রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

প্রণব চক্রবর্তী

সমকালীন ছোটগল্প

 


সময় যতটা অগোছালো


যখন ঢুকলাম সে শুধুই মোনা। মোনাকে জড়িয়ে আদর উত্তাপ আদিখ্যেতা, সে এক পাহাড় গুঁড়ো করে দেবার মতো ছটফট হুলুস্থূলু ব্যাপার। কিন্তু কোন এক জাদুতে যখন বেরিয়ে আসছি, সে শুধুই লিসা। বোধহয় বোঝাতে পারলাম আমি এক মোনালিসার কথা বলছি। এ ভাবেই শব্দ নিজেই কীভাবে বিচিত্র রকমের ড্রিবলড হবার সুযোগ তুলে দেয় ব্যবহারকারীর হাতে! শব্দের এ এক শৌখিন গেমপ্ল্যান। তো আমি যেহেতু দেরিদা নয়, বাধ্যত পাঠককে বোঝানোরও কোন  দায় আমার ঘাড়ে চেপে বসেনি যে, সযুক্তিতে প্রমাণ করতে হবে 'শব্দের একমুখী কোনো অর্থ হয় না'। বরং মোনালিসা, এক সুতীব্র যুবতী যার কাছে গেলে আপনা থেকেই মোনালিসা 'মোনা' হয়ে যায়। যেমন আমাদের এলাকার রক্সটার জিল্লুকে দেখলেই এখন সবাই চিল্লু বলে সামনে আড়ালে সবখানে ডেকে ওঠে। কিন্তু কেন? প্রশ্নটা আমার মাথায় এলো সেদিন, যেদিন আরাম করে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছাগল আপনমনে একটা রঙচঙে কাগজ খাচ্ছিলো। রঙচঙে দেখেই কাছে গেলাম। দেখি ছাগলের কাগজের বাকি যে অংশটা খেতে বাকি, সেখানে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর ছবি ঝুলছে। কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না,  আমি যে দেশে বাস করি, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছবি আমারই সামনে একটা ছাগল তাকে চেবাতে চেবাতে পেটে চালান করে আগামীকাল কালো নাদী বানিয়ে দেবে! মানতে পারলাম না, বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিলাম কাগজটির বাকি অংশ। প্রধানমন্ত্রীকে তো বাঁচানো গেল, কিন্তু কাগজের বাকি অংশ মুখে নিয়ে ছাগল ধাঁ হয়ে গেল। কাগজটা নাড়াচাড়া করে বোঝা গেল, আই ব্বাপ, এ তো ভোটের আগে প্রকাশিত রাজনৈতিক ইশতেহার! কেলো করেছে, ছাগলটা পুরো ইশতেহারটাই প্রায় হজমে পাঠিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শুধু আমার হাতে। আহা, কী সৌভাগ্য আমার, জীবনে একটা মহান কাজ তো করতে পারলাম,  প্রধানমন্ত্রীকে ছাগলের ভোগে যাওয়ার হাত থেকে তো বাঁচাতে পারলাম! হোক না ছবি, তবু সে মানুষ তো, তাকে কিনা ছাগল অমন নির্লজ্জভাবে চেবাবে! ছ্যা! আর সেদিন থেকেই আমার মাথায় একটা প্রশ্ন গেড়ে বসলো, ছাগল এবং প্রধানমন্ত্রী, এদের মধ্যে ঠিক কতটা ব্যবধান থাকাটা জরুরি! আর সে প্রশ্ন থেকেই আজ মোনা ও লিসার মধ্যে ব্যবধান নিরুপণের এক গুরুদায়িত্ব নিয়ে মোনালিসাকে বেছে নিয়েছি হাতেগরম কাদাখচায়। মাথায় অনুসন্ধানী নিউটন থেকে কে নেই সেই মিছিলে, এমনকি আমাদের গোবর্ধনকাকু পর্যন্ত, যার একমাত্র গবেষণার বিষয় হচ্ছে, সব মুসলমানদের এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই এ দেশে আর কেউ গরীব থাকবে না। ছাগল তবু গোবর্ধনকাকুর ছবি না চিবিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি টিপ করে তুলে নিয়েছে নাদীবাজীর দাঁতমস্কোয়! রহস্য তো আছেই, সময়মতো সিবিআই এনআইএ-র হাতে তুলে দেয়া যাবে, কিন্তু এখন হিসাব মোনাকে নিয়ে নাকি লিসাকে নিয়ে এগোবে, সেটাই খুঁজে বার করতে হবে।

তো দেখলাম, মোনাবাজি বা মোনালিসাবাজি করতে গিয়ে সঞ্চয়ের যেটুকু গুছিয়েছিলাম একবার এসি কামরায় কাশ্মীর যাব ভেবে, লেপ্টে গেল গলতায়। যাক গে, হরিদাস না দেবদাস সেই এক হিরো আছে না, সে তো বাপ দেয়া জন্মটাই বেচে দিলো মাল আর মেয়েমানুষে, আমি আর ক’গাছা লোম ঝরালাম! মনে মনে গেয়ে উঠি ‘মোনা মোনা মোনা’, আর তখুনই অনুসন্ধানী লম্প তুলে  বলে, একটু লিসার কথা বলো, শুধু মোনা মোনা করলে লিসা তো অনাথ হয়ে যাবে! কোয়ায়েট লেজিটিমেট ডিম্যান্ড। কিন্তু যতবার লিসা বলতে যাচ্ছি, কেমন কেতরে যাচ্ছে হাত পা। লিসা লিসা যতই বলতে চেষ্টা করি, নো সেক্স। রহস্যটা কী! সিবিআই-কে জানাতে হবে। যেমন ছাগল বলায় যতটা দাপট, প্রধানমন্ত্রী বলতে ততটা পাচ্ছি না। আসলে দূরত্বটা মোনা ও লিসার মধ্যে, তেমনই দূরত্বটা  ছাগল ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। মোনালিসা বা ভোটের রাজনৈতিক ইশতেহার কোনো বিষয়ই নয়। বেড়ে লজিক হয়েছে। চল বোম্বা, আবার মোনার কাছে যাই! একী, হঠাৎ বোম্বা কোথা থেকে এলো! মন বললো, তুই আসলে বোম্বা নামে তোর মনের সাথেই কথা বললি! তাই নাকি! আরও এক রহস্যে নাক শুঁই শুঁই করতে লাগলো। বোম্বা ইজ ইকুয়াল টু আমার মন! মন কি তবে মোনা থুড়ি মোনালিসাতে লটকেছে! রহস্য। আবার সিবি...।

একদিন এক বেদেনীর সাথে দেখা হয়েছিলো। যুবককালে। এমন এক ঝারি মেরেছিলো চোখে, সেই দূরত্ব ঘোচাতে, কী বলব গুরুজনেরা আছেন, তাই বলব  না, সেই চোখের ঝারি আর বেদেনীর মাঝখানে কত যে মোনা শুয়ে আছে, বোঝাতে পারব না, মধ্যরাতের বাথরুম জানে আর জানে পৃথিবীর অনন্ত ছাগলেরা, যারা খাবার না পেলে প্রধানমন্ত্রীকেই ধরে চিবিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করে, হোক সে ছবি তবু মানুষ তো! বস্তুত বলা কথা এবং না-বলা কথার মাঝখানে যে বিপুল অন্তরীক্ষ থাকে, তাকে আপনিও চেনেন না, আমিও না, তবু আমরা তেমনই শুনেছি, তাই বলে যেতে হয় এবং সেই প্রসঙ্গেই লিসা এবং প্রধানমন্ত্রীকে আমার এক সারণীতে রাখতে কোনো অসুবিধে নেই। কারণ, আপনিও জানেন, আমিও জানি, মোনালিসার লিসা যেমন সাজিয়ে রাখতে হয়, প্রধানমন্ত্রীও সে ভাবেই একটা দেশের লকেটের মত। সে চালিত হয় একটি মন্ত্রীপরিষদ এবং সর্বজনস্বীকৃত একটি সংবিধান দ্বারা। যদি সেটা না হয়, অর্থাৎ সেই লকেট বা প্রধানমন্ত্রী নিজেই অতিসক্রিয় হয়ে সংবিধান বা মন্ত্রীপরিষদকে নিজেরই মতানুসারে চালিত করতে বাধ্য করে, তবে তাকে ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারী শাসক বলে। যেমন লিসা কখনও কখনও মোনালিসা থেকে ছিটকে এসে নিজেই তার আধিপত্য কায়েম করতে চায় তার নমুনা সেবার অরুণাংশুর বাড়িতে দেখলাম। সময় কাটাতে আমি আর মোনালিসা মাঝে মাঝে অরুণাংশুর বাড়িতে  যাই। কিন্তু সম্প্রতি দেখছি, অরুণাংশু মোনাকে দেখলেই শুধু 'লিসি' 'লিসি' করে। সেদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, তুমি মোনালিসাকে এত লিসি লিসি করো কেন! অরু স্পষ্ট বললো, ‘কী করব, যে কদিন তোরা আমার ঘরে এসেছিস, সে  দুমিনিট হোক বা দুঘন্টা, একবার করে সে এখানে মুতঘরে যাবেই। আমারও তাই ওকে দেখলেই হিসি বলে ডাকতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সেটা খুব শোভন নয় বোধ করেই, ওর নামের লিসাটুকু কেটে নিয়ে, হিসির বদলে ওকে লিসি লিসি বলে ডাকি। নামকাঠামোর এটুকু বদলে একটা বেশ বিকৃত আনন্দও পাই। তোমার কি তাতে কোনো আপত্তি আছে?’ আমি বললাম, আমার কোনো আপত্তি  নেই। আরও কিছু চাইলেও মোনা বারণ করবে না। ব্যাস, উচ্চারণ করতে যেটুকু দেরি, অরুণাংশুর উজ্জীবিত ঘোড়া ঝড়ের গতিতে মোনালিসার দিকে ধাবিত হয়েই তাকে সরাসরি বলে ফেলল, লিসি, তোমাকে আমি মিস করি! মোনালিসা একটু থেমে গিয়ে ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠেই বলল, আই অলসো ডু ইট বেব! জাস্ট, কাম অন, উই লাই টুগেদার! অরুণাংশুর চোখমুখ প্রায় সাদা হয়ে যাবার মত অবস্থা, তো তো করছে, বুক বন্ধ হয়ে গেলেই কেলো! তাড়াতাড়ি আমি এসে দাঁড়াতেই অরুণাংশু কিছুটা সহজ হয়ে বলল, তুই জাস্ট একটু ড্রইংরুমে বস, আমরা আসছি! মোনালিসার সাথে চোখাচোখি হতেই বলল, নতুন কাস্টমার, একটু ব্যবসা করে নিই। কথাটা শুনেই অরু বলল, মানে! মোনালিসা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ওর গালদুটো একটু চিপে দিয়ে বলল,  তোমার কি ধারণা এ বাড়িতে কখনও সখনও আমরা একটু আড্ডা দিতে আসি বলে, বিনে পয়সায় তুমি আমার শরীরে চাপবে, আর আমি সেটা মেনে নেব! অরু কিছুটা তুতলে বলল, তুমিই তো একসাথে শোয়ার কথা বললে!  মোনালিসা তীব্র শ্লেষের সাথে বলল, তো কী করব, ওভাবে কেউ ছুটে এসে  হাঁফাতে হাঁফাতে যদি বলে আই মিস ইউ, তাকে বিছানায় ডাকা ছাড়া আর কী করতে পারি, যার কাছে আমি এমনিতেই লিসি বা হিসি -- প্রায় একগোত্রীয় দুটো শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়!... ব্যাপারটাকে আর এগুতে না দিয়ে মোনাকে ডেকে নিয়ে সেদিনের মতো আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম রাস্তায়। লিসার এই রাস্তায় এসে দাঁড়াবার স্বাধীনতা, যা কিনা একটি ছাগলেরও আছে, প্রধানমন্ত্রীর সে স্বাধীনতা নেই। কারণ সে বন্দী। সংবিধান নামক এক শৃঙ্খলের সহস্র বাঁধনে সে বন্দী। আর এই বন্দীত্বকে অবহেলা বা অগ্রাহ্য করবার প্রবণতাটাই দেশদ্রোহীতা। যা কিনা একজন ফ্যাসিস্ট করে থাকে, যেমন লিসারা নিমেষেই  বেশ্যা হয়ে যেতে পারে, ছাগল খেয়ে ফেলতে পারে সেই প্রধানমন্ত্রীকেই বা তার ছবিকে! হোক না ছবি তবুও সে মানুষ তো!...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন