বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




জাপানের পথে 



মলয় রায়চৌধুরীদার লেখা নিয়ে কথা বলা খুব কঠিনতবুও ওনার লেখার প্রতি যা দায়বদ্ধতা তা ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য‘দাচু ওয়াইফু’ তেমনই একটি গল্প নামকরণটিতে গল্পটির শুরুতে একটা ধাক্কা লাগবে পাঠকের মনে গল্পের শুরুতে একটা টানটান শিহরণ কিছু কিছু মানুষের কাছে একাকিত্ব একটা বিলাসিতা,  আবার কারোর কাছে ক্রাইসিস একটি মানুষ যখন একাকিত্বের জীবন উপভোগ করে তখন তার কাছে গোটা অস্তিত্বটা একটা রোমান্সেসের মত সেই গন্ডীর মধ্যে ঢুকে পড়ে আস্ত নেশার বোতল গল্পের শুরুতে একটা আগুন ধরানো   পরিবেশ ১৮ ডিগ্রি সুইঙ মোডে এসি চালিয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে গোটা শহর ডলার খরচে বেঁচে থাকার আনন্দ

এমনই একরাতে আগুনের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরে নেশার আমেজে  ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি টের পায় যখন তার চামড়ায় যন্ত্রণা শুরু হয় পর্দা জ্বলছে সোফাও। আগুন দখল করেছে ড্রইংরুম “আমার স্লিপিং স্যুটে আগুন ধরে গেছে,  চামড়ায় বসে যাচ্ছে যন্ত্রণা”এখানেই মনে হয়েছে গল্পর ক্লাইমেক্সে কোথায় যেন একটু ছেদ পড়েছেমনে হচ্ছে পরিবেশটা যেন আন্ডার কন্ট্রোলশাওয়ারের জল ধুয়ে দেয়  উলঙ্গ শরীর আগুন স্পর্শ করে  অস্তিত্বকে

এভাবেই বয়ে যাওয়া ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে চলল শব্দবন্ধ আগুন নষ্ট করে দেয় তার মুখ, দেহের ওপরের অংশ, পিঠ আর পাপোড়া জায়গাগুলো ছিল গভীর কান, নাক, কনুই থেকে  হাড় বেরিয়ে গেছেবেশ কিছু সার্জারি হলেও  বায়োমেট্রিকসে বদল হয়নিচোখ ঠিক ছিল। আঙুলের ছাপও পোড়েনি 


ফলসরূপ সার্জারিতে ঘটে যায় আমূল পরিবর্তন তার মুখেরএই ঘটনা নাড়া দেয় গল্পের এসেন্সকে গল্পটিতে জাপানের বর্ণনা আছে জাপানের অলিগলি জুড়ে  হেঁটে বেড়ায় গল্পরা গল্প মানে নারী প্রকৃতির আদি রহস্য লুকিয়ে আছে যার কোল জুড়ে গল্পর মূল চরিত্র যিনি তিনি একজন অবিবাহিত এক পুরুষএকাকিত্বের অবসরে তিনি নেহাতই একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন এমন এক  সময় তিনি তার জীবনে দ্বিতীয় শক্তির অভাব উপলব্ধি করেন কেউ একজন, যে তার নিস্তব্ধ জীবনের সঙ্গী হবে, তাকে শুশ্রূষা দেবে, যৌন ইচ্ছার তাগিদ অনুভব করবে

জাপান দ্বীপপুঞ্জে মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করে প্রাগৈতিহাসিক কালে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে জাপানের আদি জোমোন সংস্কৃতি (যার নামকরণ হয়েছে স্বতন্ত্র ‘দড়ির দাগ দেওয়া’ মাটির বাসন থেকে) ক্রমশ য়ায়োই সংস্কৃতির দ্বারা  প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। য়ায়োই যুগে মূল এশীয় ভূখণ্ড থেকে জাপানে নতুন প্রযুক্তির আগমন ঘটেছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে চীনের হান গ্রন্থে  জাপানের প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বপ্নের নগরী বলা যায় জাপানকেএদেশে রাতের রোশনাইয়ে আলোর সাথে হাত ধরে নারীজাপান শহরে বোবা কালা নারীর সংখ্যা বেশীতারা বিক্রি হন ডলারের হিসাবখাতে তেমনই এক নারী হিনাত সুন্দরীর রাজ্যের রাণী ও নৈঃশব্দের অধিপতি সে হিনাতকে দেখেই ভালোবেসে ফেললেন কোলে তুলে নিয়ে গেলেন বিছানায়
“প্রেম করছি যখন, হিনাত বলে উঠল, আঃ, লাগে
আমি উঠে বসলুমবললুম, কী বলছ তুমি? কথা বলছ?

এখানে যেন মূল চরিত্রের আরও কিছু সংলাপ কিংবা অনুভব জরুরী ছিল মনে হয়েছে কোথাও যেন তঞ্চকতার সাথে শব্দের ব্যাখ্যা চাইছিলকিন্তু তা পূরণ হয় ভালোবাসার দ্বারা।

“ভালোবাসা পেলে প্রাণ জেগে ওঠে, বলল হিনাত, চোখের পাতা কাঁপিয়ে,  ভালোবাসার ক্ষমতা তুমি জানো না
আমি হিনাতের দিকে তাকিয়ে বসে রইলুম
ও মিটিমিটি হাসছে, যেমন দেখেছিলুম জাপানে
এসি চালিয়ে হিনাতকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লুমসত্যিই, ভালোবাসার ক্ষমতা অপরিসীম, সিলিকনে তৈরি নকল যৌনপুতুল বা সেক্স ডলের মধ্যেও প্রাণ সঞ্চার করতে পারে
সুন্দরীতমা সে, কেমন করেই বা নিখুঁত হবে! খুঁত কেবল এই যে ওর হৃদয় ছিল না”

এই স্তবকে পাঠকের মনে কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগেঅর্থাৎ হৃদয়ের ঠিকানা তো নিশ্চিন্দিপুর সেখানে নেই কোন পরিসর

“দার্শনিকরা তো বলে গেছেন যে, চোখ হলো আত্মায় প্রবেশের পথওর চোখে রয়েছে সৌন্দর্যের ক্ষমতা, হাসিতে রয়েছে পুরুষকে জয় করে নেবার ক্ষমতা
হিনাতের হাত দুটো তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরতে সাহায্য করলুম, ও তাকিয়ে রইলো আমার দিকেআজ থেকে সিলিকনের যৌনপুতুল হিনাত আমার দাচু ওয়াইফু, জাপানি ভাষায় যেমন বলে, ওলন্দাজ স্ত্রী বা রহস্যময়ী পত্নী” 

গল্পের পরিণতি এখানেই কিন্তু আরও একটু বেশী পাওনা ছিল যেন আমাদের!  লেখক কখনও জাপান যাননি, কিন্তু মনে হয়েছে যেন জাপানের অলিগলি তার ঘোরা এখানেই একজন লেখকের গল্পের সার্থকতাগল্পটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য যা কিনা আরও একটু বিস্তৃতি লাভ করতেই পারত তবুও এইটুকুই বা কম কি! মলয়দার লেখা নিয়ে কিছু বলা বড় ঔদ্ধত্য, তবুও যেন আরও একটু চেয়েছিলাম 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন