সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 

ম্যানারিজিম - স্বল্প সময়ের নির্ভীক ভাষ্য




(৫)

ম্যানারিজমের প্রভাব যখন ইতালীতে প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে তখনই  ব্রেনজিনোর (১৫০৩-৭২) কাজ নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটায়। মেডিসি রাজপরিবারের সদস্যদের প্রতিকৃতিগুলো আঁকার মধ্য দিয়ে গ্র্যার্বো ও পন্টোরমোর ছাত্র অ্যাগনোলো ব্রেনজিনো ইতিহাসের একটি সময়ের স্বাক্ষী হয়ে আছেন। তাঁর আঁকা প্রতিকৃতিগুলো ছকে বাঁধা, ভাবাবেগহীন শীতল, অত্যধিক মাত্রায় রিয়ালিস্টিক হওয়ার পাশাপাশি ভয়ানকভাবেই বাস্তবতার সকল উপাদান থেকেই যেন অনুষঙ্গহীন। প্রতিটি প্রতিকৃতির পোষাক অধিক ভারযুক্ত ও অলঙ্কার আধিক্যপূর্ণ। যা আভিজাত্য সম্ভ্রমের পাশাপাশি ঔদ্ধত্যের সামাজিক যাপনের ভাষ্য বহন করে।

আবার ম্যাজিকটা হলো এই যে, ব্রেনজিনো যখন ধর্মীয় বিষয়কে ভিত্তি করে ছবি  করেছেন তখন সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে ভাবাবেগের অতিশয্য উচ্ছ্বাস ও উচ্চকিত  প্রকাশভঙ্গিমা। শারীরিক গঠনে অত্যধিক জটিলতা, চরিত্রের সমাবেশ, নাটকীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে ব্রেনজিনোর কাজে প্রচলিত ধর্মীয় প্রথার প্রতি বিদ্রুপের প্রকাশ স্পষ্ট। ব্রেনজিনোর কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর গাঢ় অন্ধকারঘেরা ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে অপেক্ষাকৃত হালকা রঙের মূর্ছনায় সৃষ্ট শরীর। ট্রিট্মেন্টের  ক্ষেত্রে সুচারু যত্নের ছাপ এতোটাই নিপুণ যে তুলির দাগই আলাদা করে তাঁর কাজে  দেখা যায় না। তাঁর কাজের উত্তরসূরী ছিলেন মিখায়েল ডাহল, দমিনিখ ইংগ্রেইস, অ্যালেসসান্দ্রো অ্যালেরি প্রমুখরা। এছাড়া ব্রেনজিনোর বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - সেইন্ট সাবেস্টেইন, পবিত্র পরিবার, ১৫৪১- ৬০ সালের মধ্যে আঁকা অসংখ্য প্রতিকৃতি, এছাড়া ধর্মীয় বিষয়ের কাজ ডেপজিশন অব ক্রাইস্ট, ভেনাস, কিউপিড ফলি এবং টাইম।

ম্যানারিজমের প্রধান গুরুত্ব, শিল্পরীতি ও শৈল্পিক ভাবনার মূলে আঘাত করতে সক্ষম হওয়া। শিল্পবোধক কতগুলি অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নের সন্মুখীন যেমন করতে  পেরেছিলো ঠিক তেমনি কতগুলি প্রশ্ন যা তৎকালীন চিত্র জগতে দানা বেঁধেছিলো  তার থেকে মুক্তি ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিলো। যেমন রেনেসাঁর পর নতুন কী আর শিল্পের মাত্রিকতায় যুক্ত হবে – বাস্তববাদ তার শীর্ষসীমা অর্জন করে ফেলেছিলো, আবার ম্যানারিজম কল্পনার জগতে ক্যানভাসে ভাবনার প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরায় এক অনন্য বিশ্বের সন্ধান যেন আগামী পৃথিবীর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়। এরকম সময়ে চিত্রশৈলীর ক্ষেত্রে তিনতোরেত্তোর কাজ স্বকীয়তা দ্বারা সঞ্চালিত, যেমন অ্যাডোরেশন অব দ্য মেজাইয়ের অবয়ব ও তার ধর্মীয় অনুষঙ্গকে নতুন মাত্রা প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্পীর সাহসিকতার প্রকাশ ছিলো যুগের তুলনায় অনেক এগিয়ে। সান ফেস্কোতে তাঁর বিশালাকার ছবিগুলো ইতিহাসে চিরবিস্ময়।  ১৫৬০ সালে আঁকা ‘দ্য ডেলিভারেন্স অব অ্যারসনে’ তিনতোরেত্তোর কাজের মধ্যে  ব্যতিক্রমী। এই ছবির চলনের গতি তথা মোমেন্টাম ও ব্যালান্স এক অনবদ্য সম্পদ। বহুমাত্রিকতা ছবিটিতে যে ছন্দ নিয়ে এসেছে তা এক কথায় সকল প্রথাগত শিল্প জগতের পরিধির বাইরে নিয়ে যেতে সক্ষম। বিশেষ করে ছবিতে নগ্নতার মধ্য দিয়ে যে আলোর সঞ্চার করা হয়েছে ও তার বন্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখা হয়েছে তা সে সময়ের তুলনায় অনেক বেশী বাঙ্ময়।



আবার ব্যতিক্রমী শক্তিশালী পারসপেক্টিভ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সমাদৃত তিনতোরেত্তো ছিলেন তিশিয়ান ও আন্দ্রিয়া শ্চিয়াভনের অনুরাগী। ১৫৪৬ সাল হতে প্রধান তিনটি কাজ করেন ‘দ্য ওরশিপ অব দ্য গোল্ডেন কাল্ভ’, ‘দ্য প্রেসেনটেশন অব দ্য ভারজিন ইন দ্য টেম্পেল’ ও ‘লাস্ট জাজমেন্ট’ নামে। তিনতোরেত্তোর শেষ  উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ‘প্যারাডাইস’ যা বাঁধনহীন মননের প্রকাশের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো প্রথাগত ধারণাতে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়নি। ছবির বলিষ্ঠ ট্রিটমেন্টই এর  পরম সম্পদ। মূলত এই শৈলী ছিলো মানুষের বর্হিরঙ্গের অভিব্যক্তির থেকে গভীর, ধূসর, রহস্যময় জগতের দিকে যাত্রার ভিত্তি স্বরূপ। বাইবেলের গল্পের রহস্য উন্মোচনের থেকে চিত্রশৈলী সরে এসে ব্যক্তিমননের গঠন, বিস্তৃতি, বৈষম্য, আলোছায়ার দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতাকে প্রাধান্য দেয়। আপন গতিকে অনুসরণ করে  ভাঙ্গাগড়ার স্বতন্ত্রতা প্রকাশিত হয় মুক্তভাবে।

খ্রীষ্টধর্মে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট বিভাজন ছিলো এক যুগান্তকারী ঘটনা আর ম্যানারিজম তার দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলো। সময়ের যন্ত্রণা টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব, বিড়ম্বনা প্রকাশে ম্যানারিজম অত্যন্ত সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একথাও সত্য যে ম্যানারিস্টদের পক্ষে মতামত প্রকাশ কখনোই খুব সুখকর বা বিতর্কহীন হয়নি, তবুও তাদের লড়াই ও আপোষহীন স্বাধীনচেতা মনোভাবই শ্রেষ্ট ক্যানভাসগুলোকে আমাদের উপহার দিয়েছে। এর একটি উদাহরণ হিসেবে যদি তিনতেরেত্তোর লাস্ট সাপারকে সামনে রাখি তবে বুঝতে সুবিধে হয় কীভাবে ম্যানারিস্ট শৈলী সময়ের যথার্থতার উন্মুক্ত প্রকাশ, তা কখনোই  অতিরঞ্জন, বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি বা ব্যকরণগত ভুলত্রুটি নয়, আগে মনে করা হতো – প্রকৃতপক্ষেই তা সময়ের ভ্রমণের পথে ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবচেতনের অন্বেষণ তার শৈল্পিক প্রকাশের অবসম্ভাবী মুক্তির পথ। তিনতোরেত্তোর লাস্ট সাপারে ফন্ট্রাল ভিউয়ের প্রয়োগ বেশী। উত্তর ইতালীর ভেনাস শহরে সংরক্ষিত ১৫৯২-৯৪ সালে আঁকা ‘লাস্ট সাপার’–এ ম্যানারিজমের নাটকীয়তা, কম্পোজিশনে গসপেল অব জনের অনুষঙ্গ চরিত্রে আবেগের সঞ্চারের ফলে মানবীয়তা, পরিপ্রেক্ষিত ভেঙ্গেছে যতো, গড়েছেও ততোধিক, দৃশ্য জগতে অসাধারণ সকল স্পেসের নির্মাণ একই সঙ্গে বহুমাত্রিক।

লাস্ট সাপারের আলোচনা হলে লিওনার্দোর ছবির তুলনা চলে আসা প্রাসঙ্গিক। ভিঞ্চির লাস্ট সাপার দেখেই ছোট থেকে চোখ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলো, সেখানে শরীরগুলো নিপুণ, ছিমছাম, পরিশীলিত ও ভারসাম্যময়। ছবির বিন্যাস জ্যামিতিক,  পরিসর ভয়ানকভাবে ক্যালকুলেটিভ বা ছকবাঁধা। ভিঞ্চির সকল চরিত্ররাই যেন স্বর্গীয় মহিমায় মহিমান্বিত। দুটো ছবিকে রেখে যদি আলো নিয়ে ভাবা হয় দেখা যাবে তিনতোরেত্তোর ছবিতে আলোর কৌশল চড়া, একাধিক উৎস এনেছে অপরূপ মহিমার ত্রিমাত্রিকতা, স্বর্গীয় চরিত্র যীশুর সংযোজন যেখানে কল্পস্তরের নতুন অভিব্যক্তি। এই লাস্ট সাপারই প্রথম আকৃষ্ট করেছিলো আমাকে ছবির নানান দিকগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে, বড় অন্যরকম লেগেছিলো ভিঞ্চির লাস্ট সাপার দেখে অভ্যস্ত চোখের কাছে এই ছবি, আর তার সূত্র ধরে খুঁজতে বেড়িয়ে ম্যানারিজমের বিস্ময়কর দুনিয়াটার ক্রমো উন্মোচন এক অনাবিল আনন্দ।



যত বিষয়টিকে জানতে চেয়েছি ততোই আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে মনে প্রশ্ন ভীড় করে এসেছে যে, ম্যানারিজম সত্যিই কি শিল্পকে অসংগতি, বিশৃঙ্খ্লতার অতিরিক্ত কিছু  দিতে পেরেছে? ইউরোপীয় চিত্রকলার ইতিহাসের আলোচনায় কি সত্যিই অবজেক্টিভিটি সর্বশেষ কথা হতে পারে? নতুন করে এ জগতকে ছুঁয়ে দেখা কেন সম্ভব হবে না? একটা সময় পর্যন্ত ম্যানারিজমকে আলাদা করে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হতো না। মনে করা হতো রেনেসাঁ ছবিকে অতিক্রম করতে না পারার হতাশায় ছবিগুলো ঐরূপ হাস্যাস্পদ, অতিরঞ্জিত আকার নিয়েছে। কিন্তু যখন  আবার একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে এই ছবিগুলোকেই দেখা হয় তখন কিন্তু উপলদ্ধি করা যায় যে ম্যানারিজমের আশি বছরের ছবির ইতিহাস ছিলো সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন