রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

অচিন্ত্য দাশ

 

(মসীচিত্র – ৪)


ময়ূররাজা

 



তাপ্তি নদী যেখানে সাগরে মিশিয়াছে সেই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় কারখানা রহিয়াছে। তাহার একটিতে বছর ছয়-সাত কাজ করিয়াছিলাম। কোম্পানীর কলোনিতে থাকিতাম। সে কলোনির একপার্শ্বে তাপ্তি নদী বহিতেছে আর অন্যদিকে জলসিক্ত প্রান্তর। জলসিক্ত কারণ বড় জোয়ার আসিলে সাগরের জল প্রান্তরে ঢুকিয়া পড়ে। ভারতবর্ষ বিরাট দেশ, ইহার পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের পশুপাখি গাছপালা অনেকাংশে ভিন্ন প্রকারের। বহু গাছ চিনিতেই পারিতাম না। চেনা গাছের ভিতর স্থানে স্থানে প্রচুর তালগাছ চোখে পড়িত। কিছু আফ্রিকাখ্যাত বাওবাব গাছও দেখিয়াছিলাম। একসময় এই অঞ্চল আফ্রিকার সহিত যুক্ত ছিল। সিংহ ও হাতি সেই পথে ভারতে আসিয়াছে। কোনো প্রকৃতিপ্রেমিক হাতি হয়তো বাওবাব গাছের চারা লইয়া আসিয়াছিল!

 পোষ্য অথবা বেওয়ারিশ উট গরু-ছাগলের মতো দেখা যাইত। তাহারা আনমনে ঘুরিয়া বেড়াইত এবং উচ্চডালে সবুজ পাতা দেখিলেই গলা বাড়াইয়া খাইতে শুরু করিত। আর ছিল ময়ূর। কোলোনিতে যত্রতত্র তাহাদের বিচরণ। বিশেষ করিয়া প্রভাতে এবং সন্ধ্যা নামিবার পূর্বে। ময়ূরীই বেশি দেখিতাম, বড় মুরগীর ন্যায় এদিকে সেদিকে দৌড়াইয়া বেড়াইতেছে। গাড়ি দেখিলে ভয় পাইত না, তবে গাড়ি হইতে নামিলেই পলাইত। সে তুলনায় ময়ূর কম চোখে পড়িত। হয় ইহারা সংখ্যায় কম ছিল অথবা আড়ালে থাকিত। স্থানীয় লোকজন ময়ূর দেখিলে তাহাকে কাক বা পায়রা হইতে বেশি মর্যাদা দিত না। আমি প্রবাসী, ওইরূপ তাচ্ছিল্য করিতে পারিতাম না। তাড়া না থাকিলে ময়ূর দেখিলে দাঁড়াইয়া পড়িতাম।

তখন গৃহে কয়েকমাস যাবৎ একেলা রহিয়াছি। এক রবিবার দীর্ঘ দিবানিদ্রার পর হাত-পায়ের খিল ছাড়াইতে একটু হাঁটিতে বাহির হইয়াছিলাম। আমাদের রাস্তাটির প্রান্তে কোণার বাড়িটি কিছুদিন হইল খালি পড়িয়াছিল । বাড়িগুলি একতলা, সম্মুখের ঘাসের জমি বারান্দায় মিশিয়াছে। বারান্দায় ঢালু লাল টালির ছাদ। সেই টালির ছাদে দেখিলাম একটি ময়ূর বসিয়া আছে। এত বড় আকারের ময়ূর পূর্বে দেখি নাই। ময়ূর কি এত বৃহৎ হইয়া থাকে? মনে হইল সচরাচর হয় না, তবে এই বিশেষ ময়ূরটি এইরূপ। পদযুগল টালির ছাদের কিনারায় কিন্তু তাহার পুচ্ছ ঘাসের উপর লুটাইতেছে। কেমন যেন মনে হইল, এ অঞ্চলে যত ময়ূর রহিয়াছে, এ নিশ্চয় তাহাদের রাজা।

রাজার কী রূপ! রামধনু হইতে বেগনী-নীল-সবুজ অংশটি কাটিয়া লইয়া বিধাতা যেন ইহার পেখম রং করিয়াছেন। শতসহস্র চক্রকার ও ললিতবঙ্কিম রেখায় অঙ্কিত অপরূপ নকশাচিত্রের উপর অস্তসূর্যের স্বর্ণালী আলোকচ্ছটা পড়িয়াছে। আমি মুগ্ধ চোখে দেখিতে লাগিলাম।

রাজা কি আমাকে লক্ষ্য করিয়াছে। হয়তো বা। তবে কে এক বিদেশী ব্যাক্তি আসিয়া তাহাকে দর্শন করিতেছে তাহাতে রাজার মন দেওয়া সাজে না। রাজা যেন আপন চিন্তায় মগ্ন হইয়া রহিয়াছে।

কখনো কাব্য রচনা করিবার প্রয়াস করি নাই কিন্তু সে মুহূর্ত্তে মনে হইয়াছিল চেষ্টা করিতে দোষ কী। প্রথমে মনে আসিল – প্রাচীরে প্রাচীরে ঝলসিয়া উঠে শেষ সূর্যের ছটা / ময়ূরপেখমে রেখে যায় তার উদ্ধত ঘনঘটা।

এহ, ইহা তো চলিবে না। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রায় হুবহু নকল হইয়া গেল! আর একবার প্রচেষ্টা করিলাম। - সন্ধ্যারাগে সবুজে-নীলে লক্ষ চক্র আঁকা/ আঁধারে মলিন হলো …

না না, ইহাতে তো রবীন্দ্রনাথের কপি-রাইট চুরি করিয়া ফেলিতেছি। কাব্যরচনা আর হইল না। হার মানিলাম।

মনে মুগ্ধভাব অথবা বিস্ময় ছাইয়া যাইলে মনুষ্যসন্তান মাত্রই তাহা প্রকাশ করিতে চাহে। সঙ্গী থাকিলে সে বলিয়া উঠে –“আহা দেখ কী দৃশ্য!!” আর আমার মতো নিসঙ্গ হইলে সে যে কোনো উপায় তাহা ধরিয়া রাখিতে চাহে। ভাগ্যে সেদিন ফোন লইতে ভুলিয়াছিলাম, ফোন থাকিলে কটাস কটাস করিয়া ছবি তুলিয়া লইতাম। ছবি তুলি নাই বলিয়াই সে ময়ূররাজাকে আমার স্পষ্ট মনে রহিয়াছে, চোখ বন্ধ করিয়া দেখিতে পাই।

ভাবিলাম ইহার বিবরণ লিখিয়া রাখিলে কেমন হয়। কিন্তু কী লিখিব? কাব্যরচনায় তো ডাহা ফেল করিয়াছি। মনে হইল যাহা দেখিতেছি তাহা যদি একান্ত আপনার মতো লিখিয়া রাখি… মনেমনে বলিলাম –“বিকালের সূর্য ঢলিয়াছে, বাতাসে স্পন্দন নাই।  শেষ বাড়িটির লালবর্ণের টালির ছাদে তিনি বসিয়া আছেন, পেখম লুটাইতেছে ভূমিতে ..” এইরকম ধরনের কিছু। ভাবিয়াছিলাম ঘরে ফিরিয়া কাগজেকলমে ধরিয়া রাখিব যদিও ডায়েরী লিখিবার অভ্যাস আমার নাই।

ময়ূররাজার সহিত আমার মনের কি যোগাযোগ রহিয়াছে? তিনি কি আমার রচনা শুনিতে পাইয়াছেন? কি জানি। ইহার পর বোধহয় রাজদর্শনের সময় অতিক্রান্ত হইল। ঝটপট ঝটপট শব্দে পাখনা সঞ্চালন করিয়া রাজা টালির ছাদ হইতে একটি গাছের ডালে চলিয়া গেল। এক্ষণে এক পরিচিত ব্যক্তিকে দেখিলাম। সে বলিল –“ময়ূরটি খুব বড়। আগে একবার দেখিয়াছিলাম, ইহাকে বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। এইখান হইতে ইহা তালগাছের মাথায় উড়িয়া যাইবে।”

-                     “তালগাছের মাথায়!?”

-                     “ এ ময়ূর তালগাছের মাথায় থাকে।”

-                     “ বলেন কী, তালগাছের মাথায় ময়ূরের বাসা?”

সে উত্তর দিবার আগেই পুনরায় ঝটপট শব্দ হইল। দেখিলাম রাজা সত্যই এ গাছের শাখা হইতে কোনোক্রমে ভারী পোষাক পরিহিত শরীর বাতাসে ভর করাইয়া তালগাছের মাথায় চলিয়া গেল।

ফিরিয়া আসিবার সময় মনে হইল, তালবৃক্ষ রাজার যোগ্য স্থান বটে। সকল তুচ্ছতার ঊর্ধে ময়ূররাজার বাস।

****

পরদিন প্রভাতে উঠিয়া যথারীতি কার্যে যাইবার জন্য প্রস্তত হইতে ছিলাম। স্নান করিয়া পোষাক পড়িয়া টেবিলে বসিলাম প্রাতরাশের অপেক্ষায়। কাজের মহিলাটি খাবারের থালা ও চা আনিয়া রাখিল। এমন সময় চোখে পড়িল তাকের উপর পুরানো পরিত্যক্ত ফুলদানিটিতে কেহ একটি ময়ুরের পেখম রাখিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিতে কাজের মেয়েটি বলিল – “সকালে দেখিলাম বাগানে পড়িয়া রহিয়াছে, অতিপ্রত্যুষে নিশ্চয় ময়ূর আসিয়াছিল, আজ তোমার দিন ভালো যাইবে …”

হাতে মিনিট পাঁচেক সময় রহিয়াছিল, প্রাতরাশ সারিয়া চায়ের পেয়ালা লইয়া বাগানে আসিয়া দাঁড়াইলাম। কেমন যেন মনে হইল, এ ঘরবাড়ি, এ রাস্তা, দোকান, কারখানা, লোকজন কিছুই যেন নাই। আমি এক পথিক , বহুদূর দেশ হইতে আসিয়াছি। কাল বিকালে হঠাৎই রাজদর্শন হইয়া গিয়াছিল। রাজাকে কয়েক ছত্র প্রশস্তি শুনাইয়াছিলাম। রাজা কোনো উত্তর দেন নাই, তাঁহার ভালো লাগিয়াছিল কি না তাহা জানিতে পারি নাই। তবে প্রত্যুষে পুরষ্কার রাখিয়া গিয়াছেন।

তাঁহার যোগ্য তেমন কিছু না হইলেও, কোনো রচনা হইতে নকল না করিয়া নিজের ভাবনা সরাসরি বলিয়াছি তাই হয়তো রাজা খুশি হইয়াছিলেন। অথবা প্রচেষ্টা করিয়াছি বলিয়া শান্ত্বনা পুরষ্কারও হইতে পারে। যাহাই হউক, ঘরে গিয়া পালকটি আর একবার দেখিলাম। এ রাজার তো মণিমাণিক্য মুক্তাহার জাতীয় কিছু নাই, এ রাজা নিজের সৌন্দর্য হইতে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ আমাকে উপহার দিয়াছেন। তাহার কোমল স্পর্শ শুধু অঙ্গুলিতে নহে, মনের গভীরেও যেন অনুভব করিলাম।

*****

ইহা বেশ কয়েক বৎসর পূর্বের ঘটনা। প্রত্যহ কাজে যাইবার পালা শেষ হইয়া এখন অবসরের দিন আসিয়াছে। কিছু মনে হইলে তাহা কখনো কখনো শখ করিয়া লিখিয়া ফেলি। কিছু কিছু এখানে সেখানে প্রকাশিত হইয়া যায়। হয়তো কেহ পাঠ করেন কেহ পাতা উল্টাইয়া যান। তবে কখনো কখনো নিজের রচনা নিজেই পড়িয়া দেখি। আর তখনই কী কারণে যেন সেই ময়ূররাজাকে স্মরণ হয়। মনে হয় সন্ধ্যা আসন্ন। আমি একেলা বাহির হইয়াছি। কেহ কোথাও নাই। শুধু সেই ময়ূররাজা ভূমিতে পেখম ছড়াইয়া রাজ আসনে বসিয়া আছেন। তাঁহাকে লেখা পড়িয়া শোনাইতেছি। এই প্রদোষকালে মনে বিশেষ কোনো প্রত্যাশা নাই, কোলাহলও নাই।  শুধু একটি অপেক্ষা রহিয়াছে। নিজস্ব অনুভব কি নিজের মতো করিয়া লিখিতে পারিয়াছি। যদি লেখা সেরূপ হইয়া থাকে তাহা হইলে অতিপ্রত্যুষে রাজা আসিয়া সেদিনের মতো একটি পালক রাখিয়া যাইবেন। সে উপহার অন্য কেহ দেখিতে পাইবে না, সে উপহারের কথা ব্যক্ত করিলেও অন্য কেহ বুঝিতে পারিব না। তথাপি সে উপহারের কোমল অন্তরঙ্গ স্পর্শে মন কানায় কানায় ভরিয়া উঠিবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন