বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

সুবল দত্ত

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৮



মুক্তি  

                                      

‘আমি চান কইরব্য গো শান বাঁধা ঘাটে / আমার মা দিয়েছে বাটিতে তেল কাঁচা  হলুদ বাঁট্যে’। মাসির গান তখন উচ্চস্বরে। অটো ড্রাইভারের দাঁত বেরকরা  হাসিমুখ রেয়ার মিররে। গাড়িও যেন খুশিতে বেগবান। মাসিকে এতো খুশি কখনো দেখেনি দীপা। দীর্ঘ পাঁচ বছরে তো হাসপাতালই তার বাসভবন। কপালে গালে চিবুকে চিরস্থায়ী যন্ত্রণার ভাঁজ। দীপার এই মাসি ছাড়া আর তেমন  আপনজন কেউ নেই। পিতৃ-মাতৃচ্যুত কলমকরা গাছের মত মাসির সান্নিধ্যে  বেড়ে উঠেছে সে।

-‘আঃ অনেকদিন পরে আইজক্যে খুব করে সিনাব বুঝলি। তোর ওই ইটালিয়ান শ্যাম্পু আর ফ্রেঞ্চ ল্যাভেণ্ডার আফটার বাথ আমাকে দিস তো? ওগুলো জন্মে কখনো মাখি নাই। আর সিনান করে, বুঝলি দীপা, তোর মেসোর দেওয়া মিলিটারি সেন্ট আজ লাগাবোই। ও বেঁচে থাকতে কখনো লাগাই নাই। তাথে কি? আমি আইজক্যে খুব খুব সাইজব্য। আমি আজ ছাড়া পাইয়েছি গো? আমার পড়শীরা যদি বলে, হঃ দেখ ন ভালা গরবে মরে যাচ্ছ্যে, তাইলে শুন। ‘গরব করব্য নাই ত কি? / গরবের মরাই বান্ধ্যেছি / আমি যদি গরব করি / তোর বাপের কি’। মাসি আবার গান ধরে।

মাসির খুশি উপচে পড়ছে। দীপা তত ঝিম মেরে যাচ্ছে। মাসির সাথে অন্তরের টান কতটা? কত ফ্যাদম? কতটা গভীরে গেলে চোখ থেকে জল উপচে পড়বে? চোখের জল শুকিয়ে গেছে নাকি? বাসস্থানের মায়া আর অনুভূতিতে আসেনা। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া কি আর মর্মে বিধঁবে না? আমি কি পাথর হয়ে গেলাম? এই ভাবতেই দীপার চোখে জল আসি আসি করে। তক্ষুনি চেপে যায় মাসির ডাকে। মাসি ঠেট খোরটা বাংলায় গাল দিয়ে মুখ ঝামটা দিল,

-কালা বঠিস নকি দামড়ি? হেন্দে হুন্দে ভালছিস? হামার কথা কানে ঢুইকছে নাই?

দীপা হেসে ফেলে, কিন্তু চোখে জল উপচে পড়ার আগেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মাসি ডিস্ট্রিক্ট সেশন জজ ছিল। অবসর নেওয়ার পরই কঠিন ব্যামো। কিন্তু ওই অবস্থাতেই ভারতের নানা জায়গা থেকে ফোন আসে। জটিল কেসগুলোর কানুনী মীমাংসা জানতে চায়। বলতে গেলে বার-লাইব্রেরীতে রাখা সব কোডগুলো মুখস্ত। এই চলন্ত সজীব এনসাইক্লোপিডিয়া ক’দিন পরই ভ্যানিশ?

-‘ডাকতর কি বইলল শুনলি ন দীপা? আমার আর কনঅ ওষুধ নাই লাইগব্যাক। হাসপাতালের ল্যাঠা চুইকল্য। আমি যা খুশি খাত্যে মাইখত্যে পইরত্যে পারি। আমার আর কনঅ রোগ নাই রে ছঁড়ি। দেখ টুকু ভাল। আমি তর ল্যাও জুয়ান’।

এই বলে দুহাত ছুঁড়ে মাসি বাড়ি ফিরে কি কি খাবে, কি কি পরবে আর বাগানে কি ফুলগাছ লাগাবে এইসব অনর্গল ফিরিস্তি গাঁইয়া ভাষায় গাইতে লাগল। মাসির যেমন কথা, হুবহু তার বিপরীত সিদ্ধান্ত দীপার মনের ভিতর চলতে লাগল। মাসির মুখের দিকে চেয়ে থেকে কঠোর সত্য বুঝতে চেষ্টা করলো। ওর মুখে আগুন দীপাকেই দিতে হবে, ব্রাহ্মণের নিদান পনেরো দিন অশৌচ পালন, কাকে কাকে ‘ওঁগঙ্গা’ চিঠি পাঠাতে হবে ইত্যাদি। আর বেশিদিন নয়। ডাক্তার  বলেছে ম্যাক্সিমাম পনেরো দিন।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন