে বড় ফুলদানী চেয়েছিলাম, এই ফুলদানী তে কী হবে? এ তো খেলার জিনিস মনে হচ্ছে!"  (আসলে স্টেজ এতো বড় যে ওখানে সবকিছুই ছোটো মনে হবে)! তারপর আরো গলা চড়িয়ে বললেন, আমার দাবা খেলার টেবিল কই? ওটা চাইই!

আমার একটুতেই চোখে জল আসে। চুপ করে ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে আছি, চোখ ঝাপসা! শেষে উষা উত্থুপ এসে আমাকে বাঁচালেন! আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে একেবারে সৌমিত্রদার সামনে!

"আপনি মেয়েটাকে এভাবে বকতে পারলেন? ও সারাক্ষণ আমাদের জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছে আর আপনি ওকে বকতে পারছেন? ঠিক আছে আমি আপনার বড় ফুলদানী এনে দিচ্ছি!"

এই বলে আমার হাত ধরে টানতে টানতে একেবারে সেকেন্ড ফ্লোরে যেখানে কেনাবেচার সব দোকান ছিল, প্রদর্শনী হচ্ছিল! আমাকে বললেন, খুঁজে দেখ কোন দোকানে বা কোথায় বড় ফুলদানী আছে! পেলে আমায় দেখাও, আমি ওদের কাছ থেকে দু ঘন্টার জন্যে চেয়ে নেব!" সত্যিই পাওয়া গেল! দেশের শিল্পী বলাই কর্মকার এসেছিলেন, তাঁর স্টল থেকে চারটে ফুলদানী চেয়ে নিলেন! সেই ফুলদানী এনে স্টেজে সাজিয়ে দিয়ে আমি ভয়ে আর তাঁর সামনে যাইনি! এরপর টেবিলের ঝামেলা তিনি কীভাবে মিটিয়ে ছিলেন তাও জানি না!

আমার মন খারাপ লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু একটা জিনিষ শুধু সেদিন দেখে অবাক হয়েছিলাম যে, এত মানুষজন তাঁর সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও প্রতিটা ছোটো খাটো জিনিসের ওপর তাঁর কত সূক্ষ্মদৃষ্টি!

সন্মেলনের পর আরও কয়েকদিন হোটেলে তাঁরা ছিলেন। আমরা বাড়ি চলে এসেছিলাম! ফেরার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম! খুব অবাক হলেন,  "তুমি চলে যাচ্ছ? আমাদের এখানে কে দেখাশোনা করবে? "

আমি বললাম, "অনেক বঙ্গ সম্মেলন হল, এবার ল্যাবে ফিরতে হবে"! তিনি অবাক হলেন, "তুমি কাজও করো?"

আমরা তখন বাড়ি ফিরে এসেছি! একদিন অফিস থেকে ফিরে রান্না করে সেই খাবার হোটেলে পৌঁছে দিয়েছি। খুব ইচ্ছে ছিল বাড়িতে নিয়ে আসার, কিন্তু তাঁরা ১৯ জন! আমাদের ছোটো গাড়িতে ধরবে না!

ফিরে যাবার আগে যে সংস্থার আমন্ত্রণে তিনি নাটক নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সাথে কোন কারণে সৌমিত্রদার কিছুটা মনোমালিন্য হয়। আমিও ছিলাম সেখানে, যেহেতু আমিও একজন সদস্য! বেশ রাগারাগী হচ্ছিল, যা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না! আস্তে আস্তে সবার চোখ এড়িয়ে বাইরে গাড়িতে চলে আসি। সৌমিত্রদা ঠিক লক্ষ করেছিলেন! আমার খোঁজ করে গাড়িতে এসে আমায় অবাক করে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন! বারবার বললেন, "তোমাকে আমি কিছু বলিনি, তুমি মনে কষ্ট পেয়ো না!" তাঁর মতো মানুষ এভাবে বলছেন, সেটাও আমার বড় খারাপ লাগছিল! তারপর আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের 'ছোটোবড়ো' কবিতা "এখনো তো বড়ো হইনি আমি, ছোটো আছি ছেলেমানুষ বলে---" আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন! এ আমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি!

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন