কৃষ্ণ বস্তু, শক্তি ইত্যাদি...
সত্যি মিথ্যা, সুখ দুঃখ, ভালো খারাপ এসব ভার্চুয়াল প্যারামিটারগুলো ছাড়াও ফিজিক্যাল বা আমাদের দৃশ্যমান কিছু প্যারামিটার যেমন ধরুন - ছেলে মেয়ে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈপরীত্য লক্ষ্য করতে পারবেন। বৈপরীত্য আমাদের জীবনের উপলব্ধি থেকে শুরু করে অনুভব সর্বক্ষেত্রে সদাই বিদ্যমান। ঠিক আপনার উপলব্ধির মতোই প্রকৃতির ক্ষেত্রেও একই ভাবে বস্তু ও বিপরীত বস্তু সর্বদাই বিদ্যমান। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের এই গোটা ইউনিভার্সের ৫ শতাংশ আমরা এতদিনে উদঘাটন করতে পেরেছি বা খোঁজ পেয়েছি, সোজা কথায় এখনো আমাদের আবিষ্কৃত যন্ত্র দ্বারা যাকে দেখতে পেয়েছি আমরা। বাকী ৯৫ শতাংশ কিন্তু আমাদের কাছে সম্পুর্ণ অজানা, অদেখা। কিন্তু পদার্থবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, আমরা দেখতে পাই না মানে এই নয় যে তার স্থায়ীত্বকে আমরা অস্বীকার করতে পারি, বরং অনেকে গাণিতিক দর্শন দিয়েছেন এর সপক্ষে। এই ৯৫ শতাংশ বস্তুর ২৫ শতাংশ হলো কৃষ্ণবস্তু বা ডার্ক ম্যাটার, আর বাকী ৭০ শতাংশ হলো কৃষ্ণশক্তি বা ডার্ক এনার্জি।
আমাদের দৃশ্যমান চাঁদ সূর্য তারা বা অন্যান্য গ্যালাক্সি সবই প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি, কিন্তু তা তো মাত্র ৫ শতাংশ, বাকী ৯৫টা কিন্তু যার অধিকারে, তাকে আজও আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু তার যথেষ্ট প্রমাণ ও গাণিতিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে পেয়েছেন। এই যেমন দেখা গেছে নক্ষত্র কক্ষপথ যতই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূর হোক, তার গতিবেগ মোটামুটি সমান, সুতরাং শুধু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব থাকলে এটা সম্ভব নয়, বরং এমন কোনো শক্তি আছে যা মাধ্যাকর্ষণ বলকে প্রতিহত করছে। বিজ্ঞানীরা এই শক্তিকেই ডার্ক এনার্জি বলছেন। এছাড়াও মহাকাশে অনেক সময় গ্র্যাভিটেশনল লেন্সিং দেখা গেছে যেটাকে বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণবস্তুর মেঘ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই কৃষ্বস্তু এমন একটা জিনিস যা মাধ্যাকর্ষণ বল অথবা আলোর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে প্রতিহত করে, যার জন্য একে আমরা দেখতেও পাই না। বলাই বাহুল্য, আমরা টেকনিক্যালি ততটা উন্নত হইনি। বিজ্ঞানীদের মতে, এরা একটা অ্যান্টি গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স নিঃসরণ করে। আবার আর একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, ডার্ক এনার্জি গ্র্যাভিটশনাল শক্তিরই আর এক রকমের প্রকারভেদ যা আমরা অনুভব করতে পারি না।
এই ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জির পেছনে আরও একটি বড় কারণ হলো ক্রমবর্ধমান মহাবিশ্ব তত্ত্ব। শুধু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব এই মহাবিশ্বের উপর থাকলে তা ক্রমশ বাড়তে পারতো না, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে এই বৃদ্ধি প্রতিহত হতো, কিন্তু বাস্তবে তা আদতে হচ্ছে না। বিজ্ঞানীদের মতে মহাবিশ্বের এই ক্রমবর্ধমান চরিত্র কোনো এক শক্তির প্রভাবে হচ্ছে যেটা মাধ্যাকর্ষণকে প্রতিহত করে ইউনিভার্সকে বাড়তে সাহায্য করছে। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বে প্রথমে এক কস্মোলোজিকাল ধ্রুবক ব্যবহার করেন, যেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এই ধ্রুবকপদ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বৈপরীত্য। পরবর্তী কালে তিনি নিজের এই ধারণাকে ব্লান্ডার আখ্যা দিয়ে ধ্রুবক পদকে সরিয়ে দেন, যখন প্রমাণিত হয় মহাবিশ্ব ক্রমবর্ধমান।
যেহেতু ডার্ক ম্যাটার-এর উপর কোনো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড কাজ করে না, তাই একে আমরা কিছুতেই দেখতে পাই না। অনেকে এই বিষয়টাকে প্যারালাল ইউনিভার্স-এর সঙ্গে যুক্ত করে কিছু তত্ত্ব দিয়েছেন, যেখানে তাঁরা বলেছেন, আমাদের চারপাশেই অসংখ্য ইউনিভার্স হয়তো বিদ্যমান, কিন্তু ডার্ক ম্যাটার-এর জন্য তাকে আমরা দেখতে পাই না।
এই ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে তৈরি, তা নিয়ে এখনো কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানীরা পৌঁছতে পারেননি, সব তত্ত্বই হাইপোথিসিস পর্যায়ে আছে। তবে এটুকু তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এই ডার্ক ম্যাটার নন-ব্যারনিক ম্যাটার অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রন ছাড়া অন্যান্য ম্যাটার দিয়ে তৈরি হতে পারে। কেউ বলেছেন, আক্সিয়ন। কেউ বলেছেন, স্টিরাইল নিউট্রিনো অথবা এসবের বাইরে গিয়ে অনেকে বলেছেন, মডিফাইড গ্র্যাভিটেশনাল টেনসর দিয়ে তৈরি। এই ডার্ক ম্যাটারের মধ্যেও অনেক ভাগ আছে, কোল্ড ডার্ক ম্যাটার বা ওয়ার্ম ডার্ক ম্যাটার। এগুলো সবই তাদের গঠনগত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে, কিন্তু ওই একই ব্যাপার, সবই এখনো হাইপোথিসিস পর্যায়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন