কবিতার কালিমাটি ১০৩ |
কবিতা আদি মিথের নাম
জীবন একটি কবিতা যা চিরদিন টাঙিয়ে রাখি চোখের সমুখে,
বুকের সমুখে
প্রতিদিন মন দিয়ে পড়ি, ছিঁড়ে ফেলি আবার পড়ি, আবার
টাঙিয়ে রাখি
মাঝে মাঝে তাকে একটু আধটু কেটেছেঁটে আঁটোসাটো করি,
গায়ে দিই
বেশ লাগে। শীত এলে শীত, গ্রীষ্ম এলে গ্রীষ্ম। ছয়
ঋতুর মত করে এমনভাবে সাজাই, যেন যে কেউ চাইলেই অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারে, মেখে নিতে পারে
অথবা এক ডুবেই চলে যেতে পারে বঙ্গোপসাগর, কিংবা
সাত সাগরের অপার
অবধি
ইচ্ছে করেই তাতে বাড়তি কিছু টাচ দিয়ে দিই
প্রত্যেকের মন, রুচি, চাহিদা এমনকি বয়েস বিবেচনায়
একটা নদী, একটা শালবন পাহাড়, কিছু ফুলতোলা নৌকা,
ঝিরিঝিরি লেক, ফুলবাগান, হরেকরকম পাখি, পাখির ডাক কিংবা খুব কাছে থেকে ধরতে পারা
নিকোনো আকাশ, কিছু মেঘ, হাওয়া কিংবা মৌসুমি বায়ুর শর্ত এঁকে, রেখে দিই বা বলা যায় বসিয়ে দিই
মধ্যরাতে বন্যার পানি যখন থইথই ঢুকে যায় লোকালয়ে
যখন ঘরবাড়ি, জলাভূমি ভেঙে হুড়মুড় এসে পড়ে আমার
লেখার টেবিলে
তখন উপায়ন্তর না দেখে তাদের কোলে তুলে নিই
মার্জিনে মার্জিনে
লাইনটানা শব্দের, বাক্যের স্পেস, হাইফেন, কিংবা
কোনও কোনও যতিচিহ্নের মাঝখানে নীরবে
শুইয়ে দিই
কিন্তু, পথ শিশুদের কান্না, বঞ্চিতদের আহাজারি,
বিরহী নিষাদ, পাঁজর ভেদ করা দীর্ঘশ্বাস, যখন উজিয়ে আসে ঢেউয়ে ঢেউয়ে সামাল দিতে
পারিনা
তাদের বুকে করে রাখি, চোখে করে রাখি
অনিঃশেষ বেদনা করে রাখি
আর, সবার কষ্ট, লুকানো কান্না রোপে দিতে থাকি গাঢ়
কালির প্রলেপে, কালো, নীল, হলুদ বর্ণের পমপ্লেটে, ব্রাশে
তারপর, চাঁদের আলো যেভাবে ঢুকে পড়ে প্রকৃতির কোণায়
কোণায়
তেমনি স্বর্গীয় হাওয়া, বসন্তের গান, রেশমগুটি, দুঃখের বদলে নৃত্য, পীনোন্নত রমণী, সব সব, খুব
সন্তর্পণে জুড়ে দিই ফরমেটে ফরমেটে
কখনও কখনও হারিয়ে যাওয়া প্রেমের উষ্ণ আবর্তন, স্পন্দন অবিকল রেখে দিই ছত্রে ছত্রে,
চিত্রকল্পে, উপমায় উপমায়
সেখানে নতুন প্রেম এসে বাসা বাঁধে, লালঝুঁটি
কাকাতুয়ারা আসে, ঠোঁটে ঠোঁট রাখে, ঘোরলাগা বিকেল রাখে, সন্ধ্যা রাখে, চুড়িদার
আবিরও রাখে কখনও কখনও
ব্যর্থতাগুলো তখন নীল চাঁদ, ভুবনডাঙ্গার রাজহাঁস
প্রায়শ, রাতের বেলা, পৃথিবী ঘুমিয়ে গেলে
যাপিত জীবনের ছবিগুলো খুঁটে খুঁটে দেখি
আমার পূর্বপুরুষের দিনিলিপি, জীবন নামতা,
জয়-পরাজয়, ইতিহাস, সব সব
নদী ভাঙ্গন থেকে যারা এসেছিল
যারা এসেছিল যুদ্ধ শেষে, আর যারা মন্বন্তরে
হারিয়েছিল সর্বস্ব
কিংবা যারা পালাবদলের কালে একদেশ থেকে এসেছিল আরেক
দেশে, ন্যুজবেশে
যারা সমস্তজীবন শুধু লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে, শিকার
হয়েছে বঞ্চনার
অথবা, যে জননী জন্মমাত্র তার সন্তান হারিয়ে, পথে
পথে ঘুরেছে, ঘুরছে
অথবা
যে বাবা, যে বোন কখনও সুখের মর্মার্থ বোঝেনি, বলতে
পারেনি কী তাদের প্রাপ্তি কী তাদের
অপ্রাপ্তি, সেসবই আমি
আমার কবিতায় একটু একটু করে
জায়গা দিতে চেয়েছি। পৃথিবীর ক্যানভাসে, তুলিতে একটু একটু সুখের প্রসূন, একটু একটু
সান্ত্বনা, মমতা রেখে দিতে চেয়েছি
চেয়েছি ভালবাসা ব্যাপ্তিময় হোক, হোক অনন্ত উজ্জ্বল
আমি জানি, 'ভালবাসা রহস্যের হাতিয়ার'
আমি জানি, প্রত্যেকের ডানার ভেতর লুকোনো রয়েছে অনন্তের
আহবান
ঈশ্বরের ভাষা, সৌন্দর্যের লীলা
তাই,
পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতাকে উজিয়ে, উঁচিয়ে
উটের নিশানা খুঁজে খুঁজে এক আঁজলা জলের আশায় পাড়ি
দিই দীর্ঘ দীর্ঘ পথ
প্রতিদিন খুঁজে নিই জীবন রশ্মি, ঝরনাময়
আলোর প্রপাত
আমার বুকের রক্তে গাঢ় হয়ে ওঠে সকালের সূর্য,
ঘনকালো রাত হয় দেহপোড়া কালিতে, আঁচড়ে!
সেই জীবাশ্মই আমি, যার হৃৎপিণ্ড থেকে একদিন
পৃথিবীর আদিগ্রন্থ রচিত হয়েছিল সৃষ্টি হয়েছিল মহাবিশ্বের প্রতিটি ধুলিকণা
অণু-পরমাণু
কবিতা তো সেই মিথ, সেই আদি পুরাণের নাম, যা ছিল,
যা আছে, থাকবে অনন্ত... অনন্তকাল...
মেয়োনিজ নীল
ক্লান্ত পড়ে আছে হাত
হাতের আঙুল
করপুটে নির্মেদ আকাশ
পোহায় রোদ, নিহিত নিবিড়
লাইনটানে নোটপ্যাড
লিখে যায় নিপাট সবুজ
চিন্তাসূত্র পাড়ি দেয় ক্লান্তিহীন পথ
গাঢ় অভিমান, পঙক্তির ক্যামোফ্লাজ!
চোখবুঁজে থাকে রাত
রাতের নিখিল
দেয়াল লিখে চলে জীবন অপ্রচল
পুরী থেকে আসে চিঠি, চর্যার গান
শ্রাবণকন্যা তখন রাগ বিলাবল
পূঁথিভাঁজে ইতিকথা, দেহভাঁজে মেয়োনিজ নীল, ধারাল
শূন্যতা
পঙক্তিমালা নিরুপম...
ক্যামেরা
লুক
ওই লুকটাই আসল
সারাজীবন একটা লুকের জন্যে চেয়ে থাকি, চেয়ে আছি
'জল পড়ে, পাতা নড়ে' -- এমন ন্যাচারাল লুকিং
একটা স্নানের দৃশ্য, একটা ফড়িংয়ের উড়াউড়ি
ব্রিজ, পারাপার
বেশি কিছু না
হয়ত মা অঘোর ঘোরে
হয়ত শিশুটির আর কেউ নেই
দুধও নেই বাটে
অঝোর কান্না
জীবন থেকে মুছে গেছে রং
অথবা হতে পারে নিরলে চুমু খাচ্ছে এক বৃক্ষের সাথে
অন্য আরেক বৃক্ষ
জড়াজড়ি শুয়ে আছে পায়ের উপর পা
অথবা হতে পারে সাপের মাথার উপর
বসে আছে বর্ষার ব্যাঙ, রোদ পোহাচ্ছে
এমন লুকের জন্যে চোখ, ক্যামেরা, ফ্লাশ, তাক করে
থাকি
বসে থাকি মুহূর্তের পর মুহূর্ত
কল্পনার মিথ এসে নিয়ে যায় পরাবাস্তবে
একদল মানুষ, একগুচ্ছ শিশু কিংবা একগুচ্ছ প্রাণবন্ত
লুক
প্রকৃতিকে জীবন্ত করে রাখে
ক্যামেরা রেখে দিয়েছি আকাশে
ছবি পাঠাচ্ছে
অবিরাম, অনিঃশেষ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন