সমকালীন ছোটগল্প |
গ্রিনলাইট ফ্রেন্ড
মোবাইল স্কিনে টার্চ করে ফেসবুক-এর
‘এফ’ হরফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইশিকা। ইংরেজির এফ হরফ ফেসবুকের শর্টফম।
কিন্তু ইশিকার চোখে ইদানিং ফেসবুক অ্যাপ মানেই একটি কৌতূহল, এক অদ্ভুত এক
উত্তেজনা। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে হল দূরের ঘন নীল আকাশের মধ্যে সাদা ‘এফ’ যেন ফ্রেন্ড-এর প্রতীক। চাঁদের মতো
জ্বলজ্বল করছে ঘন নীল মেঘের মধ্যে আর ঠিক নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর জল। জলে ভেসে
যাচ্ছে শুকনো পাতা। ইশিকার মোবাইল স্কিনে লাইভ ওয়ালপেপার। জীবন যে স্থির নয়, বহমান, সে বহমান জীবনের বয়ে চলার ইঙ্গিত দিয়ে
বয়ে চলেছে নদীর জল। মুহূর্তের মধ্যে ইশিকা
নেট অন করল। প্রবল উত্তেজনায় ডানপাশে তাকিয়ে দেখল গ্রিনলাইট জ্বলজ্বল করছে।
গত কয়েকদিন হল ইশিকা দিন রাতের মধ্যে
কতবার যে ফেসবুক অন করে গ্রিনলাইট দ্যাখে, তারপর প্রোফাইলে গিয়ে নতুন কিছু লেখা
পোস্ট খোঁজে। রোজ কিছু না কিছু তিনিও পোস্ট করে থাকেন। বহু পরিচিত একজন কবি বলে
কথা। কত পাঠক-পাঠিকা! ইশিকাও একজন পাঠিকা, তবে অন্যান্যদের তুলনায় সে স্বতন্ত্র।
ভাবপ্রবণ না আবেগপ্রবণ, কোনটি বেশি, সে নিজেও জানে না। তবে সরল ও চঞ্চল চোখ দুটো শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দিনের
পর দিন দেখে যায় কবির ছবি। কবির কলমে অদ্ভুত এক জাদু আছে। সেই জাদু মন্ত্রের টানে
একদিন ইশিকা বোধহয় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। কবি রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে
ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড হয়ে পাঠিকাকে যোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। অসম্মান করেননি, যেমন
সেলেব কবিরা করে থাকেন।
কিন্তু ইশিকা কী প্রথমে ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, নাকি কবি তাকে পাঠিয়েছিলেন?
কীভাবে পরিচয় হয়েছিল? পরিচয় তো ঠিক নয়, অক্ষরে অক্ষরে আলাপ হয়েছিল। মেসেঞ্জারে একদিন কথাও হয়েছিল। কিন্তু কেন কথা হয়েছিল, কিছুতেই মনে
করতে পারছে না। এই লোকটির সঙ্গে মেসেঞ্জারে
কথা হয়েছিল, কিন্তু ফেসবুকে কমেন্টের মাধ্যমে কী পরিচয় হয়েছিল? উফফ! কিছুতেই মনে করতে পারছে না। কীভাবে একটি
মানুষ এত ইম্পরট্যান্ট হয়ে গেল এই কয়েকদিনে? প্রবল উত্তেজনা ও অদম্য কৌতূহল নিয়ে
আবার প্রোফাইলে গিয়ে দেখল কবি লেখা পোস্ট করেছেন আর নিচে ঝরে পড়ছে কমেন্টের শিউলি।
রিমা এক প্রকার অস্বস্তিতে কয়েকবার মাথা চুলকে, হাতের নখ ঘষে, ঘরময় এদিক-ওদিক পায়চারি করে থম করে বসে পড়ল বিছানার এককোণে।
আজ নাকি ‘বন্ধুত্ব
দিবস’ মানে ‘Friendship Day.
নিজের মনে হাসতে হাসতে ডায়েরীতে লিখল,“কত দিবস, কত রজনী! হায়! ক্যালেন্ডার কি সংখ্যাগুলোকে তাড়িয়ে দিচ্ছে? একএকে সব নিজের গায়ে বিশেষ্যপদীয় সম্মান চাইছে, যেমন: মা দিবস, বাবা দিবস, ফুল, ফল এমনকি চকোলেট- টাকেও বাদ রাখেনি। অনেকটা যেন, যৌথ
পরিবারগুলো ভেঙে সিঙ্গেল ফ্যামিলি মতো স্বকীয়তায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে শুরু করেছে। তেমন ভাবেই ক্যালেন্ডারের দিনগুলোর বিভাজন চলছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যে। বিশেষ
শিরোনামে তাদের উদযাপন চলছে।
চকোলেট প্রসঙ্গে প্রথমেই সবার মনে যা ভেসে ওঠে, রিমাও সেই ব্যতিক্রমী গোত্রে পড়লনা। পালতোলা জাহাজে ভেসে এল ছোটবেলার কথা। বিছানায় গড়াতে গড়াতে কলমের নীলক্যাপ ঠোঁটে হালকা ছুঁয়ে কি যেন একটা
ভাবছিল, হঠাৎ
দু’দাঁতের মধ্যে ক্যাপটিকে নিয়ে একটা কামড় বসিয়ে ফিরে এল বর্তমানে।
লিখল,“অচেনা শহরে বিপদের সময় একদিন ফোন করেছিল। আশ্বাস ভরা দুটো কথাও বলেছিল।” কিন্তু কি বলেছিল? উফফ! কী বলেছিল প্রথমদিন?” কথাগুলো মনে করবার জন্যে
উল্টো হয়ে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কিন্তু মনে মাথায় যথেষ্ট পরিমাণে চাপ দিয়েও সঠিক নার্ভে চাপ পড়লনা। ব্যর্থ চেষ্টা। সিলিংএর
সাদারঙ
রিমার মনের মতই সাদাপাতা।একটি আস্ত বাক্য তো দূরের কথা, কিছুতেই অর্ধেক শব্দ মনে এল না। ওই
কথাগুলোই তো এখন রিমার একমাত্র সম্বল।
সেদিন সেই বিপদের দিনে এত টেনশনের সময়ে তার মুখে শোনা কথাগুলোর কিছুই মনে নেই। একটি লাইনও মনে নেই। মনে আছে শুধু এইটুকু, ছেলেটি ভালো। কেন ভালো আর কীভাবে ভালো হল তার ব্যাখ্যা রিমার মন চায় না। চাইলেই বা! উত্তর দেবার প্রশ্ন উঠলেই মহামুস্কিল। মনের সব প্রশ্নের উত্তর বাস্তবে থাকে না। থাকলেও অনেকসময় তা নিজেকে দিতে নেই। মনকে যত ভুলিয়ে রাখা যায় ততই ভালো। বিষয়টি হয়তো রিমাও জানে তাই তো পুরোনো কথা মনে না থাকলেও ওনার একদিনের গলার স্বর আর একটু মিষ্টি ব্যবহার মনে করেই আজ নিজের নিঃসঙ্গতায় আনন্দ পেতে চাইছে। ওইটুকুই তো সম্বল। ওদিনের পর সেই বন্ধু ফোন তো দূরের কথা, রিমার লেখা পড়েও দ্যাখে না। ইনবক্সে সেদিন যা অপমান করেছে, তারপর তো আর কোনদিন কোন কথাই হতে পারে না।
একটু গ্যাপ দিয়ে লিখল, “বিপদের সময় একটু খোঁজখবরই তো নিয়েছে, বাকিরা তো ওই টুকুও করেনি। হ্যাঁ-এর জন্যে সে আমার বন্ধু এবং তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জানা থাকলেও সে ভালো। হ্যাঁ। সে ভালো। খুব ভালো। এর বেশি আর কিছু ভাববার প্রয়োজন আছে কী? না নেই। কোন প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ। ও আমার বন্ধু, না দেখেই, না জেনেই বন্ধু। বন্ধুই তো, আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”
ভালো বন্ধুর সঙ্গে কীভাবে বন্ধুত্ব করা যায়, কিছুক্ষণ ধরে মনে মনে আবোল তাবোল ভেবে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। মোবাইলটা হাতে নিয়েই একটি মেসেজ।ব্যাস! আর বিশ্বাসের
পলেস্তারা খসে পড়ল। মেসেজের উত্তর যেমন রুক্ষ, তেমনি কর্কশ। শব্দগুলো ধ্বনিরূপে
উচ্চারিত হবার প্রয়োজন নেই। হলে হাওয়ার চোখে জল এসে পড়বে। খাতার পৃষ্ঠা বা মোবাইলের উজ্জল আলোয়, যেখানেই লেখা হোক কেন? তার সুর শব্দের শরীরে
শরীরে গাঁথা থাকে। শব্দ উচ্চারিত হবার পরেও ধ্বনিতে অনুরণন হয়। লেখারও একটা নিজস্ব বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থাকে। এখানে তো স্পষ্ট উচ্চারণ, “কেন কথা বলবে?”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন