রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

প্রদোষ ভট্টাচার্য্য


 নামোপাখ্যান -১




রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প ‘গিন্নী’তে ব’লেছেন যে, যার নাম ভূতনাথ তাকে  নলিনীকান্ত বললে সে দুঃখিত হয়।

টেনিদার বলা ‘পেশোয়ার কী আমীর’ গল্পে গোবর্ধনবাবু ভেবেছিলেন যে ন’ ছেলেকে নিয়ে নবরত্ন সভা বসাবেন বাড়িতে। তাই তিন ছেলের নাম রাখেন বরাহ, ক্ষপণক,  আর ঘটকর্পর। কিন্তু এরপর আর ছেলে হয় না, খালি মেয়ের পর মেয়ে! রেগে গোবর্ধন বাবু তাদের নাম রাখতে লাগলেন ‘জ্বালামুখী’, ‘মুণ্ডমালিনী’, এইসব। এমনকি ‘খনা’ অবধি নাম রাখেননি কারুর!

বাস্তব জীবন খুব বেশী পিছিয়ে নেই!

ঘোরতর পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, কন্যাসন্তানের কথা ভাবতেই তার সদস্যরা মূর্চ্ছা যান। কিন্তু তাঁদের বিধি বাম, এলো মেয়ে। ক্ষুব্ধ ‘সাহারায়’ পরিবার অভাগীর নাম রাখলেন ‘মরীচিকা’!

এক সহকর্মীর পাড়ায় কোন প্রতিবেশীর যমজ পুত্রসন্তান হওয়াতে তিনি সেই সহকর্মীর কাছে আবেদন করলেন, “আপনি অধ্যাপক মানুষ, দুই ছেলের নামকরণ আপনিই করুন।”

এরপরের ঘটনা সহকর্মীর ভাষায়ঃ “বেশ নাম বেছেছিলাম হে, তাতে ভদ্রলোক ক্ষেপে গিয়ে আমাকে যা-নয়-তাই বলে – ‘বুদ্ধিজীবি বলে কি এরকম যাচ্ছেতাই ফাজলামি করবেন আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের সঙ্গে!’ – নিজেই দুই ছেলের নাম রাখলেন ‘আহ্লাদ’ আর ‘প্রহ্লাদ’। তা আমি কি তার চেয়ে খারাপ কিছু বলেছিলাম?”

কি নাম ঠিক করেছিলে তুমি?

“আরে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সর্বধর্ম-সমন্বয়, এইসবের কথা ভেবে ভদ্রলোককে বলেছিলাম, ‘দুই ছেলেকে ডাকুন “ইদের চাঁদ” আর “ন’দের চাঁদ” ব’লে!

সেই একই সহকর্মীর কাছে বীমা-সংক্রান্ত কাজকর্মের জন্যে আসতেন এক তরুণী। একদিন মহিলা সোৎসাহে সহকর্মীকে জানালেন, “স্যার, আগামী মাসে বিয়ে করছি!”

“বাঃ, বাঃ, খুব ভালো খবর!”

“আমি কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্যার।”

“কি সিদ্ধান্ত?”

“স্যার, বিয়ের পর পৈতৃক পদবী ছাড়ছি না। ওটাও থাকবে, তারপর ওরটা জুড়ে দেব। যেমন বৌদিরা অনেকেই করেন।”

আবার সহকর্মীর নিজের কথায়ঃ “চরম আতঙ্কের সঙ্গে প্রায় হাতজোড় ক’রে ব’লে উঠলাম, ‘মা, নিজের ক্ষেত্রে এটা নাই বা করলে!’ সে মেয়ে তো ক্ষেপে কাঁই! ‘কেন, কেন? আপনাদের মতো উচ্চবর্গের নই ব’লে এইটুকু স্ত্রী-স্বাধীনতাও আমাদের থাকবে না? ওসব কি আপনাদের একচেটিয়া? যা ঠিক করেছি, তাইই করব, এই ব’লে দিলুম, হ্যাঁ!’”

তা তুমিই বা আপত্তি করতে গেলে কেন? সত্যিই তো, কত মেয়েই তো এমন করে!

“আরে, দূর! করে ঠিকই, কিন্তু তাই ব’লে পদবীগুলো নিয়ে একটু ভাববে না! জুড়ে দিলেই হ’লো! মেয়েটির নাম যে ‘কল্পনা পোত’!”

আর তার হবু বরের পদবী?

“ঘোরাই!”

এতো গেল শোনা ঘটনা। এবার নিজের অভিজ্ঞতার কথায় আসি।

এম-এ পড়তে-পড়তেই এক স্নেহভাজন ছাত্রী জানালেন যে তিনি জীবনসাথী নির্বাচন ক’রে ফেলেছেন।

বেশ কথা। ছেলেটির নাম?

“স্যার ‘পথিকৃৎ পণ্ডিত’!”

বটে! তা এবার থেকে তোমার পদবীর ব্যাসবাক্য যে পাল্টে গেল!

“কি রকম স্যার?”

‘সান্যাল’ হইবে যে ‘পণ্ডিত’!

বিয়ের ঠিক পরেই শ্রীমতীর বাপের বাড়ি গেছি, তার আমন্ত্রণে। সে কি গোলকধাঁধা!  ছাত্রী গর্বের সঙ্গে একটু দূরে আঙুল দেখিয়ে ব’লে, “জানেন, ওইখানেই সত্যজিৎ রায় ‘সমাপ্তি’র শুটিং ক’রেছিলেন! আর ঠিক ওখানটায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চটিটা কাদায় ডুবে গিয়েছিল!”

বাপরে! যাক, এবার এখান থেকে বাড়ি ফিরবো কি ক’রে ব’লে দাও! নইলে ঘুরে ঘুরে হারিয়ে যাব!

“সে আর এমন কি কথা? পথিকৃতই তো কতবার এখানে আসতে গিয়ে হারিয়ে গেছে!”

তাহ’লে সে হয় ‘পথভোলা পথিকৃৎ’ নয় তো ‘পথভ্রষ্ট পণ্ডিত’!

পরে উক্ত ছাত্রীর এক সহপাঠিনীর এক উক্তিঃ “আপনাকে স্রেফ গুলি ক’রে মারা উচিৎ! মেয়েটা যে শেষ অবধি বিয়েটা ক’রতে পার’লো আপনার এইসব বদ-রসিকতা সত্ত্বেও, তাতে ওর সাহসই প্রকাশ পায়! আমি হ’লে আপনার কাছ থেকে  অনেক দূরে পালিয়ে বিয়ে করতাম! সম্ভবত ব্রিটেনের গ্রেটনা গ্রীনে!”

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন