কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৩ |
আলুর চোখ
‘ই মাটি লগিন লাখো মন দেলৈ জান / তব সুগন্ধ দেলক হমর মাটি’
লাখো আলু বীজ পাশ ফিরে জোড়া চোখ মেলে সোরেনের মুখে চেয়ে আছে। থকে হেরে বিষণ্ণ ভূমিগত। আধা জিন্দা। সোরেনের আশা, চোখ সাদা দেখাচ্ছে। চোখ ঠেলে পুং বেরোবার লক্ষণ। ক্ষেতে বেশ ক’রকমের সুন্দরী বীজ পোঁতা হল। হীরা ক্লিওপেট্রা কুফনি সুন্দরী। প্রতিটি আলু বীজ পোঁতার সময় সোরেনের আদর আর প্রার্থনা, জলদি ফনফন করে বড় হ বড় হ। মাটি মঈয়ার কোলে লক লক করে উঠুক কচি লত। অভাগার সংসার আমারই। তোর তো নয় মা।
এই চার বিঘা জমিতে এক হাজার কেজি বীজ বপন করেছে সোরেন। সরকারি ঠান্ডা ঘর থেকে ধারে। বণ্ডে সই করে। গরীব চাষী বলে ফড়ে পিছনে লাগেনি। কিন্তু শাসিয়েছে লাথিয়েছে। বিক্রির সময় কিন্তু পার পাবি না! ওরা শাসায়, গাল দেয় বেইজ্জত করে, কিন্তু নসীব? পেটে মারে। গেল বছর পৌষে কোমর ভেঙে দিয়েছিল চাষ। মড়ক লেগেছিল আলু চারায়। নাবি ধসা রোগ। এবার কার্তিক মাসে কোনমতে উঠে বসেছে সোরেন। মাটি স্বপ্নে ডাকছিল। পর পর তিনবার। ছুটে গিয়ে দেখেছিল শিশির ভেজা বেলে দো আঁশ মাটি। আমাকে বাঁঝা করে রাখিস না বাবুনি। বিয়া আন। রোপ রোপ।
একমাস ধরে মাটি তৈরি করল সোরেন। ঋতুচক্রে হেমন্ত। মাটি তোলা, আলগা মাটির বালাই দমন, মালচিং। কাটুই পোকা আর ঘুরঘুরে পোকা খুঁজে খুঁজে মারা। তারপর এক একটি সুন্দরী বীজ আলু মুখের দুটো জ্যান্ত চোখ গামছা দিয়ে যত্ন করে মুছে পুঁতে ফেলার সময় তাদের সাথে কত কথা, ‘কেকর ঘর যাইবে রে? দালাল ঘর? আড়ত? হিমঘর? সরকারি মাণ্ডী কি বাজার? সব উপরওলাকে মেহেরবানি। লেকিন যাইবে ত দশ বিশ বাচুয়াকে জনম দে’কে যাই হ’। তবেই তো আমার সংসার বাঁচবে। ভাবে সোরেন। ক্ষেতের আলে বসে চোখ মেলে তাকায়। ক্ষেতটা এত বিশাল লাগে, আকাশ ও ক্ষেত মিলেমিশে একাকার। দালাল হালাল, নেতা জনতা, ফড়ে আড়তদার, নেতা দুখী সুখী পড়শী কিচ্ছু মনে নেই এখন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে থকান চোখে আশার পর্দা নামে। ক্ষেত জুড়ে বীজের চোখ ফুঁড়ে ফনফনিয়ে ওঠে সবুজ লতা। মাটি ঠেলে ফর্সা হলদেটে আলু আকাশের দিকে পেট উঁচু করে। সোরেন ভুলে যায় ওকে নিয়ে এখন খুনখার রাজনীতি চলছে। সরকারি ফড়ে না পাবলিক ফড়ে? মাণ্ডী কি খুলা বাজার? আলুর দামে ধার শোধ না বঁধুয়া মজদুর?
সাঁওতাল চাষীর ভাষা খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন