কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৩ |
তালকাঠের মূর্ধা
অনতিক্রম প্রান্তর। যতদূর চোখ যায় সিঁড়ির মত শুখা জমির উপর গাছের গুঁড়িপোড়া কালো কালো ছোপ। আছে কয়েকটা ন্যাড়া পোড়া মৃত তালগাছের স্তম্ভ। কালবোশেখের সময় ফাঁকা জমিতে নির্বাধ প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বিদ্যুত্ খেলে বেড়ায়। তখন ওই তালস্তম্ভগুলি দিয়ে চিড়চিড় করে বিজলি নামে।
ধরিত্রী যে বিপুল বিদ্যুতাধার! আগে যখন সারি সারি তালগাছের বন ছিল তখন মানুষজনের ছিল নির্ভয় বাস। এখন ফাঁকামাঠ বজ্রপাতের ভয়ে সুনসান। তখন তালবনের মাঝে গ্রামের হাট বসতো, মুন্ডমালা হাট। মাটির হাঁড়িতে তাড়ি, কখনো তালশাঁস, পাকাতাল। আর থাকতো তালপাতার পাখা, কুলো চাটাই বাহারি সাজ এবং ঘর ছাওয়ার নানা উপকরণ। মরা হাতি আর মরা তালগাছ দুইই লাখ টাকার। তখন প্রতি হপ্তায় থাকতো পাইকারিদের ভিড়। এখন পশুপাখিও নেই। বছরকয়েক আগে মেহেরপুর চাঁদপুর থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে গোড়াশুদ্ধু গাছ কেটে নিয়ে গেছে তালকোন্দা বানিয়ে ব্যবসা করবে বলে। তালকোন্দা ডিঙির চেয়েও জলে বেশি তীব্র।
বহুদিন বাঁঝা হয়ে ছিল মাঠ। আবার লোকজন আসতে শুরু হলো। সার্ভেয়ার খনিতত্ত্ববিদ এম এল এ ধনী ব্যবসায়ী। দামী দামী গাড়ি, মাপজোক। এবং একটা অস্থায়ী কুঁড়েঘর ও জমির রক্ষক। সে স্থানীয় বাসিন্দা দামোদর মহতো। অচিরেই মাটির নিচ থেকে বেরোবে অতি সুপরিবাহী আকরিক তামা।
এককালে তালকাঠের সাঙা (কড়িকাঠ), ভাগটান, বাটাম ও ছালা তৈরির শিল্পী ছিল দামোদর। চালাঘরের কাঠামো বানাতে সারাজীবন তালকাঠ ছাড়া আর কিছু চিনল না। কোন কাঠ কত পুরনো, বাজ টেনেছে কি না, কতদিন ধরে কত হাঁড়ি রস বানিয়েছে, কত ঝড় সয়েছে, এমনকি সংলগ্ন মাটি শুকনো না ভেজা সেও বলে দিতে পারতো। কিন্তু পঞ্চাশ ফুটের ঢ্যাঙা গাছ বাদে মানুষ চিনতে পারেনি সে। দুটো জিনিষে ভয় ও ঘেন্না। ধনী মানুষের সহানুভূতি আর বাজপোড়া তালকাঠ।
দুইই ধোঁকাবাজ। এখন দুটিই তার অভাগা কপালে জুটল। কাকে দিয়ে যে এই ঘুপচি চালাঘরের মূর্ধাসাঙা ভাগটান বানিয়েছে, স্পষ্ট দেখা যায় ওই কড়িকাঠ বেশ কয়েকবার বাজ খাওয়া। এই ঘরে থেকেই দিনরাত দামোদরকে জমি পাহারা দেবার কাজ করতে হবে? হে ভগবান!
আজ জমির ভিত পূজো। দামিগাড়ি। বিরাট মঞ্চ। খননমন্ত্রী, সার্ভেয়ার, অঞ্চলপ্রধান, খনিবিশেষজ্ঞ, স্বপার্টি, বিরোধী পার্টি আরও অনেকজন। রাতভর পার্টি, মদের ফোয়ারা। বড়লোকেরা মেয়েছেলে নিয়ে বাজপোড়া গাছের নিচে উদোম। চক্ষুলজ্জ্বায় ছোটোলোক দামোদর ঝুগ্গির ভেতরে। ভেতর বাহির অস্বস্তি। দামোদরের কাছে ঝোপড়ির ভিতরে থাকাই ঠিক লাগলো। বৈশাখী আকাশে ধুলোমেঘ। অস্পষ্ট গুম গুম শব্দ। আসছে বিদ্যুত্ ঝড়বৃষ্টি। ভাঙ্গুক মূর্ধা। যাই হয়ে যাক, মরি মরবো তবু ওই ন্যাংটামো দেখবো না। আজ কোনমতেই বাইরে বেরবো না।
বাইরে অশ্লীল চিত্কার ও উন্মত্ত মিউজিক ছাপিয়ে এবার কানফাটা বজ্রের শব্দ। সারারাত ধরে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুত্ খেলে বেড়াতে লাগলো ফাঁকা মাঠে। দামোদর সেইযে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল ঘরের ভিতর, চোখ খুলল ভোরে। বাইরে বেরিয়ে দেখল মাঠ যেন মৃতপুরী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিদ্যুত্পৃষ্ট শব। দামোদর ঘরের ভিতরে ঢুকে কড়িকাঠকে প্রণাম করল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন