শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

তথাগত চট্টোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৯


স্পর্শ

সমরেশের আজ ছুটি। ডাক্তার ব্যানার্জি গতকালই তা নিশ্চিত করে দিয়ে গেছেন। সামান্য একটা ভাইরাস সংক্রমণ তাঁকে জীবনের প্রায় প্রান্তসীমায় এনে  ফেলেছিল। আশা নিরাশার মাঝে দুলতে দুলতে সমরেশ এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও প্রাণঘাতী সেই ভাইরাসের বলি হচ্ছেন অনেক মানুষ। দেশে দেশে ঘোষিত মহামারী। মৃত্যুমিছিল এখন রোজকার ঘটনা।

সমরেশের বেড ঘরের একদম শেষপ্রান্তে। জানালার ধারে। আই.সি.ইউ. থেকে এখানেই তাকে আনা হয়েছে। জানালার বাইরে তাকালেন সমরেশ। পর্দা অল্প সরানো। লোকজনের ভিড়। সবাই শঙ্কিত, ভীত। সেইসব উদ্বিগ্ন মানুষদের মধ্যে সমরেশের চোখ হঠাৎই আটকে গেল একজনের দিকে। মুখের মাস্ক ভদ্রমহিলা কোনও কারণে হয়তো নামিয়ে রেখেছেন। হালকা রঙের শাড়ি। কাঁধে ঝোলানো  ব্যাগ। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। যেন একটু উৎকণ্ঠিত। সমরেশ জানালার পর্দা পুরোটা সরিয়ে টেবিলে রাখা চশমা পরে নিলেন। ভদ্রমহিলার মুখের অবয়ব এবার আরো স্পষ্ট হল। সমরেশের মনে হল ভদ্রমহিলা দেখতে অনেকটাই যেন কাজরির মত। একটু পরেই মুখের আবরণী তুলে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে গেলেন ভদ্রমহিলা।   

জানালার ধার থেকে সরে এলেন সমরেশ। পরিচারক ছেলেটি এসেছে হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে। সে বলল, “আপনার বাড়ির লোক পাঠালেন। হাসপাতালের পোষাক খুলে এগুলো পরে নিন। কাউন্টারের সব কাজ শেষ হয়ে গেলে নিচ থেকে ডাকবে। আপনি ততক্ষণে রেডি হতে থাকুন”।

পোষাক পরিবর্তন করতে করতে সমরেশের মনে পড়ে অনেক পুরনো কথা। কাজরির মুখের সঙ্গে অনেক মিল, নাকি মনের ভ্রান্তি? ঊনআশি সালে কাজরি  মার্কিন দেশে চলে যায় বরের সাথে। তারপর কি ফিরে এসেছে? এতগুলো বছর পেরিয়ে এসব কথা ভাবতে বসা যে কেবল অর্থহীন, সময় নষ্ট!  

সমরেশের মনে আছে কাজরির নরম ঠোঁটের স্পর্শ পাগল করে দিয়েছিল তাঁকে। দুজনেই তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। কিন্তু এর পরের  ইতিহাস বেশ অন্যরকম। কাজরিকে তাঁর পাওয়া হয়নি। কলেজ প্রেমের সেই সম্পর্ক নানা অনিবার্য কারণে ভেঙ্গে যায়।  

কিন্তু দীর্ঘদিন আগের সেই স্মৃতি এই মধ্য ষাটের সমরেশকে কিসের এক মায়ায় যেন বেঁধে ফেলতে চাইছে। কাজরির নরম হাতের স্পর্শ মনে পড়ে সমরেশের। আবার ভাবেন, না না, এখন এসবের পাগলামির মানেঙ্কী? স্ত্রী চন্দ্রার ভালবাসায়  সম্পৃক্ত হয়ে আছে তাঁর জীবন। চন্দ্রার স্পর্শে ভালোবাসা পেয়েছেন, কন্যা মৌপিয়া হওয়ার পর সেই একরত্তি শিশুকন্যার স্পর্শে অনুভব করেছেন পিতৃত্বের আনন্দ, অপত্য স্নেহ। আর মৌপিয়ার দু’বছরের শিশুপুত্র, তাঁর নাতির স্পর্শে যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফেলার আস্বাদ। ভাইরাস এবং মহামারী তাঁকে এই  বৃত্তের বাইরে প্রায় নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমরেশ আবার ফিরে এসেছেন নিজের বলয়ে। ডক্টর ব্যানার্জির স্পর্শে তিনি পেয়েছেন পুনর্জীবনের আশ্বাস।

পাঞ্জাবীর বোতাম আটকাতে আটকাতে মনে মনে একচোট হেসেই ফেলেন সমরেশ। কাকে না কাকে দেখে এই বুড়ো বয়সে পুরনো প্রেমের কথা উথলে উঠছে! ছিঃ সমরেশ, তুমি না এখন দাদু হয়ে গেছ? সমরেশ নিজেই নিজেকে শাসন করলেন।  


1 টি মন্তব্য: