সিনেমার পৃথিবী – ৬
রহস্য আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই ঠিক
করলাম, কোরিয়ার পর এই ফাঁকে স্প্যানিশ ছবি নিয়ে কিছু বলে নেওয়া যাক। স্পেন ছাড়াও
দক্ষিণ আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ সমেত মোট ২০টি দেশের সরকারি ভাষা স্প্যানিশ। ফলে
স্প্যানিশ ছবি নিয়ে কিছু বললে দক্ষিণ আমেরিকার সিনেমার কথাও আসবেই। আর স্পেনের
সিনেমা মানেই লুই বুনুয়েল দিয়ে শুরু, সেটা নিশ্চয় বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।
প্রথম ছবি লুই বুনুয়েলের ‘দ্য এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ (১৯৬২)। দ্বিতীয় ভিক্টর এরিসের ‘স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ’ (১৯৭৩)। তৃতীয় আলেহান্দ্রো আমেনাবারের ‘ওপেন ইওর আইজ’ (১৯৯৭)। চতুর্থ ছায়াছবি পেদ্রো আলমোদোভারের ‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ (১৯৯৯)। এবং শেষ সিনেমা গিলের্মো ডেল-টোরোর ‘প্যান’স ল্যাবাইরিন্থ’ (২০০৬)।
লুই বুনুয়েলের ৯৫ মিনিটের সিনেমা ‘দ্য এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ আমার মনে হয়েছে সিম্বলিজম ও সুররিয়েলিজমের মিশ্রণ। এক ডিনার পার্টিতে এসে খাওয়ার পর অতিথিরা সোফায় বসে পড়ে এবং সকাল হবার পর বুঝতে পারে তারা এই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারছে না। আস্তে আস্তে খাবার ও জল শেষ হয়ে আসে। তখন সবার আসল রূপ বেরিয়ে আসে, তারা একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠে। একজন বয়স্ক অতিথি মারা যান। একজোড়া তরুণ-তরুণী সুইসাইড করে। জীবিতরা কোনমতে দেওয়ালে একটা ফুটো করে বেরোনোর চেষ্টা করে, কিন্তু সেখান দিয়ে কিছু ভেড়া ঢুকে পরে। তার ভেতর একটা ভেড়া অতিথিরা কেটে খায়। এবং গল্প আরো এগোতে থাকে। চূড়ান্ত পরাবাস্তব গল্প। সাদা কালো ছবি, ক্যামেরার কাজ অনবদ্য। বিশেষ করে যেখানে সবাই একে অপরকে শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করছে। এই সিনেমা সুররিয়েলিজমের জন্য বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়েছে।
ভিক্টর এরিসে বেশ কিছু বিখ্যাত
সিনেমা করেছেন যার ভেতর ‘স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ’-এর নাম সবার আগে উঠে আসে। ১৯৪০
সালের পটভূমিকায় স্বৈরাচারী ফ্রাঙ্কো-র রাজত্বে এই সিনেমা। ছ’বছরের এক বাচ্চা মেয়ে
আনা তার বাবা-মা-দিদির সঙ্গে নিজের গ্রামে থাকে। দু-বোন একবার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
সিনেমা দেখতে যায়। সেই থেকে আনাকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ছায়া তাড়া করে বেড়ায়, এমনকি
চোখ বুজে তার সঙ্গে কথাও বলে। এক পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়ে তার মনে হয় এর ভেতরেই হয়ত
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন থাকে। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় এক আহত সৈনিককে। আনা সেই আহত
সৈনিককে খাবার-জল-বাবার কোট, সবকিছু দিয়ে আসে যাতে তার কষ্ট না হয়। কিন্তু একদিন
ফ্রাঙ্কোর পুলিশবাহিনী এসে এই সৈনিককে মেরে ফেলে। পুলিশ আনার বাবাকে সন্দেহ করে
যেহেতু তার কোট সেই সৈনিকের গায়ে পাওয়া যায়। আনার বাবা বুঝতে পারেন এটা তার মেয়ের
কাজ। পুলিশ চলে যাবার পর আনাকে তার বাবা খুব বকে। আনা পালিয়ে যায়। তাকে না পেয়ে
সারারাত গ্রামের সবাই খুঁজতে থাকে। একসময় সমুদ্রের ধারে এক ভাঙ্গা বাড়ির পাশে
ঘুমন্ত অবস্থায় আনাকে পাওয়া যায়। তারপর থেকে আনা রোজ জানলার ধারে বসে থাকে,
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আশায়।
এরপর আলেহান্দ্রো আমেনাবারের ‘ওপেন ইওর আইজ’। এই সিনেমায় যেটা আমার সবথেকে টেনেছে, সেটা হল আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের মত এক নতুন ধারণা, আর্টিফিসিয়াল পারশেপশন। গল্পটা বলি। ২৫ বছরের সুদর্শন যুবক সিজার। রমনীমোহন। এক রাতে সে প্রেমে পড়ে সোফিয়া-র। সোফিয়ার ভূমিকায় সর্বকালের সেরা স্প্যানিশ সুন্দরী পেনেলোপ ক্রুজ। আবার পরেরদিন তার পুরনো প্রেমিকা নুরিয়া ফেরত আসে এবং সিজারকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে চায়। সিজার রাজি হয়। কিন্তু সেই জার্নিতে নুরিয়া ইচ্ছে করে অ্যাকসিডেন্ট ঘটায়। আহত সিজারের মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে অঠে, তাকে প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়। আর কেউ তার কাছে আসে না। সোফিয়া তার এই ভয়াবহ রূপ দেখে তাকে এড়িয়ে চলে। সিজার একদিন মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়, উঠে দেখে সোফিয়া আবার তার কাছে ফিরে এসেছে। সোফিয়াকে ভালবাসতে গিয়ে সিজার বোঝে আসলে সেই মহিলা নুরিয়া। রাগে উন্মত্ত হয়ে সিজার বালিশ চাপা দিয়ে নুরিয়াকে মেরে ফেলে। এরপর আবার তার ঘুম ভাঙ্গে জেলের ভেতর। খুনের দায়ে দোষী হিসেবে। এবং সেই সময় সে জানতে পারে, যেদিন সে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়েছিল, সেইদিন ‘ক্রায়োনিক্স’ নামক এক কোম্পানির সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছিল, যারা ‘আর্টিফিসিয়াল পারশেপশন’ নামক এক ধারণা বাজারে নিয়ে এসেছে। এরপর বাকিটা নিজে দেখুন, সাসপেন্স থাকবে।
‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ ১৯৯৯ সালের সেরা বিদেশি সিনেমা হিসেবে অস্কার ও বাফটা পেয়েছিল। আলেহান্দ্রোর ছবিগুলো একটু জটিল হয়। এই সিনেমায় যেমন এইডস্, হোমোসেক্সুয়ালিটি, ট্রান্সভেস্টিজম এরকম বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। এক নার্স মা (সিসিলিয়া রথ) নিজের টিনেজার ছেলে মারা যাবার পর ছেলের ট্রান্সভেস্টিট বাবাকে খুঁজতে বেরোয়। গিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপ হয় এক নান-এর সঙ্গে (পেনেলোপ ক্রুজ), যে সেই ট্রান্সভেস্টিট লোকটির দ্বারা গর্ভবতী হয়েছে এবং এখন এইডস্-এ ভুগছে। সেই নান মারা যায় এবং তার সদ্যোজাতকে সেই নার্স মা মানুষ করতে শুরু করে। মাঝে শুধু রয়ে যায় এক ড্রাগ অ্যাডিক্ট আভিনেত্রী এবং আলঝেইমারে ভুগতে থাকা এক বয়স্ক মানুষ। সব মিলিয়ে এই মহিলাপ্রধান সিনেমা রহস্যে ও ড্রামায় উপভোগ্য।
‘স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ’-এর আর ‘অ্যালিস’এর ছায়ায় তৈরি গিলের্মো ডেল-টোরোর ‘প্যান’স ল্যাবাইরিন্থ’ এখনো অব্ধি সারা পৃথিবীতে ছোটদের জন্য রূপকথার গল্পের মত। এই সিনেমার পটভূমিকাতেও ১৯৪৪ সাল, ফ্রাঙ্কোর রাজত্ব। সেখানে এক ১০ বছরের মেয়ের চোখে বাস্তব আর পরাবাস্তব কীভাবে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। আর এই পটে আস্তে আস্তে উঠে আসছে গণ আন্দোলন, গৃহ-যুদ্ধ। এই ছবিতে যদিও কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ আছে, কিন্তু সেট তৈরি, মেকাপ আর কস্টিউম ডিজাইন তারিফ করার মত। তবে হ্যাঁ, ডেল-টোরোর পরিচালনার এক বিশেষত্ব হল বাস্তব আর পরাবাস্তব এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া যাতে বাস্তব ঠিক কোথায় শেষ হল, সেটা দর্শক বুঝতেই না পারে। যেমন ‘শেপ অব দ্য ওয়াটার’। আর এজন্যই ডেল-টোরোর প্রত্যেক সিনেমা শেষ অব্ধি দেখতে ইচ্ছে হয়।
সবশেষে বলি, এই রহস্যের ফাঁদে পড়ে আমি বেশ কিছু ভাল স্প্যানিশ সিনেমা বাদ দিলাম যেগুলো নিয়ে আরো দীর্ঘ আলোচনা করা যেত। যেমন ‘মোটরসাইকেল ডায়েরিজ’ (২০০৪)। চে গুয়েভারা, বিখ্যাত চে হয়ে ওঠার আগে তার এক বন্ধুকে নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যখন ঘুরে বেরিয়েছিলেন, এটা সেই থিম নিয়ে তৈরি ছবি। এবং এখানে ক্যামেরার কাজ ও সিনেমাটোগ্রাফি দেখার মত। তাই ঠিক করলাম, রহস্য এই অব্ধিই থাক। সামনের বার প্রকৃতির পটভূমিকায় জীবন ও সিনেমাটোগ্রাফি, এই দুই নিয়ে হাজির হব। এবং এই দুই-কে এক করতে গেলে আমাকে প্রাথমিকভাবে জাপানের সিনেমা ঘাঁটতেই হবে। তাহলে সামনের বার আমরা জাপানি ছবি নিয়েই বসব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন