রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

তথাগত চট্টোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৪


ব্যবধান

 

কল্যাণী স্টেশনে অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনটা। প্যাসেঞ্জার গাড়ি, তাই ভীড়ও অনেক। বিজিত অনেকদিন বাদে আবার বহরমপুর যাচ্ছে। তার  উল্টোদিকের সিটেই বসে আছে একজন সুবেশা তরুণী। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ  বছর আগে বিজিতের নিয়মিত যাতায়াত ছিল পূর্ব রেলের এই শাখায়। কারণ  কর্মসূত্রে তখন তাকে বহরমপুরে থাকতে হত। জীবন এবং কর্মজীবন দুই-ই ধীরে ধীরে অভিমুখ বদলেছে। ভিন্ন জেলায় বদলী হয়ে বহরমপুর শহরও সে ছেড়ে এসেছে অনেকদিন আগে। আপাতত কলকাতায় থিতু হলেও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার সদরে অফিসের কাজে মাঝে মাঝেই আসতে হয়। সেই সূত্রেই  বিজিতের আজ আবার বহরমপুর যাত্রা। মাঝে আছে প্রায় পঁচিশ বছরের ব্যবধান।

গাড়ি থেমে থাকার সঠিক কারণ জানা যাচ্ছিল না। বিজিতও ভেতরে ভেতরে  অস্বস্তি অনুভব করছিল। তখনই তার মনে পড়ে প্রথম যৌবনের বহরমপুর যাতায়াতের একটি দিনের কথা। সেবারও কল্যাণী স্টেশনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্যাসেঞ্জার গাড়িটি। তরু্ণ বিজিতের ঠিক পাশেই বসছিল এক সুন্দরী তরুণী। তার হাতে ছিল একটি বই। মগ্ন হয়ে ছিল তাতে। দীর্ঘ সময়ের সেই  যাত্রা বিরতিতে কামরার যাত্রীদের মধ্যে প্রকট হচ্ছিল স্বাভাবিক বিরক্তি। বিজিতেরও একই অবস্থা। পঁচিশ বছর আগে মোবাইল কোথায়, কোথায় সামাজিক মাধ্যম, যাতে বুঁদ হয়ে থাকবে সবাই? কিন্তু সেই তরুণীর মধ্যে কোনও বিরক্তির ভাব দেখা যাচ্ছিল না। অসীম মনোযোগে পাঠরতা ছিল সে।

আজও দিনটা যেন অনেকটাই সেরকম। সেই কল্যাণী স্টেশন, সেই প্যাসেঞ্জার গাড়ি, বিজিতের বিপরীতে  বসে থাকা এক সুন্দরী তরুণী, হঠাৎই ট্রেনের দাঁড়িয়ে যাওয়া আর কামরার যাত্রীদের  উৎকণ্ঠা। কিন্তু মাঝে আছে পঁচিশ বছরের ব্যবধান।  

আজ সকলের হাতেই মোবাইল। গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার জন্য গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে  যে অনিবার্য দেরী হতে চলেছে, সেই খবরই আদানপ্রদান করছে সবাই। কেউ  কেউ জানতে চাইছে এই স্তব্ধতার পেছনে যান্ত্রিক গোলযোগ আছে, নাকি অন্য কোনো কারণ! হঠাৎই বিজিতের নজর গেল তার উল্টোদিকে বসা তরুণীর  দিকে। হাতে তার স্মার্টফোন। মাথা নিচু করে গেম খেলায় মগ্ন। বিজিত নিজের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দেখল কামরার সামনে ও পেছনে যতদূর তার চোখ যায়, প্রায় প্রত্যেকের হাতেই স্মার্টফোন। বিজিতের খুব ইচ্ছে হল পুরো  কামরাটা ঘুরে দেখতে। অন্তত একজন যাত্রী পাওয়া যায় কিনা যে মগ্ন হয়ে আছে কোনো বইতে!   

 

 

 


1 টি মন্তব্য: