সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

অপরাহ্ণ সুসমিতো




স্যার ও মেয়েটি


আপনি কথা বলার সময় মাঝে মাঝে নাক টানেন, ভালো লাগে। আমরা আপনার রুমে টিউটোরিয়ালের কাজে গেলে সবাইকে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন: প্রকৃতি, কী খাবেন?  
আপনি সুযোগ পেলেই আমার নামের প্রশংসা করেন। সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন প্রভাষক আপনার কাছে বেড়াতে এলে
আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন;
: অনির্বাণ, ও হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতি অরুণিমা। নামটা খুব সুন্দর না? আমাদের ডিপার্টমেন্টের খুব ব্রাইট মেয়ে। গণনাট্য সংস্থায় অভিনয় করে। গান লেখে, ছবি আঁকে। বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায়।

আরে বাবা জানি তো আমার নামটা আনকমন। বাবা এই নামটা রেখে কী যে ঝামেলায় ফেলে গেছেন
! আমার নামটা শুনলেই লোকজন আকাশ থেকে  পড়ে, কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। একবার নাটক নিয়ে কলকাতায় গেলাম নাট্য উৎসবে। একজন উদ্যোক্তা সিগারেট খেতে খেতে বললেন;
: আপনার নামটা ভারী সুন্দর
 
: ধন্যবাদ
 
: কিছু মনে করবেন না,
আপনার টাইটেলটা যেন কী?
শুনে খুব রাগ হলো। গ্রুপ থিয়েটার করা লোক,
আমার পদবী জানতে চাইছেন, বুঝতে চেষ্টা করছেন আমি হিন্দু নাকি মুসলমান!
মঞ্চের বাইরে এসে খোলা হাওয়ায় দম নিলাম জোরে জোরে। মনে মনে বাবাকে ধন্যবাদ জানালাম; বাবা তুমি একটা অসাধারণ কাজ করেছো।

স্যারের রুমে ঢুকে বললাম;
: স্যার, মোগলাই পরোটা খাব
আপনাকে প্রথমে খুব গম্ভীর লাগছিল, তারপরেও টিচার্চ ক্যাফেটরিয়া থেকে আনিয়ে  দিলেন মোগলাই। অর্ধেক খাওয়ার পর আমার নিজেরই আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। শুধুশুধু পয়সা খরচ হলো আপনার। লজ্জা লাগছিল
গটগট করে চলে আসি।

কয়েকদিন আগে মারিয়া রিলকের একটা বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন;
: প্রকৃতি, ব্রিটিশ কাউন্সিলে আবৃত্তি অনুষ্ঠানে আপনি এখান থেকে পড়বেন।

আমার ইংরেজী আবৃত্তি আপনি খুব পছন্দ করেন,
রাত জেগে জেগে রিলকে পড়ছি;
কবিতা পড়তে পড়তে কী জানি মনে হলো। আপনাকে ধুম করে ফোন করে বসলাম;
: স্যার রিলকে পড়ব না
: কেন প্রকৃতি?
: ভালো লাগছে না স্যার

: ওহ
 
আর কিছু বলেননি। বুঝতে পারি আপনি কষ্ট পেয়েছেন


পরদিন ডিপার্টমেন্টে দেখা হলো। আপনি খুব এলোমেলো ছিলেন। শুভ সকাল বললাম,
আপনি মুখ শুকনো করে হাসলেন। প্রাণ নেই।

দুপুরের খাবার বিরতিতে আপনার রুমে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই দেখি,
আপনি চোখ বন্ধ করে গুনগুন করছেন;
আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়...
আপনাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করলো না
আস্তে করে চলে আসি যাতে আপনার ধ্যান না ভাঙ্গে।

সংসারে কত কী হয়,
রোদ নামলে জোৎস্না পড়লে অলক্ষ্যে কত কী যে ঘটে, কে জানে!
থানকুনি পাতার মতো কত পাতা নিজেকে বিলিয়ে দেয়
...

রোদের বল্লমটা আর তীক্ষ্ণ লাগছে না। ফ্যাকাল্টির করিডোর ধরে হাঁটছি
ক্লান্ত লাগছে চারপাশের ক্লাসরুমকী আশ্চর্য আমিও গান শুরু করেছি একাকী নিভৃতে...
চোখের জলের লাগলো জোয়ার, দু:খের পারাবারে, ও চাঁদ...  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন