জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি - ২
(৪)
"...ছেড়ে দিয়েছে বলেই আমি সোনার মাছি জড়িয়ে আছি
দীর্ঘতম জীবন এবার তোমার সঙ্গে ভোগ করেছি
এই রোমাঞ্চকর যামিনী-সোনায় কোনো গ্লানি লাগেনা
খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলাম..."
টাটানগর স্টেশন থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেসে যাবো মনোহরপুর। কিরিবুরুর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পার্থ সেনকে বলেছি ওখানেই গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। চিরিয়া মাইন্সের কাছেনদীতে এখন ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, এবার সারান্ডা পেরোবো লাল মাটির পথ দিয়ে। আগে মাইন্সের মালগাড়ির গার্ডের সঙ্গে গপ্পো করতে করতে ঝিক ঝিক যেতুমসারান্ডার পার। এবার অন্য পথে।
চক্রধরপুর পেরোলেই একটু একটু করে জঙ্গল কাছে আসতে থাকে । প্রথমে ছাড়া
ছাড়া, চাবি ঘুরিয়ে তানপুরো বাঁধার সময় সুরবেসুর যেমন তার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন স্লো মোশনে সবুজ বনস্পতিরা এগিয়ে আসে লালমাটি,
ধূসর ঘাসজমি, মোরমফেলা রাস্তা, খাপরাছাওয়া কুঁড়ে, ছাগলছানাদের জটলা আর অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়ি নিয়ে পথের মোড়ে বসে থাকা শাদা শাড়িতে উজ্জ্বল কৃষ্ণা
ধরিত্রীকন্যাদের ছায়া দিতে দিতে । ওরা হাঁড়িয়ার পসারিনী। সব কথাতেই হেসে
আকুল, কিন্তু সহজাত সম্ভ্রমের কাচের দেওয়াল ভাঙেনা সচরাচর । সোনুয়া, টুনিয়া, গইলকেরা, পোসাইটা... ছবির মতো ইস্টিশন সব, লালসবুজ পথেজলরঙে আঁকা লেভেল ক্রসিং, লাইনের দুধারে সাজানো গিট্টিপাথরচুনাপাথরের বেড পেরিয়ে, সার সার কৃষ্ণচূড়ার আগুনলাগা বীথিকাদের দুলিয়ে দিয়ে, টানেলের পর টানেল আরপার, ছুটে যায় বি এন আর লাইনের ট্রেন । পোসাইটার পরেই এসে থামে আমাদের
জঙ্গল রাজধানী, মনোহরপুর ।
একটু নিচু প্ল্যাটফর্ম, লাফিয়ে নামতে হয় । চারদিকে তাকিয়ে দেখি । গার্ড ততোক্ষণে ঝান্ডা দোলাতে শুরু করে দিয়েছে । একটি রোগা লোক এগিয়ে এসে আমারবাক্স
প্যাঁটরা তুলে নেয় ।
ম্যাঞ্জর সাব গাড়ি ভেজা হ্যাঁয়...
তুম মুঝে পহচানা ক্যায়সে?
একটু দ্বিধা করে,
ম্যাঞ্জর সাব বোলা থা...
ক্যা বোলা থা ? অ্যায়সা দাড়ি হ্যাঁয়...?
এবার হেসে ফেলে,
হাঁ সর...
চলো...
স্টেশনের পাশের গেট দিয়ে বেরিয়েই একটি কালো অ্যাম্বাসাডর, এক রাশ
কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে । কয়েকটা ফুল ঝরিয়েও দিয়েছে ততোক্ষণে গাড়িরউপর ।
ক্যা নাম হ্যাঁয় তেরা...?
আইগ্যাঁ, জগমোহন...
কেত্তে সময় লাগিব ?
আইগ্যাঁ, অঢ়াই ঘন্টা...
----------------------------------
" জঙ্গল জংশন থেকে চার মাইল হবে।
কিছুটা পিচের পথ, বাকি মেঠো, বসুন্ধরা তক;
ব্রহ্মডাঙা ভেদ করে জঙ্গল করেছে,
জঙ্গল ডাঙার পর ষাট বিঘা হবে।
চারিদিক সেগুন শাল পিয়াল মেহগিনি,
শিশু ও পলাশ আছে আর আছে কাঞ্চন বকুল, আছে বাওবাব বাঁশ হেঁটোকাঁটা কুল,
মনোহরপুর স্টেশনের বাইরেই একটা তেমাথা । উত্তরের রাস্তাটা নন্দপুর হয়ে চলে গেছে পোসাইটা আর অন্য রাস্তাটা সোজা পূবদিকে একটু গিয়ে ঘুরে গেছেদক্ষিণে । কোলেবিরাহাটগামারিয়া শীর্ণ সড়ক । এই রাস্তাটা সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে কোয়না নদীটিকে । মনোহরপুরেই কোয়্না এসে মিলিয়ে গেছে কোয়েলনদীতে । এই কোয়েল দক্ষিণের কোয়েল । উত্তরে ডাল্টনগঞ্জে যে রয়েছে সে উত্তর কোয়েল । এই দুই কোয়েলের মতো মায়াময় স্রোতস্বিনী আমি তো আর দেখিনিকোথাও । খুব ক্লিশে উপমা বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নদী আর নারী । হে শব্দফতুর কবি, নদীকে দেখো, নারীকে ছোঁও, ডুব দাও নিভৃত নীলপদ্মের মতো একা ।কারো,কোয়েল, কোয়না, সুবর্ণরেখা অতো সহজে ধরা দেয়না।
সালাই পর্যন্ত গিয়ে হাটগামারিয়ার রাস্তা ছেড়ে ধরতে হলো ছোটা নাগরার ভাঙা
পথের রাঙা ধুলোর সড়ক । কোয়না চলেছে পাশে পাশে । ছোটা নাগরা পেরিয়েসোজা দখিনে উঠে গেছে পাহাড়ের পথ । কোয়নার উপর ব্রিজ পেরিয়ে বরাইবুরুর ঘাটি । এখান থেকে আবার সঙ্গী হবে কোয়নার সখি কারো ।
-------------------------------------------------
"বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে....."
এই সব খনি শহরে যাবার জায়গা খুব কম । সন্ধেবেলা টিভির সামনে আবর্জনা
অগস্ট মাস থেকে এখানে লোকে গরম জামা পরে । চলে সেইমেজুন এপ্রিলের শেষ । সেতো মাসেও বৃষ্টি হয়ে জানালা দিয়ে গেলে ঘরের ভিতর মেঘের আনাগোনা। নীল পাহাড় আর দিগন্তসবুজ ক্লোরোফিল, মাঝখান চিরে লাল হিমাটাইটের ধুলোয় রঙিন সড়ক দিয়ে সমানে ছুটে যায় টিপার, ডাম্পার, আর্থমুভার । আঁধারঝুঁঝকো হলেই কুয়াশার ভারি ডালপালা ঢেকে ফেলে চরাচর । যাবার জায়গা বলতে সেই অফিসার্স ক্লাব । কিছু তাস, কিছু টেনিস, কিছু বিলিয়ার্ড, বৃথা আড্ডা আরঅভ্যেসবশে সুরাপান । চেনা মুখ, চেনা অভ্যেস, চেনা কথা ; তবু লোকে আর যাবে কোথায়? মানুষ তো আসলে মানুষ । নাগরিক বাঙালি অনেক রয়েছেন ।মাইনিঙের লোকজনের তো কোনও অজুহাত নেই। তাঁরা নিজের পছন্দেই এই সব জায়গাতে চাকরি নিয়ে থাকেন। কিন্তু মেক্যানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল জনগণঅদৃষ্টকে গালাগালি দেন । আসলে এসব জায়গায় সরকারি চাকরির একটা অন্যরকম স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়া যায়না । মাঝেমধ্যে কলকাতা আরজামশেদপুর, শহরের শিশুদের লালায়িত মুখ ওতেই শান্ত, আপোসিত ।
পার্থ আমার অনেকদিনের বন্ধু। এখানে একা থাকে। বৌ-বাচ্চা পাটনায়। পাটনা এখান থেকে বহুদূর । তিন-চার মাসে একবার যাওয়া আর দিন গোনা। কতোদিনেপাপের মেয়াদ চুকবে। গান-বাজনার নেশা আছে ওর। দু'টো বেশ ঈর্ষণীয় মডেলের কর্গের কীবোর্ড আছে ওর বাড়ি । তবলাও বাজায়। এই গ্রামে কখনোসখনো গানাবজানার প্রোগ্রাম হলে বাজাতে যায়। নয়তো নিজে নিজেই বাদক ও শ্রোতা, বিষন্ন হিমসন্ধ্যাবেলায় সুরের পর্দায় জীবনের মানে খোঁজে। আমাকে পেয়েপুলকিত । সন্ধেবেলা কাজ শেষ করে আমাকে নিয়ে তাদের মোল্লার দৌড় কেলাবে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য একটু আড্ডাফাড্ডা মেরে পানভোজনান্তে বিছানায়দেহরক্ষা করা ।
অফিসার্স ক্লাবে সেদিন একটা প্রাক-হোলি পার্টির আয়োজন হয়েছিলো । পার্থ নিমন্ত্রিত, সঙ্গে আমিও রবাহূত। কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়, তার পর তুমুল আড্ডা।এর মধ্যে রটে যাওয়া আমি গানটান গেয়ে থাকি। পার্থের বাড়ি থেকে কীবোর্ড এসে
যায়, এক আধজন আরো সুপ্ত প্রতিভা, আর কী লাগে ? সুর ও সুরার সাধনায় রাতগড়ায় বহুদূর । কিন্তু জনতার ক্লান্তি নেই । তবু শেষ তো করতে হবেই। তাই হলো মাঝরাত পেরিয়ে । বহু মানুষ, সুস্থ, প্রমত্ত শ্রোতার দল এসে শুভেচ্ছা জানিয়েযাচ্ছেন । তাঁদের মধ্যে একজনকে নিয়ে পার্থ আসে আমার কাছে। পরিচয় করিয়ে দেয়, ইনি কুন্তল বাসু, ফিনান্সে আছেন । আমাদের নিত্য দশবার কথাবাত্তা হয়, বুঝতেই পারছো খুব কাছের মানুষ । সেই সুশীল, পুষ্ট চেহারার মানুষটি আমাকে স্বাগত জানান; প্রশ্ন করেন, আচ্ছা আপনি কি কখনও জামশেদপুরে থাকতেন?
আমি সবিনয়ে জানাই, আমি কেন, আমার তিন পুরুষের বাস ঐ গ্রামে । কেন বলুন তো?
-ঠিকই ধরেছে...
-কী?...
মানে আমার শ্বশুরবাড়ি জামশেদপুরে। আমার ওয়াইফ বললো আপনাকে চেনে..
-আরে, তাই নাকি? উনি এসেছেন কি?
-আরে এসেছে বলেই তো দেখেছে আপনাকে...
-কোথায় তিনি, দেখলে আমিও চিনতে পারবো নিশ্চয়...
-দাঁড়ান....
একটু পরেই তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এক সুন্দরী মহিলাকে । গণেশ পাইনের রানির মতো দীর্ঘগ্রীবা, আয়তলোচনা, গঙ্গামাটির রঙ ত্বক ; ভাবি, ভদ্রলোকেরস্ত্রীভাগ্য বেশ ভালো । আমি আগ বাড়িয়ে বলি, নমস্কার, শুনলুম আপনি আমাকে চেনেন...
তিনি একটু তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠেন,
(ক্রমশ)
(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন