লেখক জীবনের
অন্যতম স্পর্শকাতর মুহূর্তের একটি হল নতুন বই প্রকাশের পূর্ব-মুহূর্তগুলো। এই
সময়েই লেখকের চিন্তাস্তরের গভীরে সহজে প্রবেশ করা যায়। নতুন বই ‘হাতকাটা’
প্রকাশের আগে গল্পকার বিতান চক্রবর্তীর সঙ্গে খোলামেলা কথাবার্তায় প্রকাশক কিরীটী
সেনগুপ্ত।)
ছ-নম্বর বই, প্রকাশক আবারও ‘শাম্ভবী’। বিষয়টা
কতটা একঘেয়ে আর কতটাই বা স্বস্তির?
প্রতিদিন
ঘুমোতে কেমন লাগে? মানে, একঘেয়ে লাগে কি? না, লাগে না। উত্তর এটাই আসবে, তাই তো?
আসল কথাটা হল, ঘুমোলে আরাম হয়। বই প্রকাশ, প্রকাশনা এসবেও যদি আরাম না থাকে তাহলে
সেই বই নিয়ে বেশিদিন কাজ করা যায় না। শাম্ভবী তো আমার ঘর-বাড়ি, হাওয়াকলের মতোই।
নিজের ঘরের একটা আরাম আছে; একঘেয়ে লাগে না। এবার দর্শন ছেড়ে বাস্তবে আসি। পালটানোই
যায়। স্বাদ পালটানো খারাপও নয়। কিন্তু অনেক সময় স্বাদ পালটাতে গিয়ে পেট খারাপ হয়।
শাম্ভবীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যা শিখেছি, সেটার সঙ্গে অন্য কাউকে তুলনা করতে গিয়ে
দেখেছি তারা প্রায় কেউ-ই এটা করতে পারবে না। ‘এটা’ মানে বই নিয়ে পাগলামি।
মার্কেটিং নিয়েও আমার সমস্যা আছে। শাম্ভবীতে বসে নতুন মার্কেটিং আইডিয়া নিয়ে
আলোচনা করতে পারি, অন্য কোথাও সেটা পারব বলে আমার মনে হয় না। মূল বাধা আসবে
চিন্তার বিস্তারে... যদিও এখানে বলে রাখি, আমি কোনোদিন অন্য কোনো প্রকাশন সংস্থাকে
অ্যাপ্রোচও করিনি। এসব কারণ ভেবেই।
বাজার বলছে পাঠক আপনার কথা শুনতে চান, পড়তে
চান, এমনকী আপনার সমসাময়িক লেখক-কবিরাও ইচ্ছুক শ্রোতা বা পাঠক-তালিকা
থেকে বাদ পড়েননি। আপনার কাছ
থেকেই শুনতে চাই আগামী বই ‘হাতকাটা’র বিষয়।
বাইকের
মাডগার্ড দেখেছেন? দেখবেন তার ওপরটা চকচক করছে, আর নীচে কাদা শুকিয়ে আটকে থাকে। তারপর একদিন ওখানেই জং ধরে যায়। ‘হাতকাটা’ সেই
মাডগার্ডের নীচের অংশের গল্প। স্বপ্নের শহরে দুই যুবক, কনক ও শুভ এসেছে টিকে যেতে।
স্বচ্ছল জীবনের স্বাদ পেতে। কিন্তু এই বাজার কি আর স্থিতি দিতে চায়, অস্থির না হলে
মুনাফা কোথায়? এ-নিয়েই এগোয় হাতকাটা। আসলে আমি সেই গল্পই লিখতে চেয়েছি যে গল্প
প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে ঘটে চলেছে, কিন্তু আমরা নিজেদের বুঝ দিয়েছি, না এসব ভেবো
না, এসব সত্যি নয়। সব ঠিক আছে, আচ্ছে দিন এসে গেছে। তারপর একদিন হঠাৎ চোখ মেলে
দ্যাখে, যাহ, স্রোতে সব ভেসে গেছে!
বড্ড ক্রিপটিক হয়ে গেল। বিশদে জানতে চাই।
বেশ।
তাহলে শুনুন। সত্যি করে বলুন তো, তোমার দেখা এমন কতজন আছে যারা যতটা সম্ভবনাময়, জীবনে ঠিক সেই মতোই কাজ করছেন? মানে, রাষ্ট্র
তাদের কাজে লাগাতে পেরেছে? চোখ খুলে দেখুন, এই রাষ্ট্রে কত কত ‘হাত’ বেকার। যদি তাদের সত্যি কাজে লাগান যেত তাহলেই আমার দেশ কেবল শ্লোগানে নয়
বাস্তবেই ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা…’ হয়ে উঠত। এটাই ‘হাতকাটা’র মূল ভরকেন্দ্র। বাকিটা
পাঠের জন্য রাখা থাক?
ঠিক আছে, কিন্তু বিষয় নির্বাচনেও আপনি আপনার
চেনা
গণ্ডি ছাড়াতে পারছেন না। মধ্য ও নিম্নবিত্তের স্ট্রাগল, ঘাম-নুন,
অসহায়তা এইসব ঘুরে-ফিরে আসে আপনার লেখায়। কারণটা কী? পরিচিত প্লটের বাইরে না হাঁটা, লেখক হিসেবে আপনার অক্ষমতা বলে চিহ্নিত করতে পারেন সমালোচক।
অপরিচিত
প্লট-টা কী? ন-টা রস আর ছ-টা রিপুর বাইরে নতুন কিছু আমদানি হয়েছে নাকি? হয়নি তো!
তাহলে? হ্যাঁ, আমি প্রেমের গল্প বা থ্রিলার লিখছি না। কারণ, আমি প্রতিদিন চোখের সামনে
দেখছি দু-বেলা খাওয়ার জন্য মানুষকে কী অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়! তারপরেও তারা
প্রাপ্য পায় না। অসুস্থ হলে চিন্তায় থাকে, কাজটা থাকবে তো? অথচ আমরা বাকিরা এসবে
নিশ্চিন্ত। কেবল চিৎকার করছি, গরু মা না কাকিমা! রাম না রাবণ! দীপিকা না আলিয়া!
বাংলাদেশ না পাকিস্থান... তারা নিজেরাও কিন্তু নিজের-নিজের জায়গায় শোষিত অথচ সচেতন নন। মেতে থেকে
ভুলে থাকেন নিজেদের ক্ষত। চোখ বন্ধ রেখে ভালো থাকেন, ওদিকে যে ঘর-দোর সব ফাঁকা করে নিয়ে গেল চোরে,
সেদিকে খেয়াল নেই। তারপর কোনো একদিন চোখ খুলে চিৎকার করবেন, কেউ একজন এসে টোটকা খাইয়ে যাবেন, কাটমানি ফেরতের মতো। ব্যাস, খুব ভালো খুব ভালো
করে, আবার সেই অন্ধ কুয়োয়। মানে ধরো, তোমার মোবাইল হারিয়েছে তাতে শোক নেই, FIR হল
কি-না তা নিয়ে মাথা খারাপ অবস্থা। এগুলো আমাকে যে রাতে ঘুমতে দেয় না, কিরীটীদা।
আমিও তো অন্ধ হতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু কেউ কেউ জোর করে চোখে লঙ্কাবাটা দিয়ে গেল, আর
চোখ বন্ধই করতে পারি না। আর কী জানেন, আগ্রাসন এখন খুবই সূক্ষ্ম, সেখানে যদি প্রতিরোধ তীক্ষ্ণ না হয়, যুদ্ধে জয়
সম্ভব নয়।
প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘শান্তিরামের চা’ পাঠক ও
সমালোচক উভয় স্তরেই আদৃত। অথচ দ্বিতীয় গল্পের বই ‘চিহ্ন’ সমালোচক বা গবেষকের
প্রশংসা পেলেও পাঠক সেভাবে আপন করেননি। অনিবার্য তুলনার মুখে পড়তে হয়েছে গল্পকার
বিতান চক্রবর্তীকে প্রতিবার, যখনই ‘চিহ্ন’ আলোচিত হয়েছে সাহিত্যসভায়। কীভাবে দেখছেন বিষয়টাকে?
না,
মেনে নিতে সমস্যা হয়নি আমার। স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। দুটো বই আমার জীবনে দুটো
ভিন্ন স্থান দখল করে আছে। ‘শান্তিরামের চা’ যখন আমি লিখছি, প্রায় প্রতিটি গল্প নিজে
মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি যেন। আলগা আবেগ লেগেছিল গল্পগুলোতে। কেবল ‘হন্তারক’ গল্পে
আমি ছিলাম ধারে, ভেবে দেখুন, এই গল্পটি ‘শান্তিরামের চা’তে থাকলেও, সমালোচকদের প্রসংশা
পেলেও, পাঠককে ছুঁয়ে যায়নি। ‘চিহ্ন’তে এই সমস্যা আছে।
আমি ইচ্ছে করেই গল্পে ঘটনার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেছি। প্রতিটি চরিত্রে নির্লিপ্ত
থেকেছি। অতিরিক্ত আবেগ খসে গেছে। আর, এই বইতেও যে গল্পদুটো পাঠকের প্রশংসা পেয়েছে
তা হল, ‘ভাঙা জ্যোৎস্না’ এবং ‘চিহ্ন’। এই গল্পদুটোতে আমি খানিকটা হলেও মাঝখানে
দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি খুব কাছের দু-একজনকে জানতেও চেয়েছি, কেন ‘চিহ্ন’ নয়? কেন ‘শান্তিরামের চা’? তারা সঠিক কারণ বলতে পারেননি, কেবল বলেছেন বা
ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে গল্পগুলোতে অস্বস্তি হয়, আরাম নেই। এখানেই আমার জয়।
আমার বিশ্বাস, পাঠক একদিন খুঁজে পেতে পড়ে দেখবেন। নিজেদের গল্পগুলোর মাঝখানে নিয়ে
গিয়ে বসাবেন। নিজে না পৌঁছোলে সূক্ষ্ম বিন্যাস ধরা পড়বে কেমন করে? সকলের লড়াই তো
আর আমি বা অন্য কেউ লড়ে দিতে পারবে না। গল্পের এই অস্বস্তিই একদিন ভাবাবে মানুষকে।
রোমান্স অথবা মেলোড্রামার চেনা ছকের বাইরে দাঁড়িয়ে,
সমকালীন বাংলা গদ্যসাহিত্য সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।
সমকালীন
বাংলা গদ্যের আমি কেবল পাঠক এবং ছাত্র। পাঠের মজা হল, আপনি আপনার আশেপাশের চেনা জগতকে অন্যের চোখে নতুন করে
দেখতে পাবেন। মানে, যে অবস্থানে আমরা স্থিত সেই অবস্থানকে
অনেক সময় নাড়িয়ে দেয় তৃতীয় চক্ষু। এটা আমার কাছে প্রাপ্তি। সেটা কিন্তু আমার সময়ের
গদ্যকারেরা করেন। কেউ কেউ আছেন যারা কমফোর্ট জোনের বাইরে এসে দাঁড়াতে চান না।
তাদের প্রতি আমার করুণা হয়। তারা তার সময়ের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। আর এক ধারার গদ্যকার আছেন যারা নিজেদের লেখাকে
অন্যধারার লেখা বলতেই পছন্দ করেন, এবং সেই লেখা আদৃত না হলে গালি দেন পাঠক এবং
সমালোচকদের। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে অন্যধারা মানে কী? তারা কি ফর্ম নিয়েই
ব্যতিব্যস্ত? বক্তব্য নিয়ে নয়? শব্দ এবং বাক্যের চাতুরীতেই কেল্লাফতে করতে চান?
কেন? তারা তো এটা মানেন যে এ বড়ো অশান্ত সময়, রুখে দাঁড়াবার সময়, তাহলে কেন চাতুরী? এ তো আর
বিজ্ঞাপন নয়, যে চতুর ভঙ্গিতে লিখব। এ তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার সময়। ভগৎ সিং
বলেছিলেন, ‘বধিরকে শোনানোর জন্য উচ্চ কণ্ঠের প্রয়োজন হয়।’ বেহালা বা এসরাজের মিহি
সুর নয়।
সমঝদার পাঠক নাকি বন্ধু-লেখক, কে প্রিয়?
বোধ-যুক্ত পাঠক, সে যদি বন্ধুও হয় মন্দ নয়। তাহলেই
নিজের খামতি বোঝা যায়। আমি পিঠ চাপড়ানোকে অপছন্দ করি। আমার পিঠে ব্যথা লাগে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন