রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়


মৃণালিনী           

           

মৃণালিনী কেবলই সফলতার কথা বলত, কীভাবে পাঁকের ভিতর থেকে ভেসে  উঠতে হয় জলের উপর। যদিও আমি তলিয়ে যেতাম পাঁকে। সকালে নরম আলোয় জলে নামতাম। এপাড়ার বাচ্চারা তখন দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছে, রেডিও বাজছে, উননের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে জানলার ভিতর দিয়ে। গোটা শহর যেন একটা কারখানা, হাড় পাঁজরা ফুলিয়ে কেবলই উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে। পায়ের নিচে নরম কাদা আঙুলের ফাঁক দিয়ে অল্প বেয়ে উঠছে , একটা হালকা ধার পাথরে, ঠিক যতটা কাটলে রক্তপাত হয় তার আগে থেমে আছে। ব্যথায় পাগল হয়ে আমি মৃণালিনীকে টেনে ধরি। তার গোলাপি পাপড়ি, ঘুম ফুটে এখনো প্রসাধন মাখেনি। শিশিরে ফুলে আছে ঠোঁট, নাকি ঘুমের মধ্যে ঠোঁট কামড়ানো পুরনো অভ্যাস? 

ফুলটিকে তোলার জন্য হাত বাড়ায়। এসময় বাতাস বয়। ঠাণ্ডা বাতাস। জলের উপর দিয়ে ভেসে আসতে আসতে বাতাস শীতল হয়েছে। আমার কানের কাছ দিয়ে, মৃণালিনীর বুকের ভিতর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়। আমি জানি চিরকাল ওই গোলাপি দলের থেকে বেশী আকর্ষণ অন্ধকারের ভিতর নেমে যাওয়া নরম শরীর।

আমাদের প্রতিবার দেখা হলে কথা শেষ হত ঝগড়ায়, বাড়ি ফিরে আমি গর্জাতাম। ভিজে হাত পায় ফিরে আসতাম প্রতিদিন। উনুনের ধোঁয়া তখন নিভে গেছে। রেডিও বন্ধ হয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা শহরটাকে আমি মরে  যেতে দেখতাম। তবু এই মৃত শহরে প্রতিদিন একটা নতুন অজুহাত আমাকে ফিরিয়ে আনত। প্রতিদিন কথা শেষে লুকিয়ে ফেলতাম নখ দাঁত। বাড়ি ফিরে মাকে আঁচড়াতাম। রক্ত পড়ত, ফোঁটা ফোঁটা। আসলে তার শরীরে বিশেষ রক্ত তখন আর ছিল না। ভাতের থালা হাতে মার মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত আমি অনেক রাতে ঘুমের ভিতর জেগে উঠে দেখে ফেলি। আমার তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত দেখার বয়স।

একদিন ছিঁড়ে ফেললাম মৃণালিনীকে! তার ডাঁটা দাঁতে কেটে ভাসিয়ে দিলাম খালের জলে। রক্ত রক্ত, এত রক্ত একটা গাছের শরীরে থাকে?

মা কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার তখন খুনের নেশা পেয়েছে । আমার চোখে খুনের রক্ত দেখে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, তুইও বাপের মতন হয়েছিস।

মার শরীরের সব রক্ত তখন ফুরিয়ে এসেছে

 


1 টি মন্তব্য: