কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৩ |
শূন্যপুর ১১
সাইকেল নিয়ে সবে বেরোতে যাচ্ছিল অনঙ্গ। বৌটা হাওয়া দিচ্ছে উনুনে। উনুন জ্বললে চা জুটবে। আজকাল সামলে উঠতে পারে না খোকা আর শাউড়ি সামলে। তেতেপুড়ে ফিরে অনঙ্গ প্রথমে জল ঢেলে নেয় জাগ থেকে গলায় খানিক। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে চা-মুড়ির জন্য হা-পিত্যেশ। বারান্দায় হিসি করে সুলতা। বৌ যন্ত্রচালিতের মতো খ্যাংরা ঝাঁটা আর বালতি নিয়ে আসে। বাপকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে মা বারান্দা আশ্রয় করল। নড়েচড়ে না। উঠোন বলতে কিছু নেই এ বাড়ির। বারান্দার পর বেড়া, বেড়ার ওপারে কাঁচা সড়ক। ঘর আর বাহিরের মাঝে চার বাই দশ বারান্দায় তিন মাস বেওয়ারিশ পড়ে আছে সুলতা।
সাইকেল
নিয়ে চায়ের দোকানের দিকেই যাচ্ছিল অনঙ্গ। আজ বৌ যুত করতে পারবে বলে মনে হয় না। দরজার
মুখে বিশুয়া। মোড়ের চা দোকানে গেলাস ধোয়। হেসে ফেলে অনঙ্গ। 'তগ দুকানেই…'
বিশুয়ার
চোখে ভয়। 'পুলিস। তুমার বাবার নাম করসে।'
বিশুয়ার
পিছন পিছন ঢোকে উর্দি। বৌয়ের হাত থেকে পাখা পড়ে যায়। সুলতা ফ্যালফেলিয়ে চায়।
এ বাবুকে চেনে না অনঙ্গ। তখন অন্য বাবু ছিল, যখন বাবারে নিয়ে গেল। বিদেশী, বাংলাদেশী — বারবার বলছিল সে বাবু। বাবাও নাছোড়ের মতো আওড়াচ্ছিল বাপ-ঠাকুদ্দার নাম। কাগজপত্র দেখিয়ে বোঝাতে চাইছিল চার পুরুষের বাস। বাবাকে হিঁচড়ে তুলল গাড়িতে। মা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করেছিল। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতে সেই যে চুপ মারল, আর কথা কইল কই? ঘর আর বাইরের মাঝে বারান্দাটায় এমনভাবে ঝুলে থাকল সুলতা, যেমন ভারত-বাংলাদেশের মাঝের নোম্যান্সল্যান্ডে ঝুলে আছে তার বর।
এ আনকোরা বাবু ছিল না সেদিন। এর মুখচোখ নরমপানা। ইতস্তত করছে। অতুল দাসের ছেলে অনঙ্গ দাস এগিয়ে আসতে বাবু চোখ নামাল। যেন ক্লান্তি, যেন দায়ভার। কেটে কেটে বলল।
'মারা
গেছেন। ভোরে। ক্যাম্পে। স্যাড। থানা খবর পেল দুপুর নাগাদ। বডি আসবে। কাল। সৎকার করতে
পারেন।'
বৌয়ের
কোলে খোকা কেঁদে উঠল। বুঝে, নাকি না-বুঝে, কে জানে? বড় হলে কি মনে পড়বে ঠাকুদ্দাকে?
অনঙ্গ গোঙায়। বৌ কঁকিয়ে ওঠে। শুধু সুলতা ফ্যালফেলায়, তখনও।
বাবুর
অস্বস্তি হয়। গোঙানি কি আসলেই কান্না, নাকি ক্রোধ? উন্মাদিনীর চোখে চোখ পড়তে কেঁপে
ওঠে সে। কষ্ট নেই। রাগও না। চোখ ক্রূর কৌতুকে হাসে কি? উন্মাদিনী উঠে দাঁড়ায়। 'তগ বাংলাদেশীরে
পোড়াইব ক্যান্? বাংলাদ্যাশ পাঠায় দে। বাংলাদেশীরে পুড়াইসি বলি আমাগো যদি জ্যালে দেয়?'
অনঙ্গ দেখে, তিন মাস পর মুতের গন্ধ মাখা মা নামছে বারান্দা থেকে। বাবুটা তোতলাচ্ছে। 'মানে, এখনও তো প্রমাণ হয়নি। বাংলাদেশ নেবে কেন?'
'আমরা
নেব ক্যান্? জ্যান্ত মানুষটারে দিলি না। কইলি বাংলাদেশী। মড়াটা কেন দিতে আইছিস?'
সুলতা
অনঙ্গকে আড়াল করে এবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝাঁঝালো গন্ধে বমি উঠছে অফিসারের। তিন
মাস পর আবারও একবার আকাশ ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সুলতা।
'পাঠায়
দে বাংলাদ্যাশ।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন