ছাউনির সুলুক সন্ধানে মেঘ ও মেঘালির উড়ে যাওয়া রুমাল
মহুয়াভোরে একটা বৃত্ত নিয়ে বসেছি। তুখোড় মজলিস উড়ছে নীয়কের ভূমিকায়। জ্যা সংক্রান্ত খুঁটিনাটিগুলোতে সুলুকসন্ধান করতে করতে ছিটকে যাচ্ছি কেন্দ্র থেকে। নিমরাজি চাঁদে তখন তুমুল শিমুল। আঁচলের সিন্থেসিস হচ্ছে উড়ানের উইন্ডস্ক্রিনে। যেকটা সইসাবুদ পরিধিপ্রান্তে বসে রিখটারে মাপছিল কাঁপনের সঞ্চয়ী হাসিগুলো, তাদেরকে স্পর্শক বরাবর ছুট দিই। ছুটদুরস্ত দৌড়ের ট্র্যাক ঝুলে থাকে দরিয়া বরাবর। কাঞ্চনমালার পায়ের আঁচড়ে তখনপ্রতীক্ষা বাজছে। ট্রিগার টেপার একটু আগেই জলছল হয়ে এল প্রতিযোগী ভাইরাস। ফলত আঁকাআঁকির সাতকাহন সত্ত্বেও হাফটোনে রয়ে গেল বৃত্ত আমার।
মহুয়াভোরে সফর-এ নেমে কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত কোয়েলিয়া গাইলেন। নেশাধুন রঙ ছড়াচ্ছে আভোগে। তবু অন্তরায় ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসতে হয় অগতির গতিময়ে, নিয়ন আলোর নিয়তিতে, যেখানে তুখোড় মজলিস সুদ্ধ উড়ছে রুমালি। সহজতার মোহিনী আঁখিপাত ছাড়িয়ে, সমস্ত বন্ধন ভেঙে যখন কবি অভিজ্ঞতা যাপনগুলি লিখতে বসলেন, তখন কেউ কেউ বলল এ কবিতা নয়, নতুন কবিতা। খুব গভীর করে বাজল সুর্মার অসহ্য কোয়েলিয়া। কুহুরবে থৈ থৈ-
রুমালির ছোঁড়া ড্রইংরুম আগুনে নামছে
ঘুরতে ঘুরতে ফ্লেমিশ─
হাফটোনে কলতলা তানে সপুর দুকাল
ছাড়া মোজারা ভুলেছে যাপন
মহুয়াভোরা সুহানায় সফরে [ সফর ]
কবি কবিতা ও পাঠকের ত্রিভূজে আহ্বান করেন
পাঠককে─ উচ্চারণ করেন ছুঁয়ে
যাওয়া কল্পনাই কবিতা। আর কবি হলেন অ্যাস্ট্রনমার, ধীরে ধীরে পৃথিবীর মাটি
ছুঁয়েছেন, খুব আলতো সুরে সুবর্ণরেখার জল। তারপর আবার ডানা মেলা। দিগন্ত থেকে আদিগন্ত
ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া। আর এই উড়ে যাওয়ার ত্রিকোণমিতিতে বাসা বাঁধে পাঠক-
রবার বরাবর উড়ছে যে আকাশ
তার নাম দিলাম ডানা
দিনের গায়ে আঁকলাম পালক [ টিউনিক ]
এভাবেই ‘নীল আয়ত’, যেখানে মোহের বিস্তার
এক পা দু পা, সেই পিয়াবিনা পিয়ালের পাপিয়া পথেকবির সুলুক সন্ধান, ‘মেঘ সুলুকের
ছাউনি’। এই চলাচল খুব মৃদু লয়ে কথা কয়। পাথুরে বরফ ভেঙে সংগোপনে হাত রাখে দুরূহ চূড়ায়।
কবি বারীন ঘোষাল বলেন –
মাত্র আঠাশটা ক্রিয়াপদ দিয়ে কবির
বাংলাভাষা, ব্যয় হতে হতে ব্যয় হতে হতে এখন
তোতলামি মনে হয়। শব্দের ছুঁত্মার্গে এঁটো ক্লিশে অলঙ্কার ও মিথ এসব থেকে প্রলোভন, বশ্যতা ও অজ্ঞানতা কবির যায় না। অথচ
শব্দভান্ডারের শেষ নেই। আকাঁড়া ব্যবহার এবং শব্দনির্মাণ কবির হাতের মুঠোয়...
তাই দেখি বাঁধা শব্দমালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত বেঁধেছেন নতুন শব্দমালা, মরমী ঢঙে মরমিয়া শব্দের ছায়ায় নরমিয়া শব্দে আলতো হাত রেখেছেন। বাংলা শব্দভান্ডারের সীমানায় বাঁধা ছিল কিছু অতৃপ্তি। তাই অচিন পাখির ডানা ছুঁয়ে এক পা দু পা। গড়ে উঠছে ভাবনাপ্রধান গমন ও প্রতিগমনের নিজস্ব শব্দভান্ডার─
হাত পড়ল মরমী নরম নরমিয়া
হক মাঙ্গার আমিষী আবেশে মিশি
আতা তোতা সবেতেই সজল [ টিউনিক ]
নির্মাণের পথে কবির ইচ্ছা অনিচ্ছায় একটি
সূত্র জড়িয়ে থাকে কবিতার শরীরে, যা খুব দৃশ্যমান নয়, অস্পষ্ট আলতো ছোঁয়া-
বাজেনি তখনো
আঙটায় আটকানো টিংটিং
নজর পড়তেই
ছাতার মাথা রোদজলে বেরঙ
আদুরে মুখখানা নুন হলো
যেসব কথা ভেবে [ প্রতীক্ষা ]
কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত বুঝিয়ে দেন কবিতার
গঠনতন্ত্র ভাষারই গঠনতন্ত্র। আর সেই গঠনতন্ত্র বিশ্লেষিত হয় বিনির্মাণে। যে বিনির্মাণ
কবির নির্মাণ প্রসেসের ওপর বিন্দু বিন্দু আলো ফেলে, পথ দেখায় পথিককে। গভীর আহ্বান
ধ্বনিত হতে থাকে নতুনের পথে, সবুজের পথে। কবি বলেন, “ধরো ঘোড়াগুলো মহিনের নয়”। বৃষ্টিঠোঁট বুকের কাছে
স্পর্শ করে। গ্রীবা বেয়ে নেমে আসে অজস্র আকাশ, থির থির করে কাঁপতে থাকে সায়নীর হারিয়ে
যাওয়া ঠিকানা,
ছাড়া জুতোর জরিপে পা টানছে পূবালী
মেঘ
ধরো যৌনতার নামে কাঁপলো কয়েকটা
পাতা আর
ছড়ানো শিশিরের সীলমোহরে কিছু
বাসহীন সুবাস
সাঁঝবেলার সীমানায় সায়নীর ঠিকানাটা
একটু বলবে [ ঠিকানা চেয়ে ]
মাঝে মাঝেই পাঠকের গলা ওঠে, কবি সৌমিত্র
সেনগুপ্তের কবিতা দুর্বোধ্য। অথচ অথচ
কবিতায় বোধ্য বা দুর্বোধ্য বলে কিছু হয় না। কল্লোল ট্রায়োর অন্যতম
সেই বুদ্ধদেব বসু বললেন,
কবিতা
সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক, কবিতা আমরা ‘বুঝি নে‘, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের
কিছু বোঝায় না, স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ।
ডোন্ট থিংক, ফিল ইট। অনুভবই প্রথম স্পর্শ। তারপর কারণের খোঁজ। কবি সৌমিত্র
সেনগুপ্তের কবিতায় সেই অনুভবের স্পর্শ, উঠে আসে নাগরিক ঘ্রাণ। বস্তুবাদী নাগরিক সীমায়
চলাচল, অনুভবের দূরগম্য দ্বীপে। মননের আকাশে আধখানা নীলে ডানামেলা তাঁর। ছলাৎছলে
প্রাণভোর -
তারিফে সরিক মিতালীর মিথ
তারিখের রিখটারে ধরলাম দু-একটা
কাঁপন
বিষয় বিঘ্নিত যেটুকু জল ও জলীয়
তোতলামির অচেনা তেতলায় ঝরলো টুপটাপ [রিখটারে দু-একটা কাঁপন]
কবি বলেন, কবিতার মধ্যে কবিতা থেকে
বেরিয়ে আসা জরুরি। সেখানে একটু স্বচ্ছন্দ ভ্রমণ, ঘুরে বেড়ানো। তারপর আবার
কবিতায় ফেরা। এখানে পাঠক নির্জন হতে চায়। পঙ্ক্তির নির্জনতায় মুখর হয়ে ওঠে তার ভ্রমণ, লয় থেকে লয়ভঙ্গে, তালে বেতালে। বোঝা আর
না-বোঝায় তির্যক অবরোহণে পা রাখে অজানায় অচেনায় অমোঘ ‘সম্মোহনে’,
আলতো ঝঙ্কারের পাশে রাখছি সেমিকোলন
ঘাসবুকের নরমে নামলো বৃষ্টিঠোঁট
গাঙছুট পদাবলীর আর্কিওসুর
পর্দা সরিয়ে বাজছে দোতারা
দোতলার ব্যালকনিতে সবেমাত্র তুমি [ সম্মোহন ]
আপন কবিতায় কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত সতত চলমান। পুরনো নয়, নতুন কবিতার
স্থা-বিরোধী মেজাজে ডানা মেলেছেন গভীর আনন্দে। আবেগে আক্রান্ত ডানার
বন্দিশ শোনাননি। বরং ঘটনা, বিষয়, বস্তু থেকে দূরে গিয়ে পিছু ফিরেছেন, ফেলে আসা বিষাদ স্পর্শ
করেছেন অনুভবের রিখটারে।
যে কবির রিখটারে মেপে তোলা এইসব অনুভব তাঁর
পোষাকি পরিচয়:
প্রয়াত কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত দীর্ঘকাল বম্বেবাসী ছিলেন। এই প্রবাস যাপন তাঁর ভাষাকে দিয়েছে ডায়াস্পোরার বৈশিষ্ট্য। ২০০৪ সালে কলকাতায় ফিরে শুরু করেন তাঁর নতুন কবিতার যাত্রা। মেঘ সুলুকের ছাউনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে, কৌরব প্রকাশনী থেকে। পরবর্তীতে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - প্রাম থেকে চেনামুখ (২০০৯), মোহম দারুটি (২০১১), চাঁদ ফাদের দিন (২০১১)। ২০১৯ সালে তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ভ্রূণদের সইসাবুদ প্রকাশিত হয় নতুন কবিতা প্রকাশনী থেকে।
খুব ভাল লাগল রুণা।
উত্তরমুছুনরুণা মুন্না দার বইটির ওপর এই মূল্যবান আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ | খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনরুণা মুন্না দার বইটির ওপর এই মূল্যবান আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ | খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন