কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৬ |
বড়দি
আয়ু অর্ধেকেরও বেশি পার হয়ে এসেছি। এখন অন্ধকার ভালো লাগে। অন্ধকার স্মৃতির সরণী ধরে এক’পা দু’পা পিছিয়ে এগোয়। অতীতের দিনগুলিতে মস্তিষ্কও আকরে প্রকারে যেরকম হয়, ভাবাবেগ আবেগপ্রবণ। আলোছায়াই প্রকৃতির যে রূপ!
গ্রীষ্মের পসরা বৃষ্টির পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যেটুকু, শান্ত হতেই বাঁধভাঙা হাসির জোয়ার নিয়ে দক্ষিণ পূর্ব ঘেঁষে চাঁদ উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার রহস্য।
হলে কী হয়, ঐ দূর-দুরান্ত বাসরাস্তা আড়াল করা বহু প্রাচীন বৃক্ষসারি সারবেয়ে দেয়াল গড়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নার আবছা মৃদুআলো নিঃঝুম। আমাদের পরিবারটির অবস্থা খানিক ঐ প্রাচীন বৃক্ষের মতোই। শাখা-প্রশাখায় ভরপুর, বাবা-মা-ঠাকুরদা। এই প্রবীনদের বাদে বড়দিই আমাদের অভিভাবক। সেই সময় ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তোষক পেতে ঢালাও বিছানা। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত বড়দির গল্প। বড়দি ঘুমিয়ে পড়লে বাবা-মা'র গল্প। বাবা ছিলেন ঈশ্বর বিশ্বাসী। তাই নিজে থেকে বিকল্প চিন্তা মাথাতে আনতেই চান না ঠাকুরদার মতোই।
আমি ডানপিটে, তাই আমার মানুষ হওয়ার চিন্তা পরিবারের সবার। দৈহিক শক্তিতে চ্যালেঞ্জ জানাতে কেউ সাহস করতো না। আমার একটি গুণ, কারো চোখে পড়ত না কেন জানি না, আমার ধৈর্য্যের গুণ, অন্তরবিদারি ভালোবাসার ক্ষমতা। শুধু একটিই বদগুণ সবার কপালে ভাঁজ্ ফেলতো, ভবঘুরে আর আবেগ প্রবণতা। কালের নিয়মে এক এক করে ঠাকুরদা, বাব্ মা, বড়দ্ বড়দি। আমরা আর তাঁদের মত ছায়াদার বটগাছ হইনি। হতে চাইওনি সময়ের চাহিদায়। আমরা তাল নারকেলের মতো লম্বা হয়েছি, বংশ বৃদ্ধি করিনি। শাখ-প্রশাখা ছড়িয়ে দিইনি। ফলে নতুন স্বপ্ন, নতুন দিগন্ত।
তাই এখন ক্রমশ একাকিত্ব চারিদিকে অতিমারির প্রকোপ পেন্ডামিক, কোরোনা ভাইরাস। গৃহবন্দি দশা, যে যার কাজে ব্যস্ত, ওয়ার্ক ফর হোম, কর্পোরেটের কাজ। বসার সময় আছে, ওঠার নয়। কাজের বরাতও নেই। ওপিনিং নেই মানে অন্য কাজের আশা ভরসাও নেই।
স্মৃতি বিজড়িত সময় নির্ভর। বাইরের জগত এখন অধরা মাধুরী। অন্ধকার ভালো লাগে। জ্বলজ্বল করে হারানো স্মৃতিগুলো স্মৃতির সরণী ধরে এক’পা দু’পা করে এগোতে এগোতে হারিয়ে যেতে থাকি। আপাদমস্তক নিজেকে আবরণে ঢেকে ফেলি। যেভাবে আক্রান্তদের বেঁধে রাখা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন