সমকালীন ছোটগল্প |
বৃন্দা
চারদিকে নরম কুয়াশা। ধানের খেতের মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তা চলে গেছে। দুপাশে তাল, নারকেল, সুপুরি গাছের সারি। সূর্য উঠতে এখনো বাকি, সবেমাত্র পূর্বদিক লাল হতে শুরু হয়েছে। সারারাত শিশির পড়ে পড়ে মাটি ভিজে আছে। ঘাসের ডগায় ডগায় মুক্তোর মতো জলবিন্দু। শিরশিরে হাওয়ায় গায়ের মোটা সুতির চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো অনুপমা চ্যাটার্জি। তার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। চুলের খোঁপা ভেঙে গেছে, তাতে জড়ানো তাজা হলুদ আর সাদা টগরের ফুলের মালা এখন ম্লান, শুকনো। গলায় মোটা দানার সোনার মালা, হাতে কঙ্কন। অনুপমার পরনের পলয় এখন ভারী লাগছে খুব। 'মেইখুম' খুলে প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখেছে। অনুপমা ভানুগাছ অঞ্চলের মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের মহারাসলীলার একটি আসরে বৃন্দাদেবীর ভূমিকায় নেচেছে রাতভর। এই প্রথম নয়, আরো অনেকবার সে রাসের গোপী হয়ে নেচেছে।
ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া অনুপমা মা বাবার জ্যেষ্ঠা কন্যা। অত্যন্ত আদরের। ছোটবেলা থেকেই ভক্তিমতী। ধর্মগ্রন্থপাঠ আর কীর্তন তার ভালো লাগে। ভানুগাছের হীরামতি গ্রামের মেয়ে অনুপমা চ্যাটার্জি। বাকি দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। অনুপমা বিয়ে করেনি। ছোট থেকেই কেন যেন মনে হয়েছে বিয়ে, সংসার, সন্তান তার জন্য নয়। সমাজে কিছু মানুষ নিজের মতো বাঁচতে চায়। অনুপমা তাদের মতোই একজন। মণিপুরি সমাজে মানুষে মানুষে অন্তরের টান খুব বেশি, তাদের বাড়িগুলো পাশাপাশি, সবাই যেন আত্মীয়। অনুপমার ঠাকুমা, ঠাকুরদা এখনও জীবিত এবং সুস্থ। নাতনির সঙ্গে তারাও এসেছেন মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের মহারাস উৎসবে।
রাসলীলার রাধা আর গোপিনী যারা সেজেছে সেইসব মেয়েরা রাসনৃত্যের পোশাকেই সারা রাতব্যাপী উৎসব শেষে ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ফিরছে। গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের তাঁতে বোনা উলের লাল নীল গরম চাদর। কুয়াশার আবরণ ভেদ করে সূর্যের প্রথম কিরণ তাদের পোশাকে পড়তে শুরু করেছে, প্রতিফলিত হচ্ছে সৌরবর্ণালি। রাসনৃত্যের এই বিশাল দলটা কার্তিকী পূর্ণিমার মোহময় পবিত্র রাতটি উপভোগ করেছে প্রাণপণে। তাদেরই কারো কারো শিশুসন্তান গতকাল রাতে কৃষ্ণ হয়েছে অথবা রাধা। কৃষ্ণের বিরহে রাধা কেঁদেছে, সেই কান্না দেখে ভক্তবৃন্দ লুটিয়ে পড়েছে। মৃদঙ্গধ্বনি আর সঙ্গীতে রাসমেলার মাঠ ছিল মুখরিত। সারাবছর তারা অপেক্ষা করতে থাকে এই মিলনমেলার। শুধু যে মণিপুরি মানুষ আসে তা নয়, মেলা মানেই মিলন, বাঙালিরা আসে, চা-বাগানের শ্রমিকরাও আসে। নানা জাতির মানুষের সমাগমে, জিলিপির গন্ধে, মৃদঙ্গ ধ্বনি, কীর্তনের সুরে যেন একরাতের মুখরিত বৃন্দাবন।
দূর থেকে এখন যদি রাসনৃত্যের শিল্পীদের ঘরে ফেরার এই দৃশ্য কেউ দেখে মনে হবে অলৌকিক কোন দৃশ্য। আবছা কুয়াশার আস্তরণ গায়ে মেখে দেবদূতের মতো মানুষেরা পৃথিবীর পথে হাঁটছে।
অনেকক্ষণ হাঁটা হয়েছে, পুরো দলটাই খুব ক্লান্ত। পথচলতি গ্রামের প্রান্তে নাটমণ্ডপ। খুব সকাল বেলা গোকুলসিংহের গাঁওয়ের সেই নাটমণ্ডপের চারপাশে পড়ে থাকা ঝরা পাতাগুলোকে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করছিল এক রমণী। এখানেও বিকেলে রাখালনাচ হয়েছে, তবে তত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নয়। ঠাকুর নিদ্রা গেছেন। ভক্তবৃন্দ তেমন নেই, কয়েকজন কম্বল পেতে মেঝের ওপর আধশোয়া।
আস্তে আস্তে পুরো দলটা এসে এখানে ঢুকল। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটবে। সবার সঙ্গে সবারই একটি ক্ষীণ যোগাযোগ রয়েছে, লতায় পাতায়। খুব একটা অপরিচিত তারা কেউই নয়। দরকার একটু গরম চা। কিন্তু নাটমন্দিরের সবাই খুব ক্লান্ত, চায়ের আশা করা বৃথা। সূর্য উঠে গেছে, কুয়াশা পরিষ্কার হয়ে ঝকঝকে রোদ উঠছে। সঙ্গে থাকা পোঁটলা থেকে সকলেই চিড়ে, মুড়ি, বাতাসা, জিলিপি, বুটভাজা বের করল। অনেক লোকজনের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন রজনীকান্ত শর্মা। তিনি এই নাটমন্দিরের পুরোহিত। লম্বা দোহারা চেহারা। খাটো ধুতি কাছা দিয়ে পরা। খালি গায়ে ধবধবে সাদা পৈতা, একটি সাদা চাদর, কালো পাড়ের প্যাঁচ দিয়ে কাঁধের ওপর ফেলা। কপালের তিলক এখনও মুছে যায়নি। বয়স বোঝা যায় না, মনে হয় চল্লিশ পেরোয়নি এবং তিনি এখনও কুমার। সবাইকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন রজনীকান্ত।
"কই গো, আমাদের বৃন্দা কোথায়।"
অনুপমা হাতজোড় করে নমস্কার করল। রজনীকান্ত শর্মা অণুপমাকে খুব ভালো চেনেন। ওর প্রতি তার মনে ভালোবাসা আছে। সেই সংবাদ একদা পাঠিয়েছিলেনও অনুপমা সমীপে। তবে অনুপমার কাছ থেকে সাড়া পাননি। তাই তিনি বাইরে থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মানটাই শুধু প্রদর্শন করেন। অনুপমার কেন জানি হঠাৎ খুব লজ্জা করতে লাগল। আসলে তার ইচ্ছে ছিল না এখানে বিশ্রাম নেবার, সবাই থামল, তাই সেও অগত্যা। রজনীকান্তের দুর্বলতা বৃন্দাদেবী অনুপমা জানে। হেমন্তের সকালে, অপরিপাটি নাচের পোশাকে রজনীকান্ত শর্মার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা অনুপমার মনে অনাস্বাদিত এক অনুভবের সৃষ্টি করছে যেন। কাল নিজের মনের সকল ভক্তি উজাড় করে সে নেচেছে, তার হাতের প্রতিটি লীলায়িত মুদ্রা শ্রীকৃষ্ণকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। বনকুঞ্জে পাতা ফুলের শয্যা, যমুনাতীর, কদম্ববৃক্ষ - সব যেন মনোজগতে তাদের স্থাবর রূপ নিয়ে পূর্ণিমার ভরা চন্দ্রজোয়ারে প্রতীয়মান হলো। তারপরেই প্রবেশ ঘটল, রাধা-কৃষ্ণ সাজে বালক-বালিকার। তাদের ঘিরে বৃন্দা আর সখীরা নাচতে আরম্ভ করল। হঠাৎই অনুপমার মনে হলো এই যে পবিত্র প্রেম, পুজারিণীর মতো কৃষ্ণবিরহে ডুবে যাওয়া, এইপর্যন্তই শেষ, তারপর তো রাধার কাছেই কৃষ্ণ নিজেকে সমর্পণ করলো। বৃন্দা কি তবে ব্রাত্য রয়ে গেল! সে আর অন্য গোপিনীরা শুধু মায়াময় পরিবেশকে সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে প্রেমময় করে তুলল, এটাই তাদের কাজ, আর কিছু নয়!
সবাই মিলে প্রাণখুলে হাসি ঠাট্টা করছে। এ হলো উৎসব শেষে, উৎসবের রেশটাকে চেটেপুটে খাওয়া।
"এই
নাও, একটু গলা ভেজাও।"
অনুপমা
দেখল, তার সামনে কাগজের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা ঘন দুধ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রজনীকান্ত
শর্মা। ট্রে-তে করে বাকি সবাইকে চা পরিবেশন করছে একজন পুরুষ লোক। অনুপমা চায়ের কাপটি
নিলো।
"তোমার
গাঙে আহিতৌগ মি, তোমার ঘরে। ওয়ারি আছে অনুপমা তোর লগে।"
[তোমাদের
গ্রামে যাব একদিন, তোমার বাড়িতেই। কথা আছে অনুপমা, তোমার সঙ্গে।]
রজনীকান্তের
গলার স্বর জলদ গম্ভীর। তার ওপর তিনি মৃদু স্বরে কথা বলছেন, যাতে সবাই শুনতে না পায়।
মনে হচ্ছে আসন্ন শীতকালে অসময়ের মেঘ ডাকছে গুরুগুরু, ফসল নষ্ট করে দেবে, মাটির বুকে
ভয় জেগেছে।
অনুপমা
মৃদু হেসে বলল, "মি বাসিয়া থাইতৌ।"[আমি অপেক্ষায় থাকব]
অনুপমার স্বর্গীয় হৃদয় এখন তমসায় আচ্ছন্ন। কেটে গেছে বহুদিন। কার্তিকের সেই ভোর থেকে, গভীর শীতকাল পেরিয়ে বসন্ত এসেছে পৃথিবীতে। আবিরের রঙে মেতে উঠেছে সবাই। মণিপুরি গ্রামগুলোতে উৎসব মানেই রাধাকৃষ্ণ, যেন কৃষ্ণনিয়ন্ত্রিত এক সামাজিক জীবন।
রজনীকান্ত
অনুপমার মনে সেদিন যে মধুর বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে তার সারা শরীর ও হৃদয় আজ নীল
হয়ে গেছে। এর আগে অনুপমার হৃদয়ে কোন পুরুষের
জন্য অপেক্ষা ছিল না, সেইরকম ভাবই তার মনে প্রভাব বিস্তার করেনি কখনো। কিন্তু গত রাসপূর্ণিমার
ভোরে হঠাৎ কেন জানি মনের মধ্যে এই ফাটল দেখা দিল। এখন শুধু তারই রেশ তাকে কুড়ে কুড়ে
খাচ্ছে। রজনীকান্ত আসেননি।
বৈশাখ মাস শেষ হয়ে গেছে। অনুপমা আজকাল অপেক্ষা আর করে না। রাসনৃত্য তার রক্তে মিশে আছে। মধ্যরাতে যখন পৃথিবী ঘুমঘোরে, তখন সে নিজেকে সাজাতে বসে।
পলয়,
মেইখুম, কোকতুম্বি এসব দূরে সরিয়ে রাখে। গলায় ফুলের মালা। কপালে তিলক। পিঠ ছাড়িয়ে কোমর
ছুঁয়েছে খোলা চুল। প্রতিদিনের সাধারণ মণিপুরি
পোশাকে সে নিজেকে সাজায়, ঘরের মধ্যে কৃষ্ণের ছোট মূর্তিখানিকে নিবেদন করে পুষ্পার্ঘ্,
তারপর নাচ শুরু হয়। মৃদঙ্গ করতালের ঘনঘোর ধ্বনি নেই, সঙ্গীত মনমাঝে বাজতে থাকে, সুর
তাল লয় কোথা থেকে যেন জড়ো হয় তার মধ্যে। মগ্ন
হয়ে নাচতে আরম্ভ করে অনুপমা। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে যায়। যখন অনুভব করে সে স্পর্শ
পেতে চাইছে, চাইছে মিশে যেতে, আগে এরকম মনে হতো না। এ পাপ। ঘোরতর পাপ। এই কালো মন নিয়ে
রাস হয় না। আত্মা কলুষিত, হৃদয় উন্মত্ত। না বৃন্দা হবার উপযুক্ত আর সে নেই। ভীষণ রাগ হয় রজনীকান্তের ওপর। তাকে নষ্ট করে
দিলো। সরে যেতে হবে এই শ্রদ্ধা ও সম্মানের শিল্পকলা থেকে। হু হু করে ওঠে হৃদয়।
কয়েক বছর পর আবার রাস উৎসবের লোকজন আমন্ত্রণ জানাতে এলো অনুপমাকে, বৃন্দার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য।
না
না। আর আমি বৃন্দা নই। আমাকে মাফ করে দিন। সময় দিন আমাকে, হয়তো ভবিষ্যতে কখনো মন শান্ত
হলে।
অনুপমা
আশ্চর্য হয় শুধু এই ভেবে রজনীকান্ত আসবেন বলেছিলেন, এলেন না, তাহলে বললেন কেন? পৃথিবীতে
এ অতিসাধারণ ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পছন্দের মানুষ আসে না জীবনে, এলেও অনেক সময় তাকে
না চিনেই ফিরিয়ে দেয় মানুষ।
কয়েক বছর কেটে গেছে । রজনীকান্ত বিবাহ করেছেন। সন্তানের পিতা হয়েছেন, এ খবর পৌঁছেছে আজ অনুপমার কাছে। তারপর থেকে তার হৃদয় আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত। মনে হচ্ছে অনুপমার মন যেন কেউ দুহাত দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে যত ঝুটমুট ধুলোর আস্তরণ পড়েছিল।
তাকে
ডাকছে কার্তিকী পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাত, বন বনানী, রাসলীলার মণ্ডপ, অনুপমা আর অনুপমা
নেই, সে এখন চিরকালীন বৃন্দা, কেউ তাকে আর ডাকুক বা না ডাকুক তাতে তার কিছুই এসে যায়
না...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন