রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

দেবযানী বসু

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৪


গুটিপোকা

আজকাল মৃদু মলয়ে কেঁদে ও কেঁপে ওঠে দরজা জানালা। খই যোগান দেওয়া বাতাস জানলার প্রাচীন উৎসে গিয়ে আমগাছের ছবি অ্যালবাম খুঁজে পায়। রিনিতা এইভাবেই মায়ের শেষ দিন কটা অথবা দিনের শেষটুকু আগলে বসে থাকে। রিনিতা ছোট মেয়ে। সে কিছুতেই মাকে এড়াতে পারে নি। মায়ের মৎস্যকন্যা হয়ে যাবার সময়ে সে ছিল দশ বছরের বালিকা। অজয় নদীর বালি নিয়ে খেলতে খেলতে মা একতারার তারে ঠোঁট আর আঙুল কেটে ফেলল। সেই রক্ত বন্ধ হয় নি। বাঁধনির সিল্ক শাড়ি ভিজে যেত পূর্ণিমা অমাবস্যার গন্ডগোলে। পাড়ার দিদারা কপাল চাপড়ে বলত রাক্ষস ফেসবুক নাকি মাকে খেয়ে ফেলেছে। এত দামি দামি উপহার বাবা কখনো মাকে দেয় নি। বাবা ছিল অল রাউন্ডার। এই সাজানো বাড়ি আর বড়দিকে বিয়ে দিয়ে বাবা আত্মীয় স্বজনের কাছে হিরো হয়ে উঠল। কাকা আর পিসি মিলে বাবারা এগারোজন। অসম্ভব মেরুপ্রভায় ভেসে ভেসে সম্পর্ক ঐ আমকাঠের পিঁড়ি চড়ে সংসার করা শুরু করেছিল। সেই প্রেম অজয় নদীর বালি গিলে নিল। তারপর মোহনার বুকে চড়া পড়ার মতো অনেকটা জায়গা বিছানায়। নিস্তরঙ্গ সরবতের গ্লাস সবার বুকে।

দিদি প্রথম জেনেছিল তাপসবাউলের কথা। বোলপুরের চাঁদ আর সারা পৃথিবীর চাঁদে অনেক পার্থক্য। সে ধাতুর মূর্তি গড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে তার আকাশ ছোঁয়া চাহিদা। মায়ের বয়স চিরকাল ছিল গুটিপোকার ভিতর। পঞ্চান্ন থমকে ছিল পঁয়ত্রিশে। কিছু দিন মা মডেল ছিল প্রেমিকের আঁকা ছবিতে তৈরি করা মূর্তিতে।  হ্যাঁ অবশ্যই মা গাড়ি চাইত। তরলমায়া চাইত। পঞ্চতারার হোটেল চাইত। সপ্তাহ শেষে লম্বা রাস্তার জার্নি চাইত তার একটাও বাবা দিতে পারে নি। বিয়ের আগে ও পরে দিয়েছিল শুধু গিটারের ঝংকার। আর ব্যাংকের একটা মোটামুটি চাকরি।

নিস্তরঙ্গ সরবতের গ্লাসে চিড় ধরল। তার ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল মৎস্যকন্যা, রাগী জেদি, অহংকারী। তবে দিদিও আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। যেন নেকড়ের দুধে ভরা জীবন আমাদের।

নেহাৎ করোনা এল দেশে তাই  নগরের বাইরে পরিহার করা বাসবদত্তার মতো মা ফিরে এল বাড়িতে। এতসবের মধ্যেও ডিভোর্স দিতে না চাওয়া বাবা ও সবাই একটানা ঘ্যানঘেনে কান্নায় মানে কথা বলে বলে কান্না শোনায় সকাল বিকেল অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। বড়লোক দিদাদাদুরা মাকে নিয়ে গেল। মনের চিকিৎসা হলে ভালো হতো। পাড়ার দিদারা বলল বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কেউ নেই। যতই পাগল হোক নিজের বাবা মাকে শেষ অব্দি সেবা করেছিল মা। একমাত্র সন্তান  মায়ের আমিই নমিনি। মা শাড়ির ডিজাইন তৈরি করত। বাবা ছোট হিমবাহ থেকে বিশাল হিমবাহে পরিণত হয়েছে এই বৃদ্ধকালে। রিনিতা মায়ের পাশে বসে থাকে আর গুটিপোকা খুঁটে আঁশ বার করে।

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন