রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


মীনারানী

 

-''ধুস! কী ছাইপাঁশ লিখেছেন! এসব ছাপা যায় নাকি!''

সেই একই কথা। শব্দগুলো সাইরেনের মত বাজে মহিমচন্দ্রের কানে। লাল রঙের বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসছেন মহিমচন্দ্র মজুমদার। ভাঙা মন নিয়ে। বাইরে বেরিয়েই সেই ডাবওয়ালা। সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-''একটা ডাব দেবো? যাহ গরম পড়েছে। মাথা ঠান্ডা থাকবে। আপনার তো লেখালেখির কাজ। মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার।''

খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে লোকটা।

-''তোকে অত ভাবতে হবে না। দু'পয়সার ডাবওলা। বাক্যি শুনলে গা জ্বলে যায়। ''

কথাগুলো বলেই চমকে উঠলেন মহিমচন্দ্র মজুমদার। এ যে একেবারে তার ভাষা। তবুও সামলে নেন নিজেকে।

-''কিছু মনে করিস না, সকাল থেকে বেরিয়েছি তো, মাথার ঠিক নেই।''

ডাবওলা পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসে। উত্তরে বোধহয় কিছু বলে। মহিমচন্দ্র শুনেও শোনেন না। যেদিন থেকে মীনারানী পৃথিবী ত্যাগ করেছেন, তার কয়েকদিন পর থেকেই শুরু। মীনারানী ভর করে থাকেন মহিমচন্দ্রের ওপর। তাই বিনয়ী, নম্র মহিমচন্দ্রের কথাতেও লঙ্কার ঝাঁঝ। মীনারানীর মত।

সেই কত বছর আগের কথা। একটার পর একটা লেখা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। কতবার এই লাল বাড়িটা থেকে খালি হাতে ফিরে গেছেন মহিমচন্দ্র মজুমদার। বারবার চোখে পড়েছে এক উজ্জ্বল মুখ। নামী প্রকাশনা সংস্থার অফিস এই লাল বাড়িতে। সেখান থেকে উজ্বল মুখে বেরোয় এক তরুণী। তার প্রত্যেকটা লেখা সমাদরে প্রশংসিত হয়। সৃষ্টি প্রকাশ পাওয়ার আলো চোখে-মুখে। শুধু মেজাজটা খিটখিটে। মহিমচন্দ্রের মাথায় তখন লেখক হওয়ার জেদ। মহিমচন্দ্রের নম্রস্বভাব আর ধৈর্যের জাদুতে বশ হলো সেই তরুণী। মীনারানী। মনের ভেতরের শীতল ইচ্ছে গুলোয় রোদ লাগতে শুরু করলো মহিমচন্দ্রের। সেই রোদের গায়ে  নিষ্ঠুরতার আঁশটে গন্ধ। বিয়ে হল মীনারানীর সঙ্গে মহিমচন্দ্রের। আর মীনারানীর শব্দের গায়ে তারই অজান্তে নাম বসল মহিমচন্দ্র মজুমদারের।

মীনারানী ঘুমের ওষুধ খেত। একটু একটু করে তার ডোজ বাড়লো। যা লেখা হয় কিছুই মনে রাখতে পারেন না মীনারানী। পাতাগুলো মহিমচন্দ্রের ফাইলে জমা হয়। ধীরে ধীরে তারা পৌঁছে যায় প্রকাশনা সংস্থার টেবিলে। তারপর তরতর করে এগোনার পালা। স্ট্রাগলিং লেখক মহিমচন্দ্র মজুমদার থেকে বেস্ট সেলার বইয়ের বিশিষ্ট লেখক। মসৃণ যাত্রাপথ। শব্দেরা শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি। শুধু  শুঁয়োপোকার মত করে বিছানার সঙ্গে মিশে গেলেন মীনারানী। মহিমচন্দ্রের স্ত্রী। তবুও অদ্ভুতভাবে শব্দেরা অভিমান করেনি মীনারানীর ওপর। জীবনের শেষ কটা দিনও কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে গেছেন গল্প, গদ্য, কবিতা।

শব্দের স্রোত থামল মীনারানীর মৃত্যুর পর। বেশ কিছুদিন মীনারানীর শব্দই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাজালেন লেখক মহিমচন্দ্র মজুমদার। তারপর আস্তে আস্তে ভাঁড়ার ফুরোতে লাগলো। কেউ দয়াপরবশ হয়ে প্রৌঢ় লেখকের অগোছালো লেখা ছাপলেও বেশিরভাগ দিনই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে মহিমচন্দ্র মজুমদারকে। যেদিনই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে সেদিনই হয়েছে এই অদ্ভুত ব্যাপারটা।  মহিমচন্দ্রের ভেতরে কে যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে। হঠাৎ করে মহিমচন্দ্রের ভাষা খিটখিটে, তেতো হয়ে গেছে শুধু সেইদিনটুকুতে। মহিমচন্দ্র বুঝেছেন মীনারানীর শব্দরা মহিমচন্দ্রকে ছেড়ে গেলেও শব্দের মালকিন ছেড়ে যায়নি তাঁকে। আজও মীনারানীর শব্দরা দাঁত, মুখ খিঁচিয়ে মহিমচন্দ্র মজুমদারকে আঁচড়ায়। মহিমচন্দ্রের ভেতরটা তখন দুমড়ে-মুচড়ে ধুলোর মতো হয়ে যায়।

 


1 টি মন্তব্য: