কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৯ |
গাছজীবন
গাছের শখ দুজনেরই। তবে ক্ষেত্র আলাদা আলাদা। মুনিয়ার বাগান আর সায়কের উঠোন। দুজনেই বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছে নিজের নিজের জমিতে। ফুলগাছ যেমন আছে, তেমন আছে ফলগাছ, আবার পাশাপাশি আছে তরকারিগাছ। মুনিয়া ও সায়ক দুজনেই ব্যাংককর্মী। দুটি ব্যাংক আলাদা হলেও ব্যাংক দুটির অবস্থান মুখোমুখি। বিকেলে ছুটির পর হেঁটে হেঁটে দুজনেই একসঙ্গে বাজারে যায়। সংসারের টুকিটাকি কেনাকাটা প্রায় প্রতিদিনই থাকে। আর থাকে চারাগাছ বিক্রির দোকানে ঢুঁ মারা। রোজই যে চারাগাছ কেনে, তা নয়, তবু একবার না গেলে যেন শান্তি হয় না। যেমন অশান্তি লাগে সন্ধ্যে নাগাদ ঘরে ফিরে চা-জলখাবার খেয়ে গাছেদের গোড়ায় জল না দিলে বা গাছেদের পরিচর্যা না করলে। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেও। দুজনেই চোখ-মুখ ধুয়ে হাজিরা দেয় বাগানে আর উঠোনে। আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়। গাছেদের আদর করতে করতে নিজেরাও গাছেদের আদর খায়।
মুনিয়া মাঝে মাঝে অনুযোগ করে, আমি ঠিক বুঝতে পারি না সায়ক, তুমি ঐ ছোট্ট উঠোনে গাছ লাগিয়ে কী সুখ পাও! উঠোনে গেলে তো আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। চারিদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেভাবে রোদ ঢোকে না। হাওয়া ঢুকতে বাধা পায়। তোমার গাছেদের দিকে তাকালে আমার খুব কষ্ট হয়। ওরাও খুব কষ্টে আছে সায়ক। আর আমার বাগানের গাছেদের দেখো, তারা রোদে হাওয়ায় সারাদিন হাসছে খেলছে দোল খাচ্ছে। কত আনন্দে আছে।
মুনিয়ার কথায় সায়ক রাগ করে না। বরং হেসে বলে, হ্যাঁ মুনিয়া, বাগানে তোমার গাছেরা সত্যিই খুব আনন্দে আছে, দেখে আমারও আনন্দ লাগে। কিন্তু তুমি যে বললে উঠোনে আমার গাছেরা কষ্টে আছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। তারাও খুব আনন্দেই আছে।
মুনিয়া প্রতিবাদ জানায়। -না সায়ক, তোমার গাছেদের মতো তুমি নিজেকেও একটা ঘেরাটোপের মধ্যে বদ্ধ করে রেখেছ। আর সেই বদ্ধতার মধ্যে তুমি আনন্দ হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছ, যা আসলে কষ্টেরই সামিল। আসলে তুমি তা স্বীকার করতে চাইছ না, ভয় পাচ্ছ।
-আচ্ছা মুনিয়া, তুমি আমাকে বল তো, এই যে তুমি বাগানের মতোই তোমার বাইরের জগতে সমানেই ছুটে বেড়াচ্ছ, নিজের ভেতরের দিকে তাকাবার ফুরসৎও পাচ্ছ না, তুমি কি মনে কর তাতে তোমার আনন্দ ঠিক ধরা পড়ছে, নাকি অধরা থেকে যাচ্ছে?
দেখতে দেখতে তাদের দাম্পত্য জীবনের চার-চারটে বছর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু মুনিয়া এবং সায়ক দুজনেই বোঝে, তাদের প্রতিদিনের কর্মজীবন ও গার্হ্যস্থজীবন মোটামুটি সমঝোতা করে চললেও, কোথাও যেন একটা দূরত্ব থেকেই গেছে। বিয়ের আগে মুনিয়ার ছিল বহির্মুখি জীবনযাপন। কিছুটা উন্মাদনা, কিছুটা উৎশৃঙ্খলতা। একাধিক পুরুষের প্রবেশ ও প্রস্থান। অথচ বিয়ের আগে সায়কের অবস্থান ছিল ঠিক বিপরীত মানসিকতায়। অন্তুর্মুখিন সায়ক শুধু নিজের অন্তরমহল নিয়েই তৃপ্ত ছিল। সেখানে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি কোনো নারী।
বিয়েটা হয়েছিল কিন্তু দুজনেরই সম্মতিতে। প্রায়ই তাদের দেখা হতো বাজারে সেই চারাগাছের দোকানে। তখন তারা অবশ্য নিজের বাড়ির জমিতেই গাছ লাগাতো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন