রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


হুক্কাহুয়া


হিতোপদেশ থেকে বেড়িয়ে ভিটরে শিয়ালটা লাফ দিয়ে বড় রাস্তা পার হয়ে চলে আসলো, ঠিক যেখানে মৃত খেয়াল মুস্তাফা কবরের শীতল শয্যায় শুয়ে আছে। চোখ দুটোর ওপরে হাইওয়ে দিয়ে ছুটন্ত গাড়িগুলোর লাইট এসে পড়ছে। তার ফলে শিয়ালের ধূর্ততায় ভরা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে মাঝেমধ্যেই জ্বলে উঠছে।

জোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর। চাঁদের স্নিগ্ধতা প্রশ্নাতীত! তবে, সব কিছুর-ই উল্টো দিক আছে। এই যেমন আলো। 'আলো' হতে পারে একটি বালিকার  প্রহেলিকার মুর্তি। মূর্তিটি সরতে থাকে পশ্চিমে। রজঃস্বলা হবার পূর্বমুহূর্তে কোমরের বিছায় বিদ্যুৎ লুকানো ছিলো তার। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ-এর আলো আর আগুনে পুড়ে যেত খেয়াল মুস্তাফা। খেয়ালের খেয়ালিপনায় আলো, এক একসময় ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে ছুটতে থাকতো। ওই দিকে বনবাদাড়। কলাগাছের পাতাগুলো বারে বারে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে একবার ডাইনে, তো, আর একবার বাঁয়ে বাতাসে দোল খেত। যেন -  না না না…

যৌবনের মহাসঙ্গীতের মূল আকর্ষণ দেহজ অস্তিত্বের বিপরীত টান। তাই, সময় নষ্ট করবার মতো সময় কোথায় খেয়াল মুস্তাফার হাতে! এক সময়ে কলাবাগানের পুরনো খয়েরী ঝরে যাওয়া পাতার বিছানায় আলোকে উঠিয়ে নিয়ে তার অনেকটা ওপরে উঠে যেত খেয়াল মুস্তাফা। কিম্বা, খেয়ালি আলোয় ভিজে যেত তিনশ ডলার খরচ করে কেবলমাত্র আলোর জন্যই ডাঙায় ফিরে আসা বিড়ালের মিউ মিউ ডাকের মুস্তাফা। সাগরের নোনা হাওয়ায় জলে ভাসা, নেভিতে কাজ করা যুবক মুস্তাফার চোখে তখন দিগন্তের এপাড় থেকে এক অদ্ভুত আলোর খেলা চলতো।

...ত'রে আমি আফ্রিকার তন্ত্রমন্ত্রের হীরার নাকছাবি দিমু। আর দিমু কোলার-এর সোনার খনি থিক্কা সংগ্রহ করা কালো মেঘের মধ্যিখানে চমকায় চমকায় উঠা হাঁসুলীমালা।

তুই আমাক কথা দে, এই মুস্তাফারে ছাড়ি তুই কুত্থাও যাবি না!

যামু না... যামু না... যামু না....

অচেনা গাছের পাতাগুলো তখন শিরশিরে হাসিতে দিগদিগন্তের গাছের শরীরে ঠেঁসে থাকা যেন কথাবলা তোতাপাখি! ডেকে উঠতো টি টি টি...  

ঘড়ির কাঁটা এবার রাত বারোটার ডান দিকে ঘুরতে লাগলো। কোথাও যেন ঝুপ করে শব্দ হলো।

আ… আ... মললাম গো, মরি গিলাম বাতের বেদনায় গো...

ফ্লাশব্যাকে এখন গাঢ় অন্ধকার চিরে জোড়ালো হলুদ লাল আলোর খেলা চলছে।

দু'খানা ফাটা পায়ের গোড়ালি দেখা যাচ্ছে। একবাটি তেল নিয়ে হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত তেল মর্দনকারীর শিরা-ওঠা একখানা হাত একবার পায়ের ওপরে  মালাইচাকি পর্যন্ত উঠছে, তো, একবার গোড়ালির ফাটা অংশের মধ্যে নামছে।

রাস্তায় কম আলো হলেও ধূর্ত শিয়াল জানে, আর মাত্র ক'পা ফেললেই মুস্তাফার ওই দুইকাঠা জমির কিঞ্চিৎ ফটোসেশানে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বেশ ছবি হওয়া যায়। দুর্মূল্যের সেই ছবিতে একটা গণেশঠাকুর মুক্তার মালা পরিহিত। তারই চরণতলে কপালে টিক্কা লাগানো আশ্রিত ধূর্ত শিয়াল।

এইবার বিশ্ব জয়ের মতো করে খুব জোর হাসতে ইচ্ছে করছে শিয়ালের। কিন্তু  না। এই মুহূর্তে হাসা একেবারেই নিষিদ্ধ।

ঝুপুরঝাপুর শব্দ হতেই শিয়াল সজাগ হয়ে গেল। এমন আওয়াজ রাজমিস্ত্রীদের জোগাড়িদের ইট ফেলার। কান খাড়া করে অঙ্কের যোগচিহ্নের মতো করে সামনের  দুই ঠ্যাং দিয়ে আঁশ শ্যাওড়ার গাছকে জড়িয়ে ধরে কিছু বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলো ভিটরেটা।

মুস্তাফা মরেছে তো সেই কবে! আবাগীর বাঁঝা বেটিটা মরেও মরে না। খালি ক্যাগলায় - মল্লাম গো...

জোছনায় একরকমের জয়পরাজয়ের গল্প আছে। হয়, হারি! কিম্বা জিতি! যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই তো আশ!

আশা এই, ওই দু'কাঠা পিছনের জমিটুকু বরাতে মিললে মোট চারকাঠাতে একদিন প্রাসাদ উঠবে! এক একটি সাতশো স্কয়ার ফিটের মধ্যে এক একটা রূপকথার গল্পের মতো চাকচিক্যের অবিরাম অন্তহীন পরাবর্ত ঘুরতেই থাকবে! ঘুরতেই থাকবে! শিয়ালকে আর কোনোদিনও খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে যেতে হবে না মানুষের পোল্ট্রি খামারের মধ্যে। অথবা, কোনোদিনই সে মুরগির খামারে গিয়ে কক্ কক্ করে ডাক দিয়ে মুরগির দলে ভীড়ে গিয়ে সং হবে না।

ভোর হয়ে আসছে। ঝুপঝাপ শব্দ বাড়ছে। পূবের আকাশ জুড়ে নানা রঙের কারুকার্য শুরু হয়ে গেছে। শিয়াল গর্তে ঢোকার মুখে দেখতে পেলো, কে বা কারা গর্তের মুখে পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে। ওইসব পাথরের নীচ থেকে আইনের শাসনের জাল নিয়ে এগিয়ে আসছে যারা, তারা মানুষের সঠিক বিচারের জন্য কথা বলছে।

ধূর্ত শিয়াল সজাগ হয়ে গেলো। এমন অবস্থায় পিছোতে হয়। পিছোতে পিছোতে কান খাড়া করে শুনতে পেলো - আলো নামের এক বেতো রোগী টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে নতুন তোলা ইঁটের প্রাচীরের ওপরে খেয়াল মুস্তাফার ছবি লটকাচ্ছে।

ধুনো জ্বলছে অনেক নীচে। গোলাপের সুগন্ধিত ধোঁয়া কুন্ডুলী পাকিয়ে পাকিয়ে কালচক্রকে কেটে কেটে দিচ্ছে। ভোরের বাতাসটা কেমন একটা ভারী হয়ে শিয়ালের বুকে চেপে বসতে চাইছে।

এইবার শিয়ালের পিছনে মুস্তাফা, আর, সামনে আইনের জাল পাতা জঙ্গলাকীর্ণ বসতির বেঁচে বর্তে থাকা। এসবের ভেতরে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে জাল জাল হুক্কাহুয়ার আর্তনাদ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন