ম্যানারিজিম - স্বল্প সময়ের নির্ভীক ভাষ্য
পঞ্চদশ
শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী ও উৎকর্ষ চিত্রকলার সময়কে সনাক্ত করা হয় উচ্চ
রেনেসাঁ বলে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে হাই রেনেসাঁ ইতালির অ্যাসিসি শহরে শুরু হয়ে ক্রমশ
ছড়িয়ে পড়ে। নবজাগরণে ধর্মীয় গোঁড়ামীর বদলে স্থান পায় বিজ্ঞানভিত্তিক অঙ্কন পদ্ধতির
সঙ্গে সরল চিন্তা। ছবিতে বেশী করে ব্যবহার হয় পরিপ্রেক্ষিত, আলোছায়া, প্রাকৃ্তিক
দৃশ্য, অ্যনাটমি ও স্থিরচিত্র। শিল্পের ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে তেল রঙের
আবিষ্কার। পূর্বের টেম্পেরার বদলে জায়গা করে নেয় কাঠ, দেওয়াল ও ক্যানভাসের ওপর
তেলরঙ। ফ্লেমিশ দুই ভাই হিউবার্ট ভ্যান আইক ও জল ভ্যাক আইক তেল রঙের পদ্ধতি
আবিষ্কার করেন। ‘মেঘ শাবকের পূজা’ প্রথম পরীক্ষা মূলকভাবে তেল রঙে আঁকা চিত্র,
এছাড়া তাদের যৌথ কাজ ‘আদম ও ইভ’ উল্লেখযোগ্য। এরপর একচেটিয়াভাবে ছড়িয়ে পড়ে তেল রঙের
ব্যবহার।
হাই
রেনেসাঁ শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হলেন লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো,
রাফায়েল, তিশিয়ান প্রমুখ। প্রত্যেকের কাজেই নান্দনিকতা, সৌন্দর্যায়ন, স্পষ্টতা ও
শৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায় পরিপ্রেক্ষিত লাভ করে নতুন মাত্রা। এই যুগের সবচাইতে
শক্তিশালী দিকটি হলো রেখাঙ্কনের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও দক্ষতা। ইতিহাসের দিকে তাকালে
দেখি এই সময় ইউরোপে মেডিচি বংশের আধিপত্য। যাদের চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা
গীর্জাগুলিতে ফেস্কোর কাজ স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যের কাজে এনেছিলো বিস্তার। এই সকল
কিছুই দেখতে দেখতে একদিন এক তথ্য সামনে উঠে এলো, পড়ে বেশ কৌতুকবোধ করেছিলাম-
লিওনার্দো যখন কাজের সুযোগের জন্য মেডিসি রাজ বংশের কাছে চিঠি পাঠালেন সেখানে তার
কাজের আবেদনের তালিকায় ছিলো যুদ্ধের অস্ত্রাদি বানানোর পারদর্শিতা, হাওয়াকল
প্রস্তুতের কৌশল থেকে শুরু করে দশটির ও বেশী কাজের স্ববিশেষ বর্ণন এবং পরিশেষে খুব
অল্প কথায় উল্লেখ যে- তিনি ছবিও আঁকতে পারেন। অথচ তখনও কেউ জানতো না যে ভিঞ্চির
হাই রেনেসাঁ পরের ছবিগুলিই হয়ে যাবে আগামী বিশ্বের কাছে চিত্রকলার নতুন মাইলস্টোন
স্বরূপ। এই উৎকর্ষতার সহস্রাধিক বিচার বিশ্লেষণের মধ্য হতে যে কারণগুলোকে সবচাইতে
গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবি তা হলো তাঁর অ্যানাটমির ওপর অসামান্য দখল এবং সে সংক্রান্ত
অধ্যাবসায় আর তাছাড়া ছবিতে যথার্থরূপে পরিপ্রেক্ষিত ও স্পেসকে ব্যবহার করার বিজ্ঞানমনস্কতা।
নবজাগরণ
শিল্পের সবচাইতে বেশী যে দিকটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো পরিশ্রম। নতুন
নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে, সৌন্দর্য ও নিখুঁত মানবদেহ সৌষ্ঠব গঠনের নিরলস
প্রচেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিলো না।
প্রারম্ভিক
রেনেসাঁ শিল্পীরা রিয়ালিজমের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন আধ্যাত্মবাদকে।
প্রারম্ভিক শিল্পীরা মনে করতেন যে ছবিতে যদি আধ্যাত্মবাদকে প্রাধাণ্য দিতে হয়, তবে
পরিত্যাগ করতে হবে বহুলাংশে রিয়ালিজমকে। কিন্তু এই অনুমানকে সম্পূর্ণ ভুল
প্রমাণ করতে সফল হলেন লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি। ভিঞ্চির ক্যানভাসে একই সঙ্গে উঠে এলো সে সকল মানব শরীর যার শারিরীক
সৌষ্ঠবের নিপুণতা সৌন্দর্য্যের নতুন মাত্রাকে প্রতিস্থাপন করে, স্বর্গীয়
আধ্যাত্মিক তার নিগূঢ় স্পর্শে। আর
এখানেই ঘটে যায় নিঃশব্দে এক বিপ্লব। যা পরবর্তী সকল শিল্প বিপ্লবের পর থকে, পথ
বদলকে জাদুবলে আবিষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। আর এইভাবেই ধর্মীয় নানান কাহিনীগুলো
সুন্দর দেহ সৌষ্ঠবের পাশাপাশি হয়ে ওঠে সম্ভ্রান্ত অর্থাৎ যথার্থাই যুক্ত হয় Soul and Substance–এর
ভিয়েন, ফলে জন্ম নিয়েছে বাইবেলের গল্পগাথার মোড়কে এক গ্রেসফুল ও জটিল নাটকীয়তার
প্রবাহপথ।
এরপর
১৬০০ খ্রীঃ থেকে শুরু হলো বারোক যুগ যা প্রায় ১৭২০ খ্রীঃ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বারোক
যুগের খামখেয়ালি, রীতিবর্হিভূত ছবিগুলোর মধ্যে নিহিত ছিলো বর্তমান সময়ের আধুনিক
বিমূর্ত ছবির বীজ। হাইনরীশ ভোলফলিন প্রথম বারোক শিল্পরীতিকে রেনেসাঁ পর্যায়ের ছবিগুলো থেকে আলাদা করেন। বারোক কথার
উৎপত্তি রহস্যঘেরা। পর্তুগীজ শব্দ ‘barroco’ থেকে সৃষ্ট বারোকের অর্থ গাঢ় বা অতিপুষ্ট। কিন্তু শিল্পশৈলীর ব্যাখ্যায় এই শব্দ কীভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায় তা
খানিকটা রহস্যঘেরা। রেনেসাঁ পর্বের শেষ থেকেই বারোক শিল্পের দিকে পথ হাঁটাটা রোমের
থেকে বেড়িয়ে নর্দান রেনেসাঁ শিল্পীদের শৈলীর থেকে ভিন্ন হয়ে ও প্রসারিত হয় সমগ্র
ইউরোপে। সেখানে গথিক, ধ্রুপদী, উত্তর ইউরোপীয় রেনেসাঁ চিত্রের তুলনায় বারোক শৈলী
প্রাধান্য দিয়েছে কল্পনাকে, মনস্তাত্ত্বিক গঠন বিন্যাসকে, ফলে এই শিল্প
হয়ে উঠেছিলো প্রথম বাস্তবকে অস্বীকার করার মাধ্যম। রিয়ালিটিকে আঘাত করার যে
প্রবণতা হাই রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ঊঠেছিলো তাই বারোক শৈলীর মধ্য
দিয়ে অর্জন করতে সার্থক হলো কল্প জগতকে, আর এটাই ছিলো আগামীর সকল পাশ্চাত্য ছবির
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ভিত্তিস্বরূপ।
এইসব আলোচনার মধ্য
দিয়ে একটু একটু করে প্রবেশ করতে চাচ্ছি সুবিস্তৃত ইউরোপীয় ছবির পর্বগুলোতে। গথিক শৈলীর থেকে রেনেসাঁ যুগের
গৌরবজ্জল ধারা হয়ে বারোক শৈলীর শুরুয়াত অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর থেকে ষষ্ঠদশ
শতাব্দীর প্রথম- এই সময় সীমার মধ্যে আছে আশি বছর সময়, এমন এক সময় যা আধুনিক ছবির
পুর্নগঠনে দাবী রাখে সর্বাধিক। উচ্চ রেনেসাঁর সায়াহ্নে তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিকতাকে
অস্বীকার করে যে দিগন্ত উন্মোচিত হয় তার প্রভাব বারোক শিল্পের পর থেকে মসৃণ করার
পাশাপাশি আধুনিক শিল্পকে উৎকর্ষতা প্রদানেও ছিলো সক্ষম। মাত্র আশি বছরের ক্ষুদ্র
সময়ের পরিসর, অথচ যার প্রতিটা ছবিই সমালোচিত এবং ততোধিক বিতর্কঘেরা। সময়ের অগোচরে
থাকা এই আশি বছরের সঠিক মূল্যায়ন শুরু হয় অনেক পরে, প্রায় বিংশ
শতাব্দীতে এসে। যা এরপর নতুন মাত্রা লাভ করতে শুরু করে- অসীম সম্ভবনা আবার মোহময় এক ক্ষুদ্র সময়। এই সময়ের
গমক এতোটাই দীপ্ত আবার মোহময় যে এর সংকটময় জন্মকালের দ্বন্দ্বটাই রোমহর্ষক। যখন
উচ্চ রেনেসাঁর ফলে শিল্পীদের সাফল্য চূড়ান্ত, যখন নতুন করে যেন আর কিছুই করার নেই, এই সংশয়ের সম্মুখীন হয় শিল্প
ঠিক তখনই, তখনই প্রবল আঘাতের প্রয়োজনীয়তাটা অবসম্ভাবী হয়ে পড়ে। রেনেসাঁ ছাড়িয়ে
বারোকের দিকে পথ হাঁটার সময় দমকা হাওয়ার এই আশিটি বছর ছবির জগতে তার সমস্ত সংশয়,
রহস্য, বিতর্ক তথা সম্ভাবনা নিয়ে স্বমহিমায় নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে- নিজগুণে ‘ম্যানারিজম’
নামে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন