সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

অলোকপর্ণা




হাত


যে হাতটা দিয়ে বিমল বারদুয়েক কবিতা লেখার চেষ্টা করেছে, সেই হাতটা আজ দু’মাস হলো কাটা পড়েছে। তেমন কিছু নয়, তবে সেই হাত দিয়েই নিজেকে  ধরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত বিমল। মানুষ খুবই অদ্ভুত, নিজের দেহেরই ডান এবং বাম হাত, তার মধ্যেও একখানি তার অধিক প্রিয়! কেন তারা এমন? কেন এইসব শ্রেয় ও শ্রেয়তর’র দিকে তাদের এই নিস্ফল যাত্রা? ব্যান্ডেজ বাঁধা কনুই নিয়ে ‘লক্ষ্মী টি স্টলে’ বসে বসে ভাবে বিমল। যখন হাতের উপর দিয়ে  লরির চাকাটা গড়িয়ে গেল, বিমল মিনিট তিনেক কোনো ব্যথা অনুভব করেনি শুধু দেখেছিল, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তের কান্না... নীলাভ নিষ্ঠুর পিচ করা রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গরম ধাতব গন্ধময় লালরক্ত।
বিমল তাকিয়ে দেখছিল... সেদিন আর অফিস যাওয়া হয়নি।

চায়ের দোকানে বসে যদি ভাবা যায়, বিমলের মনে হয় কাটা নয়, হাতটা যেন  খসে গেছে। ছেলেবেলায় টিকটিকির লেজ যেমন হাতে লেগে থাকত আর জ্যান্ত টিকটিকি ছুটে গিয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ত! হাতটা খসে গেছে আর  বিমল যেন লুকিয়ে আছে ‘লক্ষ্মী টি স্টলে’চোখ বুজলে বিমল এখনো দেখতে  পায়, হাত থেকে টিকটিকির লেজ ঝুলছে... হাওয়ায়।

এই ব্যাপারটা নিয়ে যতই ভাবে ততই বিমলের মনে হয় হাতটা যেন কখনোই তার নিজের ছিল না, জোড়া দেওয়া ছিল কোনোরকমে, সময় আসতে খসে পড়ে গেল। ‘লক্ষ্মী টি স্টলে’ বসে হারিয়ে যাওয়া হাতের কথা ভাবে বিমল, যে হাত  দিয়ে সে ভোট দিয়েছে, ভোট দেওয়ার পর ভোটের কালি লাগানো মধ্যমা নিজেরই মুখের সামনে তুলে ধরেছে, যে হাত দিয়ে হাতল ধরে চলন্ত বাসে একছুটে উঠে এসেছে, দাদাকে চড় মেরেছে যে হাত দিয়ে, একদিন চায়ে চিনি কম হয়েছিল বলে বিমল তুলিকার গলা টিপে ধরেছিল যে হাত দিয়ে, ছোটবেলায় কল্যাণের ব্যাগ থেকে পয়সা মেরে ধরা পড়ার পরে কালো ঠান্ডা মসৃণ বোর্ডে চক ঘষে ঘষে যে হাত দিয়ে পঞ্চাশবার লিখেছে, “আমি কখনো চুরি করবো না”, সেই হাতটা আর নেই... উবে গেছে, মরে গেছে কোনো লরির চাকার তলায়।  অথবা উড়ে গেছে! হাতটার হয়তো বা ডানা হওয়ার সাধ ছিল! হাতটা আত্মহনন করেছে। বিমলকে সাথে নেয়নি।

“বিমলদা, কী করবে ভেবেছ?” টেবিল মুছতে মুছতে রতন জিজ্ঞেস করে।
বিমল উত্তর জোগাবার প্রয়োজন বোধ করে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সব কাজ সেরে চায়ের কাপগুলো ধুয়ে ফেলে রতন। জল ঝরায় কাচের কাপ থেকে। গুছিয়ে রাখতে গিয়ে একটা কাপ হঠাৎ হাত ফসকে রতনের পায়ের কাছে পড়ে চুরমার হয়ে যায়।
“ধ্যার বাঁড়া!” রতন উবু হয়ে বসে কাচের টুকরো আদর যত্ন করে কুড়োতে থাকে দুটো হাত দিয়ে।
রতনের হাতদুটো দেখতে দেখতে খসে যাওয়া স্পর্শের তল্লাশি করবে বলে বিমল উঠে দাঁড়ায়খসে যাওয়া হাতের খোঁজ নিতে বিমল ‘লক্ষ্মী টি স্টল’ ছেড়ে শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন