রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

অদিতি ফাল্গুনী

 

পশ্চিমে গ্রিক পুরাণের ‘নিষ্ক্রিয়‘ ইউরিদিসের নতুন নারীবাদী বিশ্লেষণ




যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও নারীবাদী, তবু পশ্চিমে সম্প্রতি বিখ্যাত গ্রিক ট্র্যাজেডির দুই চরিত্র অর্ফিয়ূস ও ইউরিদিসকে নিয়ে যে নতুন নারীবাদী ব্যাখ্যা  বা বিশ্লেষণ হচ্ছে, সেটা শুরুতে আমাকে একটু আহতই করেছে। অর্ফিয়ূসের মত অমন একশোভাগ নিবেদিত এক মানুষকে নিয়েও কিনা নারীবাদী বিশ্লেষণ? যে অর্ফিয়ূসকে নিয়ে সনেট লিখেছেন স্বয়ং শেক্সপীয়র অথবা ধ্রুপদী যুগের ভার্জ্জিল থেকে রাইনার মারিয়া রিলকে হয়ে এই কিছুদিন আগের পোলিশ কবি শেজওয়া মিউয়াশ পর্যন্ত যে অর্ফিয়ূসের বন্দনা না করে পারেননি, সেই অর্ফিয়ূসকেও কিনা নারীবাদের আতশ কাচে ফেলে পরখ করতে হবে? শুরুতে খানিকটা কুঁকড়েই গেছিলাম। তবে অস্বীকার করা যাবে না গ্রিক এই বেদনাবিদ্ধ পুরাণের নতুন কিছু বিশ্লেষণ পড়ার পর থেকে চমকে গেছি পশ্চিমের নারীবাদী চিন্তকদের চিন্তা করার মৌলিকত্ব এবং সম্পূর্ণ প্রথাবিরোধী সব প্রশ্ন তোলার সাহসী ক্ষমতায়। পশ্চিমের নারীবাদী চিন্তকরা এই পুরাণের নতুন সব বিনির্মাণের কাজটি করছেন মূলত: নাটকের ক্ষেত্রে।

২০১৪ সালে স্যার আন্তোনিও পাপ্পানোর পরিচালনায় ‘অর্কেস্ট্রা দেল এ্যাকাদেমিয়া ন্যাজিওনেল দি সান্টা সিসিলিয়া‘-এর আয়োজনে এবং নামী অপেরা গায়িকা বারবারা হ্যান্নিগানের অনবদ্য সঙ্গীত পরিবেশনায় ‘লা ন্যুয়োভা ইউরিদিস সেকেন্ডো রিলকে‘ নামে যে অপেরা মঞ্চস্থ হয়, সেখানে যে ‘নতুন‘ ইউরিদিসকে দেখা যায়, তা ইউরিদিস বিষয়ক আমাদের অতীতের সব ভাবনা থেকে একদমই অন্যরকম। এই অপেরায় নির্মিত এই ‘নতুন ইউরিদিসে‘র চরিত্রটি মূলত: কবি রাইনার মারিয়া রিলকের অর্ফিয়ূস, ইউরিদিস, হার্মেস এবং টু মিউজিক নামে দু‘টো বিখ্যাত কবিতার সংশ্লেষণে সৃষ্ট। কে এই নতুন ইউরিদিস? সে কি একজন নারীবাদী?

প্রাচীন গ্রিক পুরাণের সেই অনন্য গল্পটিতে কেন ইউরিদিস চরিত্রটি এত নীরব ও নিশ্চুপ? গোটা ট্র্যাজেডিতে সাপের কামড়ে মরে যাওয়ার পর মৃত্যুভূমি পাতালরাজ্যে চলে যাওয়া ছাড়া ইউরিদিসের কোন উল্লেখই নেই। অর্ফিয়ূসই আছে সমগ্র কাব্য জুড়ে। সেই নরকের রাজ্যে ছোটা, তিন মুখো ভয়াল কুকুর সার্বেরেসকে বিষাদগীতি শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে চুপ করিয়ে দেয়া, অর্ফিয়ূস পরে কিনা গেলেন খোদ যমরাজ হেদস বা প্লুতো ও তাঁর স্ত্রী পৃথিবী বা দেমিতার কন্যা পার্সিফোনের সামনেই! অর্ফিয়ূসের বিষাদে বিশেষভাবে দু:খিত হলেন  পার্সিফোনে। নিজে পৃথিবীর মেয়ে হয়েও যাকে হেদসের হাতে অপহৃত হয়ে আসতে হয়েছে নরকে বা পাতালপুরীতে। শেষপর্যন্ত যমরাজ হেদসও গলে গেলেন। ইউরিদিস নবজীবন পাবে ঠিকই। তবে পাতাল থেকে পৃথিবীতে যাবার অন্ধকার সেই সুড়ঙ্গপথে অর্ফিয়ূসের পিছু পিছু সে যখন যাবে, আর পৃথিবীতে পা রাখার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছুতেই পিছু ফিরে তাকাতে পারবে না অর্ফিয়ূস।  তাকালেই ইউরিদিস চিরতরে হারিয়ে যাবে। আবার সে হারিয়ে যাবে পাতালপুরীতে। আর এখানেই নারীবাদীদের খটকা। অর্ফিয়ূস কি কখনোই ইউরিদিসের উপর ভরসা রাখতে পারে না? যমরাজ প্লুটোর শর্ত জেনে এবং মেনেও শেষমুহূর্তে কেন তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হলো আর এতদিনের সব পরিশ্রম ও ভালবাসায় অর্জিত সবটাই পুনরায় ‘অনর্জিত‘ হয়ে গেল? এটাই কি ‘টক্সিক ম্যাসক্যুলিনিটি‘র সেই ভয়ানক উপাদান যা ভালবাসার আত্যন্তিকতা থেকেই বারবার ভালবাসার পাত্রীকে হারিয়ে ফেলে? ইউরিদিসকে কি বড্ড বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় অর্ফিয়ূস? এক মুহূর্তের জন্য তার উপর আস্থা নেই? অর্ফিয়ূসের কি সারাক্ষণই ভয় যে হয়তো ইউরিদিস তার পিছু পিছু আসছে না? ইউরিদিস হয়তো তাকে যথেষ্ট ভালবাসছে না? আর ‘বজ্র আঁটুনী ফস্কা গেরো‘র মতই বারবারই এই অত্যধিক নিয়ন্ত্রণকামীতার কারণে ভালবাসার পাত্রীই তাই বারবার হাতছাড়া হয়ে যায়? কারণ প্রেম যে কিছু পরিসর বা ‘ব্রিদিং স্পেস‘-ও দাবি করে যেমনটা কহলীল জিব্রান বলেছেন তাঁর কবিতায়।

পশ্চিমের নারীবাদীরা তাই আজ খোদ রিলকের কবিতার চরণ বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে কোথাও কি ইউরিদিনের ভেতরেও ছিল অর্ফিয়ূসের এমন ‘পুতুলের মত নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া‘র বিরুদ্ধে কোন সুপ্ত বিদ্রোহ? নয়তো দেখুন রিলকের কবিতায় ইউরিদিস নি:শব্দ এবং তাঁর পদচারণা হচ্ছে ‘অনিশ্চিত, শান্ত এবং কোন তাড়া-হুড়ো নেই’। অর্ফিয়ূস কিনা যখন বড় বড় পা ফেলে সামনে  এগোচ্ছেন, তখন ইউরিদিসের পদক্ষেপ বড় বেশি অবিচলিত ও শান্ত। আর এতেই যেন ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটে অর্ফিয়ূসের। কেন এত নি:শব্দে বা অনিশ্চিত পায়ে তার পিছু পিছু আসছে ইউরিদিস? ইউরিদিস কি তবে আসবে না? তখনি সে অস্থির হয়ে পিছন ফিরে তাকায় এবং নিয়তি দ্বিতীয়বার তার খেলা খেলে।

কিন্তু রিলকের কবিতায় ইউরিদিস কেন এত নির্লিপ্ত? পশ্চিমের নারীবাদীরা  বলছেন যে রিলকের কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে যখন ইউরোপে দেখা দিচ্ছে ‘নতুন নারী’। নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের সময়ের সেই নারীরা চুল ছোট করে ছাঁটছে, পুরুষের মতই ট্রাউজার পরা শুরু করেছে, বাইকে উঠছে এবং নিজস্ব কর্মজীবনের লক্ষ্যে বিয়ে করতে দেরি করছে বা করছেই না কেউ কেউ। ‘লা ন্যুয়োভা ইউরিদিস সেকেন্ডো রিলকে‘ নামের অপেরায় যে নতুন ইউরিদিসকে দেখা যাচ্ছে, সে একনিষ্ঠ ভাবে অর্ফিয়ূসের পদক্ষেপ অনুসরণের বদলে বিংশ শতকের নতুন নারীর নতুন জীবন সংজ্ঞা নির্মাণে ব্যস্ত। বিয়ের বিষয়ে তার ভাবনা না শীতল না  তপ্ত। তার আছে উচ্চশিক্ষা বা কর্মজীবন সহ হাজারটা নতুন স্বপ্ন। এই ‘ইউরিদিস‘ আর অর্ফিয়ূসের হাতে উদ্ধার খোঁজা মেয়েটি নয়।

শুধু উপরোল্লিখিত অপেরা নয়, এ্যামিলিয়া আর্ল রচিত ‘মর্ডার্ণ ফেমিনিজম ইন রিরাইটস অফ দ্য অর্ফিয়ূস এ্যান্ড ইউরিদিস মিথ‘ প্রবন্ধেও দেখা যায় মার্গারেট এ্যাটউড এবং সারাহ রুহলও ‘ইউরিদিস’-এর চরিত্রটিকে নারীবাদের আতশকাচে ফেলে পরখ করেছেন। এ্যাটউড তাঁর ১৯৭৮ সালে রচিত প্রবন্ধ ‘দ্য অর্ফিয়ূস এ্যান্ড ইউরিদিস সাইকল’-এ এক নতুন ইউরিদিস চরিত্রকে দেখান যে সবটা সময়ই অর্ফিয়ূসের হাতে প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত। অর্ফিয়ূসের প্রতি গোপন বিরক্তি থেকেই কি পাতাল থেকে পৃথিবীতে ওঠার সময় অমন নিস্পৃহভাবে পিছু  হাঁটে? পশ্চিমে কোন কোন থিয়েটার গ্রুপ আবার দেখাতে চাইছেন যে পাতালরাজা হেদস যেন আসলে মোটেই কোন নিষ্ঠুর পাতাল নৃপতি নন। তিনি যেন ইউরিদিসের পিতৃপ্রতিম কোন চরিত্র। আর এদিকে অর্ফিয়ূস এসেছে দাম্পত্য জীবনের অধিকারের বার্তা নিয়ে। কিন্তু ইউরিদিস যেন বিচলিত।  পিতৃগৃহের সুখী কুমারী গৃহকোণ নাকি নতুন দাম্পত্য জীবন - কোনটি সে বেছে নেবে? তাই এই পাতালপুরী থেকে সে আসছে বটে পিছু পিছু। হেদস যেন সেই পিতা যে মেয়েকে নতুন জীবনে পাঠাতে বাধা ত’ দিতে পারে না। তবে শর্ত জুড়ে দেন। আর ইউরিদিস ত’ নিজেই নিজের কাছে পরিষ্কার নয় যে এই সুখী কুমারীর গৃহকোণ ভাল নাকি নতুন, বিবাহিত জীবন। তাই তার পদক্ষেপ এত মৃদু যা বিচলিত করে অর্ফিয়ূসকে। তাই সে পেছন ফেরে।

আবার ‘দ্য হোয়াইট লেবেল কালেক্টিভ’ নামে আর একটি নাট্যগোষ্ঠির নাটকে  শুধু হেদসের পাতালরাজ্য নয়, খোদ অর্ফিয়ূসের থ্রেস রাজ্যটিও যেন এক নিপীড়ক পুলিশী রাষ্ট্রের প্রতিভূ। সর্পাঘাতে মৃত ইউরিদিসের দেহটি যেন ‘নিষ্ক্রিয় নারীদেহ’কে নিয়ে পুরুষের পৌরুষগর্ব, জাতি-রাষ্ট্রের পৌরুষ আষ্ফালন এবং মেয়েটির এই নিয়ন্ত্রণকামীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে ‘দ্য হোয়াইট লেবেল কালেক্টিভ’-এর নাট্যনির্মিতিতে। এই নাটকে ইউরিদিসের চোখে বিয়ের  পর প্রথম মুহূর্ত থেকেই থ্রেস যেন এক নিপীড়ক, পুলিশী রাষ্ট্র যেখানে দম  নিতেও কষ্ট হয়। তাই পালাতে চায় ইউরিদিস। এই নাট্যগোষ্ঠির নাটকে যমরাজ হেদসকে বরং এক হাসি-খুশি, মনোহর চরিত্রে দেখা যায়। পাতালপুরী আদৌ ইউরিদিসের জন্য কোন অভিশপ্ত জায়গা নয়। সেটা তার পলায়নের স্থান।

তবে এক কথায় পুরাণকে কোন নির্দিষ্ট মতবাদের আতশকাচে ফেলাটাও যে সবসময় সঠিক তা নয়। সাইকো-এ্যানালিটিক বা মনো-বিশ্লেষকরা আবার অর্ফিয়ূসের শেষ মুহূর্তে পিছে ফিরে দেখাটাকে মানব চরিত্রের এক  অসংশোধনযোগ্য মৌল চারিত্র্য বলে মনে করেন। যত আমরা নিজেকে প্রবোধ দিই যে ‘আর পিছু ফিরে দেখা’ নয়, ততই আমরা যেন আরো বেশি বেশি পিছু ফিরে দেখি। এবিষয়ক কোন নিবন্ধ না হয় আবার পরে কখনো লেখা হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন