কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৬ |
পথে হলো দেরী
কতবার তো তোমায় আমি বারণ করেছি, তুমি এসো না আমার কাছে! এসে কী লাভ? দেরি করে ফেলেছ তুমি সাত্যকি! অনেক দেরি করে ফেলেছ! যখন তোমার অপেক্ষায় একটার পর একটা দিন কী ভীষণ উদ্বেগ আর আকাঙ্ক্ষায় আমি ক্ষত বিক্ষত হয়েছি, তখন তুমি আসতে পারোনি! আজ যখন সেই উদ্বেগ আর আকাঙ্ক্ষা একটুও নেই, একেবারেই উবে গেছে, তখন আর আমার কাছে তোমার আসার কোনো প্রাসঙ্গিকতা যেমন নেই, প্রয়োজনও নেই। ভালোবাসার যে আগুন একসময় আমার সারাটা দেহ-মন জুড়ে তোমার জন্য দাউদাউ করে জ্বলত, দাহ্যবস্তু না পেয়ে পেয়ে ক্রমশ তার তাপ-উত্তাপ কমে এসেছে। তারপর একসময় তা নিভেও গেছে। একটা অভূতপূর্ব শৈত্য তাকে গ্রাস করেছে। তোমাকে এতবার বারণ করা সত্ত্বেও তুমি তাহলে আজ এসেছ কেন আমার কাছে? তুমি চলে যাও সাত্যকি। আর কখনও এসো না। আমি এখন সম্পর্কে কারও স্ত্রী, কারও মা, এমন কী কারও দিদাও। তোমাকে আমি আমার এই বৃত্তে কখনই প্রবেশাধিকার দিতে পারি না!
তুমি যখন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ মহুল, চলে যেতে বলছ, আমি চলেই যাব। আর কখনও ফিরেও আসব না। হ্যাঁ, এর আগে যতবার তোমার কাছে আমি আসতে চেয়েছি, তুমি বারণ করেছ। আমি তোমার সে বারণ কখনও অমান্য করিনি। কিন্ত তারপর আমার মনে হলো, যদি একবার অন্তত আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়, তাহলে আমার বিগত জীবনের আক্ষেপ থেকে হয়তো আমি কিছুটা হলেও শান্ত হতে পারব। তবে তুমি একথা কখনই ভেবো না মহুল যে, শুধু তুমিই সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে মরেছ! আমার শরীর ও মনেও সেই একই আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলত। সেদিন তুমিই ছিলে আমার একমাত্র কাম্য নারী। কিন্তু ব্যক্তিগত সেই কামনা বাসনার থেকেও তীব্র ছিল আমাদের দলের মতাদর্শ ও লক্ষ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং লড়াই। গভীর অরণ্যে দলের অজ্ঞাতবাসের সেই দিনগুলিতে তুমিও তো ছিলে আমাদের সহযোদ্ধা! আমরা বন্দুক হাতে লড়াই করেছিলাম পাশাপাশি পজিশন নিয়ে। শ্রেণীশত্রু শিবিরে দলের নির্দেশে আমরা একইসঙ্গে হানা দিয়েছি কতবার! লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে আমরা ঠিক করেছিলাম, যেদিন আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে, সেদিনই আমরা মিলিত হব, প্রথম শারীরিক সঙ্গম আস্বাদন করব, আমরা ঘর বাঁধব। আমিও যে তোমাকে প্রচন্ড ভালোবেসেছিলাম মহুল!
কিন্তু সাত্যকি, আমার পক্ষে এভাবে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তুমি এবং পার্টি কমরেডরা জানতে, আমার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। গায়নোজিক্যাল কিছু সমস্যায় আমি বিপর্যস্ত। শরীর দিনদিন খারাপ হচ্ছে। আমি কিন্তু দল থেকে পালিয়ে আসিনি সাত্যকি। দলই আমাকে রেহাই দিয়েছে। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, একদিন তুমিও চলে আসবে। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘদিন। কেননা তুমিই ছিলে আমার একমাত্র কাম্যপুরুষ। কিন্তু তুমি কথা রাখতে পারোনি। যোগাযোগও রাখনি।
হ্যাঁ, মহুল। কথা আমি রাখতে পারিনি। আসলে কোনো উপায়ও ছিল না। গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েছিলাম। তারপর জেলবন্দী ছিলাম। দলের কাজে আমি আজও দায়বদ্ধ।
আমইও এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী ছিলাম।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনজীবনে কোথায় যে কত হেতুতে দেরী হয়ে যায় আর হারিয়ে যেতে থাকে সব আলো, বুঝতেই পারি না আমরা!