সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

ফারহানা রহমান

 

মহাদেব সাহা : সময়ের বিশুষ্ক ও বিশীর্ণ কাব্যধারার কবি       

 


মহাদেব সাহা যতই পড়েছি মনে হয়েছে কবি যেন এক সীমাহীন অন্ধকারের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পান সূর্যাস্তের রঙে আঁধারের প্রতিটি আস্তরণ,   যেখানে আমাদের অনুভূতির নীল দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে। কুহেলি মাঠের  প্রান্তরে দাঁড়িয়ে অবিনাশী জীবনের আলোক সম্ভাবনার ইঙ্গিতও পাই সেখান থেকেই...। নিজের সৃষ্ট এক স্বতন্ত্র কবিতার ভুবনে যিনি ধ্যানমগ্নতায় ব্যথিত বিভোর হয়ে গত চার দশকে সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর এক হৃদয়স্পর্শী, অশ্রুসজল বিধুর চিত্রময় প্রেমের পঙক্তি। মহাদেব সাহা, আমাদের দেশের ষাট দশকের কবিদের মধ্যে একজন প্রধান ও খ্যাতিমান কবি। পাঠকের চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে -  নির্লিপ্ত, উদাসীন, কখনো বিষণ্ণ ও অভিমানী, কখনো হাস্যোচ্ছল কিন্তু সর্বদাই ভালোবাসায় নত। অসামান্য সাবলীলতায় তিনি সংবেদনশীলতার প্রকৃত রূপটি তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। মানুষের শুভবোধ,  মানবিকতা, প্রেম, বেদনা, নিঃসঙ্গতার হাহাকার, জাতীয়তাবোধ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশেষ ঝোঁক, তাঁর কবিতার মুল বিষয়। আবেগের স্বতঃস্ফূর্ততা ও প্রেম- প্রকাশের সরলতায় ও মননশীলতায় তিনি কাব্যরচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সহজিয়া প্রেমাবেগের সঙ্গে  সমকালীন সামাজিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে তিনি অনিবার্য সত্যের মতোই কাব্যরূপ দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় যেমন মূর্ত হয়ে  উঠেছে আমাদের এই চিরপরিচিত জীবন, এই প্রকৃতি, চরাচর – তেমনি উন্মোচিত হয়েছে এক অজানা রহস্যের জগৎ। তাঁর কবিতা, আশ্চর্য কোমল ও গীতল স্বতঃস্ফূর্ত, চিত্রময়, হৃদয়স্পর্শী।  

ষাটের দশক ও তার পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের কবিতা বিষয় ও শিল্পমুল্যের বিচারে এক অভূতপূর্ণ স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করে, ফলে এ সময়ে এসে কবিতায়  নতুন এক আন্দোলন সৃষ্টি করা ছিল অত্যন্ত কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। ষাটের কাব্যান্দোলনের অন্তরালে যে রুগ্নতা, ক্রন্দন, অন্তঃসারশূন্যতা ও অপূর্ণতা ছিল,  তার প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো যেসব কবিতা, তাতে ছিল সচেতনভাবে রাজনীতি  বিচ্ছিন্নতা। জাতীয়তাবোধের প্রেরণা থেকে সরে এসে এসময়ের কবিরা কাব্যচর্চা  করেছিলেন পচন, ক্লেদ আর রুগ্নতার নিঃসঙ্গ ঘরে নিজের ভিতর নিজেকে আবদ্ধ করে রেখে।  সেই বিচ্ছিন্নতার পৃথিবীতে দেশ জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে লেখক- কবিদের নন্দন ভাবনায় প্রাধান্য পেয়েছিলো ব্যক্তিসর্বস্বতা, রুগ্নতা ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতির ধারা। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে এ ভূখণ্ডের কবিতায় সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতার যে উন্মেষ হয় তাতে বিষয়গত মৌলিকতার ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার স্বার্থে নতুন প্রজন্মের কবিতা তা থেকে সচেতনভাবে সতর্ক দূরত্বে অবস্থান করে। এই জন্মান্ধ ও জন্মেই কুঁকড়ে যাওয়া স্বপ্নের বাস্তবতার মুখোমুখি, আত্মরতিপ্রবণ মধ্যবিত্তের জীবনচক্রে ঘূর্ণায়মান কাব্যলোক থেকে বেরিয়ে আসার আন্তরিক চেষ্টাও ছিল এসময়ের কবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এবং একইসাথে এই দশকের শেষ দিকে এসে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে আর ঊনসত্তরের গণআন্দোলন শুরু হলে ষাটের কবিরা জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। 

কবি মহাদেব সাহার জন্ম বাংলা ১৩৫১ সালের ২০ শ্রাবণ, ইংরেজি ১৯৪৪ সনের ৫ আগস্ট বৃহত্তর পাবনা জেলার ধানঘড়া গ্রামে। পিতা গদাধর সাহা, মাতা  বিরাজমোহিনী। পিতামাতার একমাত্র সন্তান তিনি। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় দেখা হয় কুমিল্লার মেয়ে নীলা সাহার সাথে। বার দুয়েকের দেখাশোনায় নিজেদের একটু জানাশোনাও হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে নিজেদের পছন্দে দুজন বিয়ে করে ফেলেন। তাঁদের দুই পুত্র সন্তান তীর্থ সাহা ও সৌধ সাহা।

শিক্ষাজীবনের শুরু কালীতলা প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৬১ সালে ধুনট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় চলে আসেন তিনি এবং ঢাকা কলেজে  ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। কিছুদিন পর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ফিরে যান বগুরায় এবং সেখানেই ভর্তি হন কলেজে। সে সময় সিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি  চর্চার ভীষণ অনুকূল পরিবেশ ছিল বগুরা শহর, ফলে কবি মহাদেব সাহা  তুমুলভাবে সেখানে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। শহরের বুকে ‘বেণীপুর বুক হাউজ’  ছিল সকল সাহিত্যমোদীদের প্রিয় ঠিকানা। সে সময় তিনি ও কিছু আধুনিক প্রগতিশীল তরুণ মিলে বের করেন  লিটিল ম্যাগাজিন ‘বিপ্রতিক’। একই সময়  তিনি অভিভূত হন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’এর  সংস্পর্শে এসে। নিজ জীবন দর্শনের প্রতিফলন তিনি দেখতে পান এই পত্রিকায়। কণ্ঠস্বর পত্রিকার শ্লোগান ছিল, “যারা সাহিত্যের স্বনিষ্ঠ প্রেমিক, যারা শিল্প উন্মোচিত, সৎ, অকপট, রক্তাক্ত, শব্দতাড়িত, যন্ত্রণাকাতর, যারা উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী, যারা তরুণ, প্রতিভাবান, অপ্রতিষ্ঠিত,  শ্রদ্ধাশীল, অনুপ্রাণিত, যারা পঙ্গু, অহংকারী, যৌনতাপিষ্ট - কণ্ঠস্বর তাদেরই পত্রিকা”। এরই মধ্যে ডাক আসে স্বাধীনতার। দেশ এগোতে থাকে স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে  এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর বাংলায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৮ সালে। সেই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রকৃতপক্ষেই সাহিত্যের তীর্থভূমি। কবিতা লিখে মহাদেব সাহা সর্বস্তরের সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। একই সময়ে ঢাকার অনেক পত্রিকাতেও নিয়মিত ছাপা হতে থাকে তাঁর কবিতা। ৬৯-র জুন মাসে 'কন্ঠস্বর' সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উদ্যোগ নেন তরুণ কবি-লেখকদের নিয়ে প্রথম সাহিত্য উত্সব করার। এই সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পড়ার জন্য মহাদেব সাহাকে অনুরোধ করেন 'কন্ঠস্বর' সম্পাদক। ঢাকায় এসে উঠলেন আবু সায়ীদেরই গ্রীন রোডের ছোট্ট দুই রুমের বাসায়। সম্মেলনে নতুন লেখকদের সঙ্গে পরিচয় হল আর প্রবন্ধ পড়ে পেলেন যথেষ্ট প্রশংসা। এরপরই গভীর অনুরাগ আর ভালোবাসার শহর রাজশাহী ছেড়ে, প্রমত্তা পদ্মা ছেড়ে চিরতরে পাড়ি জমান ঢাকার বুকে। এ প্রসঙ্গে কবি  মহাদেব সাহা বলেছেন, “গার্ড বাঁশি বাজালেন। পেছনে পড়ে রইল রাজশাহী, মতিহার, কাজলা, উন্মুক্ত উথাল পদ্মা, আমি তাকিয়ে আছি অনন্তের দিকে। আর সঙ্গে নিয়ে চলেছি বহু আনন্দ-বেদনা, ভালবাসার স্মৃতি। সবার জীবনে যেমন আমার জীবনেও তেমনি সেই উদ্দীপ্ত মুখর দিবারাত্রির কলধ্বনি নীরবে বহে চলেছিল মনে। আমি রাজশাহী ছেড়ে ঢাকা যাচ্ছি, সে ছিলো অতল জলের আহ্বান, কবিতাময় দিনরাত্রির স্বপ্ন”।

১৯৬৯-এর জুলাই মাসে দৈনিক 'পূর্বদেশ'-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন মহাদেব সাহা। ১৯৭৮ থেকে ৮৪ পর্যন্ত কাজ করেন সংবাদ পত্রিকার সাথে। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩০ বছর একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন ইত্তেফাক পত্রিকায়। সাহিত্যের পালাবদলে বাংলা কবিতার শাশ্বত  রূপটিকে মহাদেব সাহা স্বব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন তাঁর ৫৯টি কাব্যগ্রন্থে। এই প্রধান কবি গ্রন্থাগারে প্রথম সূচিবদ্ধ হন ১৯৭২-এ। 'এই গৃহ এই সন্ন্যাস' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কবিতার বই ছাড়াও লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, আত্মজীবনী, সমালোচনাসহ নানা ধরনের রচনাও। সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮১।

কবি মহাদেব সাহার কবিতার একটা প্রধান প্রবণতা হচ্ছে প্রেম। ব্যর্থতা ও বিষাদ, নৈঃসঙ্গ , একাকীত্ব ও বেদনাবিধুর জগতের বিদীর্ণ বেলাভূমিতে কবি ভালোবাসার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকেন। মর্ম-স্পর্শী সুখ-দুঃখ গাঁথার এক অবিরাম উপাখ্যান হয়ে উঠেছে মহাদেব সাহার কবিতা। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক মনস্কতা তাঁকে টেনে আনে মাটি আর মানুষের  কাছাকাছি। তাঁর  কবিতার শব্দনির্বাচন, ধ্বনি, চিত্রকল্প সবকিছুই যেন মৌমাছির মতো গুঞ্জরণ তোলে মানব মনেঃ , “ভালোবাসা তুমি এমনি সুদূর স্বপ্নের চে’ও দূরে/ সুনীল সাগরে তোমাকে পাবেনা আকাশে ক্লান্ত উরে/ ভালোবাসা তুমি এমনি উধাও এমনি অগোচর / তোমার ঠিকানা মানচিত্রের উড়ন্ত ডাকঘর” (ভালোবাসা), অন্য একটি কবিতায় দেখি, “তুমি যখন আমার কাছে ছিলে/ তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো/ তুমি না থাকলে বড়ো দুঃসময় যায়, সর্বত্র বন্ধুবিহীনভাবে বাস করি/ এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়/ নিজেকেই নিজের কাছে অজানা লাগে/ মনে হয় দীর্ঘদিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি”…  

মহাদেব সাহার কবিতার আরও একটি কেন্দ্রীয় বিষয় মানুষ। মানুষের শুভবোধ, শুভচেতনার প্রতি আস্থা, মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা তিনি ভেবেছেন আর তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে। মানুষের কল্যাণচিন্তা, মানবিকতা, বিপন্ন মানুষের মুক্তির  কথা তিনি বারবার তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। আত্মমুখি ও উল্লম্বধর্মী চেতনার  জগৎ থেকে কবিতার ক্ষেত্রকে তিনি প্রসারিত করেছেন জীবনের অনুভূমিক রেখার দিকে। তিনি ভেবেছেন সমাজতন্ত্র মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনতে পারে। তাকে কষ্ট দিয়েছে মানুষের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা, তিনি সর্বতভাবে ঘৃণা করেছেন, বিরোধিতা করেছেন যুদ্ধের ও সাম্প্রদায়িকতার। “এ কী বৈরী যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সকলে/ সূর্য নিয়ত ঢাকা চিররাহুগ্রাসে, মানবিক প্রশান্ত বাতাস এখন বয় না কোনোখানে/ শুধু সর্বত্র বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব” ( যদুবংশ ধ্বংসের আগে)।  অন্য একটি কবিতায় দেখি, “বড়ো ত্রাস, সদর দরজা ভেঙে / যেন হুহু করে মধ্যরাতে ঢুকে পড়ে সন্ত্রাসের ট্রাক/ অকস্মাৎ ভেঙে দেয় নিসর্গের রম্য খেলা/ জ্যোৎস্নাময় এ রাত্রি, কাঁঠালিচাঁপার বন/ বনচারী পাখিদের শান্ত ঘুম/ অবকাশ/ ত্রাস/ শুধু ত্রাস”।  “লেলিন, এই নামটি উচ্চারিত হলে/ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে প্রাণ/ দেখি ভল্গা থেকে নেমে আসে মানবিক উৎসধারা  আমাদের বঙ্গোপসাগরে” (লেলিন এই নাম উচ্চারিত হলে)।  

মহাদেব সাহার বহুমাত্রিক সাহিত্যকর্ম তাঁর কবিতার নান্দনিকতা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একদিকে তিনি প্রেমিক, রমণপ্রিয়, নারীর সৌন্দর্য ও শরীরের প্রতি আগ্রহী। আবার অন্যদিকে সামাজিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন এক মানুষ। প্রেম ও রমণীর সান্নিধ্য – আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে কখনই আড়াল করতে চাননি। তাই তিনি যখন দেখতে পান স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার আগেই সব স্বপ্নগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, শুরু হয়েছে স্বাধীন বাংলার পিছন দিকে পথ হাঁটা, তিনি মুষড়ে পড়েন। তিনি দেখেন বাকস্বাধীনতার মানে বন্দুকের নলের উপর বুক ঠেকিয়ে রাখা। সেই সময় দেশ ও জাতির গভীর ক্রান্তিকালে মহাদেব সাহার কবিতায় তখন উচ্চারিত হয় দ্রোহ আর প্রতিবাদ। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তখন কবিতা প্রকাশ করেন 'সংবাদ', 'সমকাল'সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। “তাহলে কি গোলাপেরও দেশপ্রেম নেই/ যদি সে সবারে দেয় ঘ্রাণ/ কারো কথা মতো যদি সে কেবল আর নাই ফোটে রাজকীয় ভাসে/ বরং মাটির কাছে ফোটে এ অভিমানী ফুল/ তাহলে কি তারও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ উঠবে চারদিকে?” (দেশপ্রেম)।

আপাত সরল অথচ জীবনগ্রাহী নির্মিতির মাধ্যমে বাংলা কবিতায় এক অনন্য সম্মোহনের জগত বিনির্মাণ করেছেন কবি মহাদেব সাহা। তাঁর কবিতার রয়েছে  একদিকে  আবেগ, ব্যক্তিকশূন্যতা, সঙ্কট, বিরহকাতরতা ও প্রকৃতিচেতনা। আবার অন্যদিকে মূর্ত হয়ে উঠলেও বোধের গভীরতা। শব্দের ভেতরের শব্দ, কবিতার ভেতরের কবিতাকে অনায়াসে তুলে আনার কারণে তাঁর কবিতা যেমন  স্বতন্ত্র তেমনি নান্দনিক। গভীর জীবনবোধ জারিত তাঁর প্রতিটি কবিতা তাই  সঙ্গত কারণেই মহাদেব সাহার কবিতা যেমন মানুষের মনস্তত্ত্বকে ধারণ করে; তেমনিভাবে সমাজের বিবিধ অনুষঙ্গকেও নিজস্ব বিষয়ে পরিণত করেছে।  

মহাদেব সাহা সেই প্রাণিত কবি যিনি এই সময়ের বিশুষ্ক ও বিশীর্ণ কাব্যধারায় ফিরিয়ে এনেছেন বসন্তকাল, নবজীবন। বাংলা কবিতার শাশ্বত আবেগময় রূপটিকে তুলে ধরে কবিতাকে করেছেন সজীব, হৃদয়গ্রাহী ও জনপ্রিয়। তিনি পাঠককে ফিরিয়ে এনেছেন কবিতায়। তাঁর কবিতা তাঁর নিজের সৃষ্ট এক স্বতন্ত্র  ভুবন  - যেখানে তিনি নিজেকে উন্মোচিত করেছেন পাঠকের কাছে। এই ধ্যানমগ্ন, ব্যথিত, বিভোর কবি মোহময়ী ভাষায় রচনা করেছেন আমাদের নিবিড় জীবনভাষ্য।



কবি তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে তাঁর কবিতাতেই স্পষ্ট করে বলে গেছেন নিজের  গোপন কথা (আমার জীবনী)।

“আমার জীবনী আমি লিখে রেখে যাবো/মাটির অন্তরে, ধুলোর পাতায়/লিখে  রেখে যাবো মেঘের হৃদয়ে/ বৃষ্টির ফোঁটায়/ হাঁসের নরম পায়ে/ হরিণশিশুর মায়াময় চোখে/ ফুলের নিবিড় পাপড়িতে আমি লিখে রেখে যাবো/আমার জীবনী/ লিখে রেখে যাবো বৃক্ষের বুকের মধ্যে/পাহাড়ী ঝর্নার ওষ্ঠে/সবুজ শস্যের নগ্নদেহে”।  

 

 

1 টি মন্তব্য: