রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

ফারহানা রহমান

 

কবি নুরুল হুদার সাহিত্যভাবনা




 

“মাথার উপর আকাশ জোড়া সূর্যছাতা,

মহাদেশীয় হাইওয়ে ছেড়ে আমরা পা রাখলাম,

এই পলিবাংলার ধুলি রাস্তায়।

আমাদের পা যেন কিংবদন্তির লাঙ্গল

ক্রমাগত এগিয়ে চললো

ব্রক্ষের আদি পুত্রের খোঁজে।

না, আমরা প্রায়শ্চিত্ত করতে আসিনি আদিপাপের,

আমরা পরখ করতে আসিনি কোন সনাতন তীর্থ,

আমরা দেখতে আসিনি

নদীতীরের রোগশোক, মানুষের ক্ষরণ-মরণ”।

[লাঙ্গল মানুষ, ‘নির্বাচিত ২০০ কবিতা]

এমনই আধুনিক অথচ দেশপ্রেমের গভীর ব্যাঞ্জনা ফুটে ওঠে কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদার কাব্যের পঙক্তিতে পঙক্তিতে। কবি নুরুল হুদার চেতনাজগৎ নির্মিত হয়েছে এদেশের জীবনবৈচিত্র্য, গতিবেগ, প্রত্যাশা, প্রেম, যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি এদেশের সম্ভাবনার সমন্বিত সচেতন কাব্য-আন্দোলনের মাধ্যমে। আবেদের স্বতঃস্ফূর্ততা, দেশপ্রেম মানবপ্রেমাবেগ প্রকাশের সহজতা ও মননশীলতা কবি নূরুল হুদার কবিতাকে করে তুলেছে তাঁর সমসাময়িক কবিদের কবিতা থেকে অনন্য। ষাটের দশকে এদেশের কবিতার বিষয় ও শিল্পমূল্যের বিচারে যে সম্পন্নতা অর্জন করে, তার উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে কবিতার নতুন আলোড়ন সৃষ্টি নিঃসন্দেহে সহজ কাজ ছিলো না। তবে ষাটের কাব্যান্দোলনের অন্তরালে একটা বিশেষ শূন্যতা ছিলো, কিন্তু নূরুল হুদার বহুমাত্রিক কাব্যচর্চা, মেধা ও মননের  সুনির্দিষ্ট ব্যবহার  আমাদের  কাব্যজগৎ-এ এনেছিলো একধরনের পূর্ণতা। আমরা তাঁকে  দেখি বিচিত্র পটভূমির উপর লিখতে। কবি নূরুল হুদার কবিতায় আছে দর্শন, আছে প্রেম, আছে মিথ আর সেইসাথে আছে দেশ ও ঐতিহ্যের ভাবনার মিশেল। তাঁর প্রত্নস্মৃতিতে মিশে থাকে গ্রামজীবনের স্বপ্ন। তাঁর অনুভূতিলোকে আছে নারীর  প্রতি প্রেম, অবচেতনলোকে আছে  প্রকৃতিভাবনা –

“পুষ্প, তুমি কতদিন রয়েছো উন্মুখ

সময়ের ফুল্ল আঙিনায়, থাকো কত কাল?

গোধূলিতে দ্যাখো এই বৃক্ষটিকে,

দ্যাখো, পত্রময় কারুকাজে

এই বৃক্ষ পৃথিবীর সুপ্রাচীন ছায়া –

আমি বসে আছি তার পদমূলে”।

[কৌমার্যের শ্বেত-পত্র]

কবির লেখা উপরোক্ত কবিতাটির এই কয়েকটি পঙক্তি তো শুধু কিছু আবেগের সমাহার নয়, এটি কোন আংশিক দৃশ্যরূপও নয়, এর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডকে এক করে দেখার পূর্ণরূপ। পুস্পের কাছে কবি জানতে চান যে সে কতদিন ধরে সময়ের ফুল্ল আঙিনায়  রয়েছে উন্মুখ? কবি পুস্পকে বলছে্ন গোধূলিকে দেখতে, পত্রময় কারুকাজ করা বৃক্ষকে দেখতে বলছেন, যে বৃক্ষ যুগ যুগ ধরে মানুষকে, আমাদের কবিকে তাঁর পদমূলে ছায়া দিয়ে চলেছে। এ যেন কবির কণ্ঠে এক অমোঘ উচ্চারণ। এই কয়েকটি পঙক্তি যেন হয়ে উঠেছে এক  মহাকাব্য যেখানে বিজ্ঞান, কল্পনা, দর্শন সব কিছু মিলে মিশে একাকার।

এভাবেই “মানুষ মূলত কবি” কবিতাটিতে আমরা একই ব্যপার লক্ষ্য করি –

“সমুদ্রের পাশে জন্ম, কিন্তু তবু সমুদ্র দেখেনি

এই দুঃখে বসে আছে মর্মাহত ম্লান দাঁড়কাক।

দাঁড়কাক জানে না নিজেও

আত্মসুখ মিলে কি বিষে”।

[মানুষ মূলত কবি]

‘সমুদ্রের পাশে জন্ম, কিন্তু সমুদ্র দেখেনি’ – এমন বিস্ময়কর কথা ভাবলেও শিউড়ে উঠতে হয়। এখানে কবি আসলে আমাদের কী বলতে চেয়েছেন? এই বিস্ময়কর পঙক্তির মাঝে কি কোথাও কোন গণিত বিশ্বের যুক্তিবাদ রয়েছে? এর পরের লাইনে আছে ‘এই দুঃখে বসে আছে মর্মাহত ম্লান দাঁড়কাক’। তাহলে কি এই দাঁড়কাকটি কবি নিজেই? যার জন্ম হয়েছে সমদ্রের খুব কাছাকাছি কিন্তু তিনি ভাবছেন যে তাঁর এখনো আসলে এই বিশাল জলরাশির ধারা এই সমুদ্রকে দেখা হয়েই ওঠেনি। আর কবি নুরুল হুদার মনন বিশ্বের দার্শনিকতা আমরা ঠিক এখানেই দেখতে পাই। তাই তাঁর কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে ছড়ানো দেখতে পাই কখনো বিপন্ন-বিশ্বের আত্ম-যন্ত্রণা, কখনো বা মহান কাব্যরসের সঙ্গীত হিল্লোল।



ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতা পূর্বতন কবিদের দর্শন ও সামাজিক অঙ্গীকারকে সচেতনভাবেই অতিক্রম করতে চেয়েছিলো। আমাদের  আধুনিক কবিতার ভিত্তিমূলে রবীন্দ্র–পরবর্তী দুজন কবির সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের কবিতার মূল পটভূমিতে ছড়িয়ে আছে নজ্রুলের সামাজিক অঙ্গীকার এবং জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি, নিসর্গলোক ও বিমূর্ত প্রেমাকাঙক্ষার সুস্পষ্ট স্পন্দন। তবে কবি নূরুল হুদার কবিতায় আমরা পূর্বনির্ধারিত এ পথকে সচেতনভাবে অতিক্রম করার অব্যাহত চেষ্টা দেখতে পাই-

“আমি যে কোথায় আছি বলে দে  না ভাই

আমাকে বাড়ি যেতে হবে;

এ কোন বিজনলোকে আনলি আমাকে,

এ কোন ঠিকানাহীণ অলীক আস্তানা,

জানালা দরজাগুলো এমন বন্ধ রাখা কেন?”

[নির্বাসিত ঘাতকের স্বীকারোক্তি]

কবি নূরুল হুদা তাঁর বহু শক্তিশালী কবিতা সৃষ্টি করেছেন তাঁর গভীর অবচেতনের জগৎ থেকে। এই অবচেতনের জগৎ-এর মধ্যেই তিনি নিরন্তন সন্ধ্যান করেছেন ইন্দ্রজাল। তাঁর কবিতার প্রকাশের মধ্যেই রয়েছে বিশেষ এক নন্দনতাত্ত্বিক চমক। কবি মাত্রই হয়তো কোন না কোনভাবে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারি আর শেষপর্যন্ত তিনিও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশ্বরের অনুসন্ধ্যান  করেন। এমনই অবচেতনের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে তিনি লিখেছেন –

“তমি তবু তুমি জন্ম-জন্মান্তরের শীতার্ত তন্দ্রা।

তুমি দাঁড়িয়ে আছো অনন্ত শীত-রাত্রির ভিতর, সময়ের দুঃশীল

দুর্গের ভিতর;

তোমার চারপাশে চতুর্মাত্রিক অন্ধকার, সেই অন্ধকার সারি সারি প্রহরা;

আমাকে দারুণ উপেক্ষা হেনে তুমি মৌনতামগ্ন ঐ প্রহরীকুঞ্জে ;”

[একটি শীতার্ত তরুর প্রতি]

আবার একইভাবে ‘আকাশ জোনাকি’ কবিতায় দেখতে পাই –

“একটি জোনাকির বুকে কোটি আকাশ

কোটি জোনাকির বুকে একটি তারা;

অন্ধকারে, ঝোপেঝাড়ে, বাঁশবাগানের মাথায়

জোনাকিরা কুচিকুচি করে চিরে ফেলে তমসার কারা”

[আকাশ জোনাকি]

কবি নূরুল হুদা তাঁর কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। তাঁর এক একটি কবিতায় যেন এক একটি নতুন নতুন গল্প সাজানো থাকে। তাঁর বাক্যবন্ধন আধুনিক, চিত্রকল্পের ব্যবহার সংযত, অথচ প্রাঞ্জল ও বৈচিত্র্যময় যেন ধ্রুপদী  সংগীতের বর্ণময় উচ্ছ্বাস। তাঁর প্রকৃতির প্রতি, দেশের ঐতিহ্যের প্রতি, সৃষ্টিকলার  প্রতি নিবিড় অনুভব তাঁকে তাঁর কবিতা লেখার মূল প্রেরণা। তাঁর কবিতার ঝর্ণামুখটি তাই হয়ে উঠেছে বিচিত্র ধারার উৎসমুখ। সেখান থেকেই আমরা দেখতে পাই বহুবর্ণের নিঃসরণ। তাঁর নিজের কথাই তিনি বলেছেন নার্সিসাস কবিতা –

“নিবিড় নীলাভ সন্ধ্যা অহরহ জ্বলে অবয়বে

গতায়ু রোদের মতো যেখানেই হাঁটি ধীর পায়ে

আমাকে শিকারী ভেবে আলোককণা পালিয়ে বেড়ায়

সন্ত্রস্ত হরিণী যেন, খুঁজে ফেরে ছায়ার বিবর

চৌদিকে পাতারা কাঁপে, পাখী ডাকে,

অলিন্দে অরণ্য হয় দুঃখের শহর”

[নার্সিসাস]

ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় আমরা নাগরিক উল্লাস, বিকার, আত্মরতি, আত্মখননের যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি, নূরুল হুদার কবিতায় তার প্রভাব পড়েছে কম। বরং তার বদলে আমরা দেখতে পাই শিল্প ও দর্শনের সংমিশ্রণে তৈরি করা জাতি সত্তার কবিতা। তাঁর নানা কাব্যিক শৈলীতে ফুটে উঠেছে বিশ্ব-মানব সংস্কৃতির প্রতি প্রেম ও শৈল্পিক অনুরাগ। তাঁর কাব্যে দেখতে পাই গণমানুষের  সংগ্রাম। তাদের ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, তাদের স্বাধীনতার জন্য তাঁর কলমে রক্তক্ষরণ হয়েছে বারবার। তিনি কখনই জীবনবিমুখ নন। অস্তিত্বের স্বাধীনতা আর সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতা তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু –

“পদব্রজে পৃথিবী ভ্রমণ  - অদৃষ্টই ঠিকানার ভিন্নতর নাম

প্রতিটি মুহূর্তে আছে শৈলাবাস, দার্জিলিং নিত্য খোলা দ্বারা

চড়াই উৎরাই আর পদে পদে প্রাকৃতিক ব্যারিকেড নয়

চতুর গোলতু তুমি, পায়ে পায়ে বাজো তবু গোপন নূপুর”।

[শোভাযাত্রা দ্রাবিদার প্রতি]

 অথবা

“অন্তহীন স্বপ্ন নিয়ে মানুষের চলে যেতে হয়

অনন্ত স্বপনের মাঝে হয়তো সে হয়ে ওঠে চির স্বপ্নময়

হয়তো সে নিশি–লগ্ন নিদ্রায় নিবিড় –

প্রবীণ পৃথিবী ছেড়ে মানুষের পায় নাকি

ভিন্ন কোন নীলিমায় নীড়?”

[চির স্বপ্নময়]

নূরুল হুদা একজন মানবতাবাদি কবি আর সেটাই তাঁর মূল পরিচয়। তাঁর কাব্য-আবেগের মূল অনুষঙ্গ যে মানব ও প্রকৃতিপ্রেম তার বিবরণ আমরা দেখতে পাই নানা কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে। তবে সময় অভিজ্ঞতা যে একজন কবির চেতনা ও রূপকল্পের বড় ধরনের রূপান্তর সাদর করে সেটাও আমরা দেতে পাই তাঁর যুদ্ধ পরবর্তী কবিতায় –

“আজ পনের আগস্ট, আজ বাঙালির শোক।

অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটাও আজ নট হোক।

আজ খাঁ খাঁ, আজ ধু ধু, আজ ছিন্নভিন্ন মানুষের অশোক

রাঢে বঙ্গে হরিকেল সমতটে

বাঙালির বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক”।

[পনের আগস্ট]



কবি নুরুল হুদা কাব্যভাবনার দিক থেকে সব সময় অন্যদের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। তাঁর আকাঙ্ক্ষা, ভাবনার বিস্তার তাই আলাদা মাত্রা পেয়েছে আমাদের  কাব্যজগতে। তাঁর দর্শন প্রেম, মরমিয়াবোধ, কবিতার নির্মাণ শৈলী, চিত্রকল্প, ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার সবসময় তাঁকে অন্যদের কাছ থেকে ভিন্ন আসনে রেখেছে। তাঁর ভাবনার সাথে সংশয়হীনভাবে মিশে গেছে অন্য মানুষের ভাবনা। অন্তর্জগতের সাথে বহির্জগতের সৌন্দর্যবোধের যে মিশেল, তাই তাঁর কবিতাকে  করে তুলেছে অনন্য। তিনি কবিতার পাশাপাশি বহু উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ ও গান লিখেছেন। ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের পূর্ব পোকখালি গ্রামে কোনই মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্ম হয়। ঈদগাহ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। এরপর তিনি ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালক ছিলেন এবং জার্মান, জাপান, আমেরিকা, হাওয়াই, লন্ডন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, তুরস্ক, পাকিস্থান, শ্রীলংকা, চায়না প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে নানা সময় সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি তাঁর কাছের স্বীকৃতি ও সম্মাননাস্বরূপ বিশেষ ভাবে  লাভ করেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, সুকান্ত পুরষ্কার, কক্সবাজার মেয়র কর্তৃক নগর চাবি প্রদান ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব’এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন