শারদ-সাহিত্যে হেমন্ত
উপক্রমণিকা
‘তোমারে যে চিনি চিনি, মনে-মনে কত ছবি এঁকেছি!’
জীবদ্দশায় কিম্বদন্তীতে পরিণত হওয়া সঙ্গীতশিল্পী হ’তে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক। গানের রেকর্ড বেরোনোর আগেই (নাকি কাছাকাছি সময়?) প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর লেখা গল্প। কিন্তু সরস্বতী চেয়েছিলেন অন্য কিছু,
তাই তিনি হ’য়ে গেলেন গায়ক, সুরকার (এছাড়া চলচ্চিত্র-প্রযোজক এবং একবার পরিচালকও)। তাঁকে সবাই সবচেয়ে বেশী চেনেন তাঁর ঐশ্বরিক কণ্ঠের মাধ্যমে, আর, তরুণ মজুমদারের কথায়, তাঁর গান জড়িয়ে গেছে আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে। এক-একটি গান এক-একজনের জীবনে হয়ে উঠেছে ধ্রুবতারার মতো পথপ্রদর্শক বা নিজের অন্তরের ভাবপ্রকাশের ভাষা!
এমন একজনকে নিয়ে যে চিত্র-বিচিত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অসংখ্য আখ্যান তৈরি হ’বে, সেটাই তো স্বাভাবিক! তাই তাঁর জন্মশতবর্ষে প্রকাশ পেয়েছে তাঁকে কেন্দ্র ক’রে কথাসাহিত্যের সমাহার। এর মধ্যে, বিগত এক বছর ধরে শরৎকালে, এবং অন্য সময়ে, রচিত সাহিত্যকর্মে হেমন্ত কীভাবে এসেছেন, তা’ নিয়ে একটি ক্ষুদ্র আলোচনা করতে চাই, কারণ ১৯৮৯ সালের শরতেই আমরা হেমন্ত-হারা হয়েছিলাম!
আগে হেমন্তকে নিয়ে রচনাগুলি মূলত স্মৃতিচারণ-ধর্মীই ছিল, যেমন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘হেমন্তর কী মন্তর’ বা শঙ্করের ‘চরণ ছুঁয়ে যাই’-তে হেমন্ত-অধ্যায়।
বিগত বছর
গত বছর পুজোয় প্রকাশিত হয় সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া’, যা জানুয়ারি ২০২০-তে পুস্তকাকারে বেরিয়েছে।[1] উপন্যাসটি ইতিহাস নয়, বাস্তব থেকে কিছু নাটকীয় উপাদান নিয়ে কল্পকাহিনিই। অতএব, বাস্তবের ছায়াপাতগুলি থেকে কল্পনাকে আলাদা করা আবশ্যিক। তবে উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অবিস্মরণীয়েষু’-কে!
উপন্যাসে মুখ্য চরিত্র তিনটিঃ গীতিকার-সুরকার অরুণেশ গোস্বামী, গায়ক মণিময় মিত্র এবং চলচ্চিত্রাভিনেতা নীহার চট্টোপাধ্যায়। কাউকেই মনে হয় বলে দিতে হবে না কোন-কোন বাস্তব চরিত্রের ছায়া এই তিনজনের চরিত্রায়নে পড়েছে! তবে মূল নারীচরিত্রে মিশে গেছেন বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের দুই ব্যক্তিত্ব।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় কাহিনি আবর্তিত হয়েছে তিন প্রধান পুরুষ-চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন ঘিরে। আর এই কাহিনি যে মোটেই ইতিহাস নয় তা’ বোঝা যায় বেশ কিছু ঘটনা থেকে। অরুণেশের লেখা আর সুর দেওয়া গান গেয়ে মণিময় খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। এরপর যখন এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ থেকে এবং আরও এক গূঢ় কারণে অরুণেশ মণিময়ের সংস্পর্শ ত্যাগ করেন, গায়ক তখন নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হয়ে ওঠেন সুরকার এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করেন যা’তে তাঁর সুরে অরুণেশের প্রভাব না থাকে। এ হ’লো লেখকের ইচ্ছাকৃত সমান্তরালতা। ঠিক এইভাবেই মণিময় তাঁর গায়ক-জীবনের শুরুর পরেই আস্তে-আস্তে তাঁর নিজের আদর্শ গায়কের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই দ্বিতীয় অংশটি (যা উপন্যাসে স্বাভাবিকভাবেই আগে এসেছে) ‘ছোট-পঙ্কজের’ হেমন্ত হয়ে ওঠাকেই লেখনে চিত্রিত করেছে, কিন্তু প্রথমটি একেবারেই কাল্পনিক। গীতিকার-সুরকার সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হ’বার অনেক আগে থেকেই হেমন্ত সুরকার-হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। আর অভিনেতা নীহার প্রথম দিকের অসাফল্যের পর দৈবাৎ একজনের বাড়ির বাইরে থেকে মণিময়ের গান শুনে সটান প্রযোজকের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাচ্ছেন যে, একটি নতুন ছবি করে তা’তে নীহারকে নায়ক আর মণিময়কে তাঁর নেপথ্য গায়ক করতে। এ সমাপতন একেবারেই সুখ-কল্পনার ফসল, তবে লেখকের বাস্তব থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে তার শৈল্পিক সমন্বয় ঘটানোয় দক্ষতা প্রদর্শন করে নিঃসন্দেহে। এই সমন্বয় অন্য স্তরে পৌঁছে যায় যখন নীহারের এই ছবিতে প্রযোজক নিয়ে আসেন নতুন নায়িকা বল্লরী রায়কে। এই জুটির প্রথম ছবিই দর্শকমহলে আলোড়ন ফেলে দেয়, আর ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক থাকেন অরুণেশ! কিন্তু সাফল্যের পার্টিতে ভিড় জমে গায়ককে ঘিরে, কারণ, ‘তাঁর গানের জোরেই নাকি এমন বিপুল হিট হয়েছে এই ‘অরুণোদয়’ ছবি।’ (পৃঃ ৬৯) (ছবিটির নামকরণ ‘নীহার’-এর বাস্তব সত্তার দিকে ইঙ্গিত করে; তাঁর পিতৃদত্ত নাম তো ‘অরুণ’-ই ছিল!) তবে, বাস্তবে এই তিনজনের সহ-উপস্থিতি কোন বাংলা ছবিতে ঘটেছিল বলে জানা নেই।
এইখানেই হয় তিন ব্যক্তিত্বের সংঘাতের সূত্রপাত। ক্ষুব্ধ অরুণেশ মণিময়ের ধারণা – ‘গায়কের নামেই গান চিহ্নিত হয়’ (৬৯) – খণ্ডন করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত থেকে রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত-দাশুরায় অবধি তুলনা টেনে বলেন, “চিরকাল সং-মেকারের নামে [গান] পরিচিত হয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পরে এই লাইট মডার্ন সং-এর জমানায় এসেই... সুরকার-গীতিকার আলাদা হওয়া শুরু হল, ওমনি [যদ্দৃষ্টং] গায়ককেন্দ্রিক হয়ে গেল বাজার।” (৭০)
এরপর মণিময়ের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ
করার ব্যাপারে আবার অরুণেশ আর নীহারের মধ্যে এসেছে, এক দিক দিয়ে সমান্তরালতা, আরেক দিকে বৈষম্য-প্রদর্শন। সমান্তরালতা হ’লো দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নারীঘটিত সমস্যা। বৈষম্য এখানেই যে অরুণেশ ঘর ছাড়েন
গায়িকা কৃষ্ণা সরকারের আকর্ষণে, আর নীহার স্ত্রী বল্লরীকে সন্দেহ করতে শুরু করেন মণিময়ের প্রতি বল্লরীর
মুগ্ধতা দেখে। লেখক ঐ কৃষ্ণা চরিত্রটির মাধ্যমে – যে চরিত্র মনে হয় কাল্পনিক – আবার উপন্যাসের এই তিন মুখ্য পুরুষ চরিত্রকে যুক্ত করেনঃ
নীহার-বল্লরী-মণিময়, আবার অরুণেশ-কৃষ্ণা-মণিময়। তার প্রতি
মোহে গৃহত্যাগী অরুণেশকে হতচকিত কৃষ্ণা প্রত্যাখ্যান করে, কারণ সে যে মণিময়কে ভালোবাসে, মণিময়ের সম্পূর্ণ অজান্তে!
এরপর, অরুণেশের সংসার ভাঙার পরোক্ষ দায়বোধ এবং মণিময়ের প্রতি একমুখী ও অপরিশোধিত প্রেমের যন্ত্রণায় আত্মঘাতী হয় কৃষ্ণা। শ্মশান থেকে ফেরার সময় মদ্যপানে-প্রায়-চৈতন্যহীন অরুণেশের মুখ থেকে আসল রহস্য জেনে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান মণিময়।
উপন্যাসের শুরুই হচ্ছে মণিময়ের প্রয়াণ দিয়ে, তারপর কিছু সমসাময়িক ঘটনা আর অনেকের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে অতীত-বর্তমানের পর্যায়ানুবৃত্তির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে কাহিনি। আখ্যানের অনেকখানি গড়ে উঠেছে দুটি সাক্ষাৎকার (অরুণেশ ও নবেন্দু) এবং তিনটি আত্মগ্লানিমূলক স্বীকারোক্তি (নীহারের লেখা এবং হাসপাতালে নার্সের সামনে বলা, অতসীকে ফোন করে নবেন্দুর বলা কথা, এবং অতসীর সামনে এসে অরুণেশের স্বীকারোক্তি দেওয়া এবং ‘রহস্য উদ্ঘাটন’ সম্পর্কে অতসীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত হওয়া) দিয়ে। উপন্যাসের শেষে আমরা শুনি সোনার তরী-র ‘গানভঙ্গ’ কবিতায় ‘নূতন লোক’, ‘নব নব রঙ্গে’র মধ্যে রাজা প্রতাপরায় আর গায়ক বরজলালের সভাগৃহ ত্যাগের উপাখ্যান।
অত্যন্ত মনোগ্রাহী রচনা, তবে লেখকের সঙ্গে একমত হয়ে বলছি, সাধারণ পাঠক যেন বইটি কল্পোপাখ্যান হিসেবেই পড়েন। যাঁরা ইতিহাস জানেন, তাঁরা অবশ্য অন্যরকমভাবে আখ্যানের রসাস্বাদন করতে পারবেন।
এই বছর
সৌরভবাবু এ বছর আর ‘গল্প’ লেখেন নি, যে ঘটনাক্রম উপন্যাসেও চিত্রিত হয়েছে, সেই উত্তম-হেমন্ত দ্বৈরথ নিয়ে অন্তরীপ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লিখেছেন ‘বন্ধু বুঝো না ভুল’।[2]
কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) ছবিতে উত্তমের সুরে হেমন্তকণ্ঠে ‘আমি যাই, চলে যাই’-এর উল্লেখ এবং নেপথ্য-কাহিনি দিয়ে শুরু হয়েছে এই প্রতিবেদন। তার পরেই এসেছে (নির্মম?) পরিসংখ্যান, যা লেখাটির বাড়তি শীর্ষক ‘উত্তম-হেমন্ত দ্বন্দ্ব’-কে বাস্তবের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ অবধি মাত্র ১১টি ছবিতে উত্তম ‘প্রত্যক্ষভাবে লিপ্ দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়নে, এবং সেই গানগুলির সংখ্যা বড়জোর ২৭/২৮!’ আর ১৯৬৬-র আগে - ১৯৫৫ সালে ‘শাপমোচন’ ছবিতে এই জুটির বিজয়-বৈজয়ন্তী ওড়ার পর থেকে (যদিও এর চার বছর আগে প্রথমবার ‘সহযাত্রী’ ছবিতে তরুণ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি গান ছিল নবাগত নায়কের লিপে, তেমন আলোচিত হয়নি তা) ওই ১৯৬৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরেই প্রায় ১৮/১৯টি ছবিতে আমরা দেখছি উত্তম-হেমন্ত চিত্রায়নের মণিকাঞ্চন— এবং সংখ্যাটি? প্রায় ৫০! …অন্তত প্রথম ওই একটি স্বর্ণমণ্ডিত দশক, উত্তমের নেপথ্যকণ্ঠদানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন সব্বাইকার প্রথম পছন্দ — দর্শকের, প্রযোজকের, পরিচালকের, সঙ্গীতকারের। সম্ভবত, প্রথমদিকের অনেকটা সময়, নায়কের নিজেরও। এই সময়পর্বে হেমন্ত যা-ই গেয়েছেন উত্তমের জন্য… সব হিট। অদ্ভুত মিল ছিল গায়কের ও নায়কের কণ্ঠের টিম্বারে, এমনকি বাচনভঙ্গিতেও। গানের মধ্যে টুকরো সংলাপ বলেছেন হেমন্ত, একেবারে মিলে গেছে উত্তমের গলার সঙ্গে। ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ কিংবা ‘মায়ামৃগ’ কিংবা ‘দুই ভাই’ ইত্যাদি অনেক ছবির গানে এমন নিদর্শন আছে।
১৯৬২ সালে হেমন্ত-প্রযোজিত প্রথম হিন্দী ছবি বিস সাল বাদ বম্বেতে নবাগত বিশ্বজিৎকে প্রভূত সাফল্য দেবার পরেই হেমন্ত স্থির করেন যে এর পরের ছবি শর্মিলা-র মাধ্যমে[3] তিনি উত্তমকুমারকে হিন্দী ছবির জগতে প্রতিষ্ঠা দেবেন। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে, হেমন্তর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি ঘটিয়ে উত্তম ছবি থেকে সরে দাঁড়ান। দুই ব্যক্তিত্বের দূরত্ব চরমে পৌঁছোয় ১৯৭০-এর পর। লেখক যথার্থই বলেছেনঃ যে-জুটি একদা চার বছরে (’৫৮ থেকে ’৬১) মোট ১২টা ছবিতে ৩০টি গানে জুড়ে ছিলেন, ’৭১ থেকে ’৭৪ এই চার বছরে তাঁদের মিলন ঘটল মাত্র দুটি ছবির চারখানি গানে! তার মধ্যে প্রথম দু’বছরের স্কোর— শূন্য!
আর কাল তুমি আলেয়া-র বছর, ১৯৬৬-তেই শঙ্খবেলা
ছবির মাধ্যমে দর্শকমানসে উত্তম প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর বিকল্প নেপথ্য কণ্ঠকেঃ মান্না
দে। লক্ষ্যণীয় যে কাল তুমি আলেয়া-তে হেমন্তের কণ্ঠ আছে বটে, কিন্তু গানটি কিন্তু কোন ভাবেই তাসের ঘর-এর ‘শূন্যে ডানা মেলে’, বা শুধু একটি বছর-এর ‘মোর মিলন-পিয়াসী মন’-এর মতো উত্তমের মনের কথা ব্যক্ত করছে না! গানের কথা সদ্য-প্রয়াতা এক নারীর (অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) বিদায়-গাথা - তাই, ’৬৬ সালের ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির ওই গানটি শুনলেই আজ কেমন অন্যরকম একটা মাত্রা যোগ হয় আমার অনুভবে। এই সেই ভাঙন-লগ্নের গান, যেন ভবিষ্যৎবাণীর ঘ্রাণ মেলে। গায়ক আর নায়কের ব্যক্তিগত সম্পর্কের যেটুকু সুরভি, তা শেষ হয়ে আসছে— কাঁটাগুলি এবার প্রকট হবে। আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ফিরে ফিরে আসছে লিরিকে। ‘আমারে খুঁজো না তুমি/ বন্ধু বুঝো না ভুল/ কাল সে আলেয়া শুধু/ আমি সে আলোর ঝরা ফুল...’
এরপর লেখক পেশ করেছেন আগের চেয়েও নির্মম এক পরিসংখ্যানঃ বোঝার সুবিধের জন্য রইল একটি চুম্বক-সার। কয়েকটি ছবির হদিশ মেলেনি, তাই approximate statistics. # ১৯৬৬-পূর্ব গান: মান্না-উত্তম= ১ (ছবি ১), হেমন্ত-উত্তম= ৫৫+ (ছবি ১৮+) # ১৯৬৬-পরবর্তী গান: মান্না-উত্তম= ৯০+ (ছবি ২৭+), হেমন্ত-উত্তম= ২৭+ (ছবি ১১+) ‘সিংহাসনচ্যুত’ কথাটা যে অত্যুক্তি নয় মোটেই, তা দেখাই যাচ্ছে।
সত্তরের দশকে এসেছে একাধিক ছবি যেখানে উত্তম-হেমন্ত যুগলেই উপস্থিত, কিন্তু উত্তমের কণ্ঠ মান্না দে, হেমন্ত গাইছেন অন্য শিল্পীর নেপথ্যে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ স্ত্রী, যেখানে হেমন্ত গেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। আবার সন্ন্যাসী রাজা-য় উত্তমের মুখে সমস্ত বাংলা গান মান্নার কণ্ঠে, শুধু ‘কা তব কান্তা’ স্তোত্রতে আমরা পেয়েছি হেমন্তকে, আর যে স্তোত্র উত্তম-অভিনীত চরিত্রের আগেই শোনা গেছে সেই সন্ন্যাসীদলের নেতার কণ্ঠে যারা সমুদ্রতীর থেকে অর্ধমৃত জমিদার (উত্তম)-কে উদ্ধার করছে। শোনা যায় যে শঙ্খবেলা-তে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত নাকি ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’-তে চেয়েছিলেন হেমন্তর রোম্যান্টিক কণ্ঠ, আর মজলিসী গান ‘আমি আগন্তুক’-এ মান্না দে’কে। তখন নাকি এই ছেঁদো যুক্তিতে হেমন্ত বাদ পড়েন যে এক অভিনেতার গলায় দু’জন ভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠ দর্শক নাকি নেবেন না! লেখকের কথায়ঃ ১৯৬৮-র ‘চৌরঙ্গী’ দিয়ে এর সূচনা, তার পর একসময় যেন এটাই নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল। উত্তমকুমার ছবিতে রয়েছেন, তবু ছবিতে হেমন্তর গান গেয়ে যাচ্ছেন অন্য অভিনেতারা! সাবরমতী, কমললতা, ধন্যি মেয়ে, স্ত্রী, অগ্নীশ্বর, ভোলা ময়রা...
উল্লেখিত ছবিগুলির মধ্যে নায়ক-গায়কের পরস্পর দূরত্ব, আমার কাছে, সবচেয়ে প্রকট সাবরমতী-তে। এখানে উত্তমের মুখে একটি গানে আমরা শুনছি কিশোরকুমারের কণ্ঠ! আর, সৌরভবাবুর ভাষায়ঃ ১৯৬৮র ছবি ‘সাবরমতী’, অনেকেই দেখে থাকবেন গোপেন মল্লিক সুরারোপিত অপূর্ব শ্রুতিমধুর সেই গানের চিত্রায়ন, ‘শোনো গো সজনী, পোহাল রজনী, দুখনিশি হল যে ভোর হে।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম পংক্তিগুলি যখন এক মায়াময় ঊষার প্রাকৃতিক পটভূমিতে ফুটে উঠতে থাকে, তখনও অনিশ্চিত— কে লিপ্ দিচ্ছেন। কিন্তু কণ্ঠের এমনই জাদু, শুরু থেকেই আমাদের মনের মধ্যে বাজতে থাকে, আহা, উত্তম...!
কিন্তু, না! অচিরেই দেখা যায়, পর্দায় রয়েছেন কিন্তু লিপ্ দিচ্ছেন না উত্তমকুমার। এক বৃদ্ধ বৈষ্ণব গান গাইছেন, উত্তমকুমার দূরে দাঁড়িয়ে, সুপ্রিয়া দেবীর মুখোমুখি। ঘাড়টি ঘুরিয়ে নায়ক একবার-দু’বার দেখলেন, শুনলেন গানটি, তারপর মুখটি ফের ঘুরিয়ে নিলেন নায়িকার দিকে।
কেমন আশ্চর্য একটা বিষণ্ণতা উঁকি দেয় এই গানটি শুনতে শুনতে। সবে ১৯৬৮, এই তো আগের বছরেও ‘নায়িকা-সংবাদ’ ছবিতে ‘এই পূর্ণিমা রাত’ গানে উত্তম-হেমন্ত রসায়ন ম্যাজিক তৈরি করেছে! ’৬৬তে নায়কের কণ্ঠদানে মান্না দে সফল হয়েছেন ঠিকই — কিন্তু তাই বলে হেমন্ত ছবিতে অংশ নিচ্ছেন তবু সে-গান অন্য লোকের ঠোঁটে আর উত্তম নীরব দর্শক, একই ছবিতে গান গাইবেন অন্য গায়কের গলায় — এতটা প্রথম ধাক্কায় মানতে কষ্ট হয়নি কি দর্শকদের?
দু’জনের এই দ্বন্দ্বের মোট তিনটি কারণ লেখক উল্লেখ করেছেন। এক, হেমন্তর শর্মিলা ছিল নায়িকা-প্রধান, কম বাজেটের, ছোট ব্যানারের ছবি। দুই, ছবিটি সফল হলে বিশ্বজিতের মতো উত্তমকুমারকেও হিন্দী ছবিতে ‘প্রতিষ্ঠা’ দেবার কৃতিত্ব পাবেন হেমন্ত, উত্তম সেখানে গৌণ হয়ে যাবেন। এবং, আমার, এবং, আমার মনে হয়, সৌরভবাবুরও, মতে উত্তম যে চরম অসৌজন্যতা হেমন্তর প্রতি দেখিয়েছিলেন, তার পেছনে ছিল সেই ফরাসী প্রবচনঃ cherchez la femme, ‘নারীটির সন্ধান করুন’! এবং সে নারী সুপ্রিয়া দেবী, যাঁর বাড়িতে হেমন্ত কলকাতার স্টুডিওর কাজ সেরে মধ্যাহ্নে বিশ্রাম নিতেন। লেখকের কথায়ঃ সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে প্রবল অধিকারবোধ ছিল উত্তমকুমারের। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থেকে নমুনা মেলে, তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিয়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা এমনকী অধিক সৌজন্য পর্যন্ত দেখালে ছেলেমানুষের মতো ক্ষুণ্ণ হতেন মহানায়ক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সম্ভবত জানতেন একথা, গুরুত্ব দেননি। ফলত তাঁকে ঘিরেও কি দূর গগনে কোনও মেঘ ঘনিয়েছিল? সুপ্রিয়া বলিউডে কাজ করতে যান, এ না-পসন্দ ছিল উত্তমের। সুপ্রিয়া কিছুটা তাঁকে অমান্য করেই হেমন্তর ডাকে বোম্বেতে গিয়েছিলেন। প্রিয় নারীর এহেন অবাধ্যতা, তাও আবার এমন পুরুষের প্ররোচনায় — যাঁর সঙ্গে ওই বোম্বের ছবি করা নিয়েই সদ্য মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে নায়কের নিজের — এর পুরো ক্রোধটি কি গিয়ে পড়েছিল ধুতি-শার্ট পরা দীর্ঘকায় মানুষটির ওপরেই?
এই প্রসঙ্গ শেষ করছি আবার লেখকের, আমার বিচারে, নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েঃ
ইতিহাস শুধু বলছে — এত কিছুর মধ্যেও যখনই উত্তমকুমারের জন্য গাইতে ডেকেছেন কোনও সঙ্গীত-পরিচালক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন আমন্ত্রণ। এমন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষ্যও পাওয়া যায় না যেখানে অভিমান-ক্রোধ মনে রেখে— উত্তমের ছবিতে অন্য অভিনেতার কণ্ঠে, এমনকী খোদ উত্তমের হয়েও — নেপথ্য-কণ্ঠদানে ‘অসম্মত’ হয়েছেন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এমনকী, উত্তম-অভিনীত ছবির সুরারোপ পর্যন্ত করেছেন, সে-সবের মধ্যে এমন ছবিও আছে যেখানে হেমন্তর নিজের গাওয়া গানে লিপ দিচ্ছেন অন্য অভিনেতা।
আমাদের মনে হয়, এই হল আদর্শ পেশাদারের মতো কাজ; সব আঘাত সব রক্তপাত জামার নীচে লুকিয়ে রেখে, শুধু কাজটুকুকেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া।
দুঃখের সঙ্গে আমরা মানতে বাধ্য, নায়ক সেই উদাহরণ রাখতে পারেননি সবসময়। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে তেমনটাই উঠে এল।
এক হেমন্ত-পূজারী হিসেবে সৌরভবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানাব, বাস্তবে যা হয়নি, কল্পনার জগতে তা’ ঘটানোর জন্য। তাঁর সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া উপন্যাসে বয়স ও ব্যাধি-বিদ্ধস্ত অভিনেতা নীহার চট্টোপাধ্যায় লিখিত স্বীকারোক্তি রেখে যাচ্ছেন গায়ক মণিময়কে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করে তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ব্যাপারেঃ “তখন সত্যিই আমার কবচকুণ্ডল … খুইয়েছি … মণিদাকে ছেঁটে ফেলেছি নিজেই …” (পৃঃ ১৪৬)।
ছোটগল্প
পৃথা কুণ্ডুর ছোটগল্পগুলি থেকে পাঠকের যা পরম প্রাপ্তি, তা হলো, একাধিক আখ্যানে নামোল্লেখ না রেখে বা ভিন্ন নামে প্রত্যক্ষভাবে আছেন আমাদেরই হেমন্ত। কখনো তিনি তাঁর উপস্থিতিতেই পাতানো বোনের বিধবা হ’বার পর তার মানসিক – এবং আর্থিক – ত্রাতারূপে, কখনো বা ছাত্রীস্থানীয়ার পিতৃবিয়োগের পর তার বিয়ে যা’তে দাবীহীন সৎপাত্রের সঙ্গে হয় এবং তার জীবনের একমাত্র রেকর্ড যা’তে সে করতে পারে তা নিশ্চিত করার কার্যকর্তা হিসেবে, কখনো আবার নিজেরই জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু কাণ্ডের সময় উপস্থিত থেকে, আর পরলোক গমনের পরে ইহলোক আর স্বর্গলোকে নানা ঘটনার সাক্ষী এবং অনুঘটক হ’য়ে। প্রতিটি গল্প ঠিক কিভাবে একজন, যিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে একজন ‘সঙ্গীতশিল্পী’, তাঁর সুরের সঙ্গতিতে বিভিন্ন মানুষের জীবনকে বাঁধতে সাহায্য করেছেন, তাদের দুঃখ-কষ্টের সময় বিশেষ করে, তার একেকটি নিদর্শন।
‘অন্তরালে’ গল্পটি সার্থকনামা। শুনেছি বাস্তবেও অনেকের বাহ্যিক-মানসিক বটবৃক্ষ ছিলেন আমাদের মহাশিল্পী। ‘বেঙ্গল টাইমস’-এর এবারের পূজা-সংখ্যায় ‘লকডাউন, অনলাইন ক্লাস এবং...’ একটি দীর্ঘতর রচনার অংশ। এটি সে অর্থে ‘গল্প’ নয়, লেখিকার অধ্যাপনা-জীবন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতার বর্ণনা, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কি করে তাঁর সাহিত্য-অধ্যাপনার কাজে নেমে এসেছিল শিল্পীর সাহায্য-রূপী আশীর্বাদ। ‘এবং মুশায়েরা’-র শারদ সংখ্যায় ‘যে জন আছে’-তে দেখি এক দম্পতির জীবনের সুখে-দুঃখে শিল্পীর উপস্থিতি। স্ত্রী সৌভাগ্যবতী, শিল্পীর প্রত্যক্ষ দেখা পেয়েছিলেন, এমনকি বর্তমান স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারেও তাঁর পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। স্বামী বিপত্নীক হবার পর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে অন্তাক্ষরী খেলতে গিয়ে গেয়ে ওঠেন স্ত্রীকে যে রেকর্ড শিল্পী উপহার দিয়েছিলেন, তার গানঃ ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’।
সেপ্টেম্বরে ‘অপরজন’-এ প্রকাশিত ‘কড়ি ও কোমল’-এ উন্মোচিত হয়েছে শিল্পীর সত্তার একটি অন্য দিক, যে সম্বন্ধে এই লেখক হয় কোনদিন সেভাবে ভাবে নি, বা যে ব্যাপারে সে অস্বস্তিই বোধ করেছে। যেমন, কেন ঐ শিল্পী ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ গাইতে এত ভালোবাসতেন! লেখিকা একটি গল্পের চরিত্রের চিন্তার মধ্য দিয়ে মনে করিয়েছেন, ‘একজন স্রষ্টা, একজন প্রকৃত শিল্পী নিজের মধ্যে ধারণ করেন প্রকৃতি ও পুরুষকে’, যাকে পাশ্চাত্য সমালোচক আখ্যা দিয়েছেন ‘creative androgyny’! এমন অনেক মূল্যবান উপলব্ধি ছড়িয়ে আছে কাহিনীগুলির মধ্যে। ‘প্রতিলিপি’-তে শারদ অর্ঘ্য হিসেবে প্রকাশিত ‘সাগরের ঠিকানায়’ নামের অণু-উপন্যাসে তিনি আছেন ‘অসীমাভ দেবনাথ’ (এমন নানা নামেই আমরা লেখিকার গল্পে আমাদের প্রাণের মানুষটিকে পেয়েছি)-রূপে। দুই প্রজন্মের সাংবাদিক-জীবনের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছেন তিনি, এক বর্তমানে-প্রয়াতা ভক্তের সাক্ষাৎকার-এবং-বিশ্লেষণমূলক রচনার কেন্দ্ররূপে। এর মধ্যেই উঠে এসেছে লোকমুখে শোনা শিল্পীর বিভিন্ন মানবিকতা-পরোপকারিতার নিদর্শন।
এছাড়া, গল্পগুলির একটি বিশেষত্ব হ’লো, প্রতিটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে শিল্পীর একেকটি গান। গানগুলি আগে এবং পরে অন্যরা গেয়ে থাকলেও তিনি গাইবার পর সেগুলি, অন্তত হেমন্ত-ভক্তদের মনে ‘হেমন্তের গান’ বলেই রয়ে গেছে। পুজোর অনেক আগে প্রকাশিত ‘অন্তরালে’-তে সেই গান যেটি নির্বাচন করেছিলেন তরুণ মজুমদার, কিন্তু অবিস্মরণীয় করে গেছেন হেমন্তঃ ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’। ‘লকডাউন, অনলাইন ক্লাস এবং ...’-তে আছে ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’, ‘ঝড় উঠেছে, বাউল বাতাস’, আর হিন্দী ‘বাদবান’ ছবির ‘আয়া তুফান’ (যে গানের আস্থায়ী লেখিকা একটু ভুল করে লিখেছেন ‘তুফান আয়া রে’)। ‘যে জন আছে’-তে তো বিপত্নীক প্রিয়তোষ শেষে গেয়েই উঠছেন, ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে’, যে গানের রেকর্ড শিল্পী উপহার দিয়েছিলেন প্রিয়তোষের প্রয়াতা স্ত্রী পূর্ণিমাকে। ‘কড়ি ও কোমল’-এ আছে ‘আমার মন মানে না’, যা এক নারীরই উক্তি, কিন্তু সফলভাবে গেয়েছেন হেমন্ত (গল্পের ‘স্নেহাংশু’), আর ‘সন্ধ্যা হ’লো গো, ও মা’ এবং ‘তুমি কেমন ক’রে গান করো হে গুণী’। ‘সাগরের ঠিকানায়’ অণু-উপন্যাসে শুধু গান নয় (রজনীকান্তের ‘আমি অকৃতী অধম’), এসেছে শিল্পীর রবীন্দ্রচেতনা।
‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যের অরুণেশ্বরকে নিয়ে তিনি সাংবাদিক রেবাকে বলেন, “...অর্জুনের মত ‘অহো, কি দুঃসহ স্পর্ধা’ বলে নিজেকে জাহির করে না। আনন্দর মত বাইরে থেকে এসে কাউকে উদ্ধার করে না... বাল্মীকির মত হঠাৎ করে মা সরস্বতীর আশীর্বাদও পায় নি সে। উল্টে সে অভিশাপ পেয়ে নেমেছে। তার আছে কেবল সুরটুকু।... সে বীণা বাজায়, নিজের লিমিটস জানে। বলে, আমার গানেই তুমি আমায় দেখ। বাইরে দেখতে যেও না । বাইরে থেকে দেখলে ভুল হতে পারে, হয়ত নিজের লোকেও ভুল বোঝে... তবু সে নিজেকে ছোট হতে দেয় না, কাউকে ছোট করেও না। আড়ালে বসে নিজের কাজটা করে যায় আর রেকগনিশনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।” তাঁর রবীন্দ্র-অনুধ্যান কত গভীর ছিল, এই আলোচনাই তার প্রমাণ।
সব শেষে ‘পরবাস’ পত্রিকায় জুলাই মাসে প্রকাশিত হাস্যরসাত্মক ‘স্বর্গ হইতে’ গল্পে এসেছে বি আর চোপড়ার ‘লোগো’-তে শ্লোকোচ্চারণ “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে...” আর রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে’, কারণ ঠিক এইভাবেই তো শিল্পী আমাদের হৃদয় আজও দুলিয়ে চলেছেন!
দুই লেখকের তুলনা
সৌরভবাবু সমকালীন সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোয় অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চোখ দিয়ে হেমন্তকে দেখিয়েছেন। এই সব বিখ্যাত চরিত্রের ভেতরে কি হচ্ছে, সেটা দেখাতে গিয়ে তাঁকে নিজস্ব ধারণার আশ্রয় নিতে হয়েছে অনেকটাই। পৃথা ব্যবহার করেছেন খণ্ড ইতিহাসের লেন্স। যাঁদের চোখ দিয়ে এই মানুষটিকে নানা রূপে দেখা, তাঁরা সবাই সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাঁরাও একধরনের 'প্যারালাল হিস্ট্রি'র অংশীদার। আর 'তাঁর' মনের ভেতর ঠিক কি হচ্ছে, তা বোঝানোর চেষ্টা পৃথা করেন নি। উল্টোদিকের মানুষগুলো নিজেদের মত করে ভেবে চলুক। পাঠকও ভাবুন। এ ছাড়াও পৃথা হেমন্তর রবীন্দ্র-অনুধ্যানের ব্যাপারটা সামনে আনতে চেয়েছেন, খুব স্বাভাবিক ভাবে, শ্বাস প্রশ্বাসের মত। আর দৈনন্দিন জীবনে মানুষটা যেভাবে কথা বলতেন, সেটা যথাসম্ভব রাখার চেষ্টা তিনি করেছেন।
উপসংহার
প্রতিটি লেখায় অন্তঃস্তলে কিন্তু আছে কোনো না কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা’র সঙ্গে মিশেছে সামান্য কল্পনার রং। যে মানুষটি প্রয়াণের একত্রিশ বছর পরেও লেখক-লেখিকা এবং বর্তমান প্রবন্ধকারের মতো অনেকের জীবনে এক উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত উপস্থিতি, তাঁর এই সশ্রদ্ধ নিবেদন প্রাপ্য ছিল।
[1] সৌরভ মুখোপাধ্যায়, সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া (কলকাতাঃ আনন্দ, ২০২০)
[2] (Publication,
Anatareep. Sharadiya Anatareep 1427: শারদীয়া অন্তরীপ ১৪২৭ (p. 22-32). Antareep Publication.
Kindle Edition.)
[3] ‘শর্মিলি’, আমার মনে হয়, অভীক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত হেমন্তবাবুর আত্মজীবনী আনন্দধারা-র ২০১৩ সালের পুনঃপ্রকাশে একটি মুদ্রণ-প্রমাদ (৭৯ পৃষ্ঠা) । বইটি যখন ভাদ্র ১৩৮২ বঙ্গাব্দে (ইংরেজী ১৯৭৫ সালে) প্রথম প্রকাশিত হয়, তার ১০৩ পৃষ্ঠায় ‘শর্মিলা’ই আছে।
এই গল্প উপন্যাস গুলির কথা তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন