ছায়া ১
ম্যাসিডনরাজ! বীরের প্রতি বীরের এ
পত্র, এখান হইতে বহুদূরে
অন্তঃসলিলা নদী প্রবাহিত, সেইস্থানে গোপন পত্রপুটে সংবাদ ভাসাইয়া দিলাম।
এখানে ছায়া নহে, ঘোর দাবদাহ। খর্জুর
বৃক্ষের কণ্টকে দেহ ফুঁড়িয়া রুধির ঝরিতেছে, প্রতিরাতে রুদ্ধদ্বারে
আপন হস্তপদে দশলক্ষ শিকল পরাইতেছি, প্রতিরাতে
অনুপ্রবেশকারী হাত শিকল খুলিয়া দেখিতেছে, এ ক্ষুদ্র জনপদে
গোষ্পদ চিহ্ন, কোন গোপন বার্তালাপ বাতাসে কি এখনো
ভাসিয়া বেড়ায়! ক্ষুদ্র আমি, আপন প্রাঙ্গণের চারিপাশে কর্কশ বালুকা নির্মিত প্রাসাদ গড়ি, মরুদেশীয় ঝড় আপনার পৃষ্ঠদেশে ধারণ করি, আপন গড় আপনি রক্ষায়
প্রতিদিন নিজে শতছিন্ন হই, প্রতিদিন মারা যাই।
যে কোন মুহূর্তে প্রেতযোনি প্রাপ্ত হইবার পূর্বে, হে মহামান্য, স্মরণ করি সে গোপন সন্ধিপ্রস্তাব, আপনি বীর, পৃথিবী পরাক্রান্ত আর্য পুরুষ... সেইদিন ফল্গুতীরে, ধীরে প্রবাহিত গুঞ্জন, তখনো রাত্রি অধিক হয় নাই, কবিতা বাঁধিল সখ্য, উচ্চ ও নীচে... শিরস্ত্রাণ, তরবারি রহিল দূরে... তাহারা কি কিছুই জানিল না! এ গোপন সন্ধিকালে আমি, রাজা পুরু, সংশয়াকুল; গ্রীক রাজপুরুষ স্বমহিমায় ভাস্বর, গুণমুগ্ধ আমি, তবে বশ্য নই, কী তার কারণ! তবে কি গ্রীকপতি নীরবে একাকী ভ্রমণ
করেন লক্ষ যোজন পথ, ঘোর শূন্যতায় কণ্ঠরুদ্ধ হইয়া আসিলে, জনপদে আলোকবিন্দু খুঁজিয়া বেড়ান, "ছায়া দাও, ছায়া দাও... মূক আমি, অন্ধ আমি, ভাষা দাও সুহৃদ!" আমিও মূক, অথবা বধির! এ আর্তরব সুহৃদের মর্মবিদারক, আমি তো গুণমুগ্ধ, অতএব উষ্ণীষ নামাইয়া গ্রহণ করিয়াছি শীতার্ত করপুট... "বেশ, তবে তাই হোক"।
এ গোপন সন্ধিপত্র অলিখিত, ইহাতে প্রেম নাই, অসম্মান নাই, শ্রদ্ধা, শরীর কিছুটি নাই... সমান আসনে বসিয়া
রাজার প্রতি রাজার যে আচরণ...তাহাই নিরবিচ্ছিন্ন ছায়া...
ছায়া ২
কাট ওয়ান
কবিতায় কথা হবে, কবিতায় ভরে যাবে
অন্ধ চাঁদের দশ দিক। দেখা হবে। দেখা হবে চৌকো ক্লাসঘরে। দেখা হলে কথা হবে।
ভামিনী! মাল্যবানের সঙ্গে
দেখা করব না। আমার সঙ্কোচ হয়। আমি সামান্য লিখি, আপন খেয়ালে, দেওয়ালে আঁকজোক... ভামিনী এখানে বিছের হুল... আমার দরজার
বাইরে পরিসর নেই। এই দ্যাখ, সব বন্ধ করে বসে আছি, কী ভাবে যাব?
তারপর দানাদানা ঘাম, ঠান্ডা গাড়িতে
মুঠোভর্তি নুন... মুঠোবদ্ধ স্পর্শে উচ্চারণ নেই, দানাবাঁধা বিষণ্ণতা... কে যে কী বলে, আর কতটা না বলায়, আস্তে আস্তে কথারা সহজ হয়...। কথার মাঝখানে ভামিনী
বসে থাকে, আগাগোড়া, সারাক্ষণ, কারও... আরও যেন
কে কে
"বড় হতে হবে, বুঝলি!"
"চাইনা বড় হতে। পিছন থেকে ঠেলে তুলবি, এ কেমন বন্ধুত্ব?"
লড়াকু ঘাড় আচমকা শক্ত হয়ে ওঠে... "মাল্যবান! কবিতার কোন শর্ত হয়না।"
আঙুলের ডগায়, স্পর্শরেখা ছুঁয়ে, গণ্ডী আঁকে স্নিগ্ধ বিকেল... আমাদের কথারা ফুরিয়ে
গেছে, শুরুর আগেই। যে ঘাটে বিকেল নামে, যেখানে পুরনো স্মৃতিরা ছবি আঁকে, সেখানে পা দেবার
আগেই নদীটি শুকিয়ে যায়, ঘরবন্দীর ফেরার বাঁশীটি বেজে ওঠে।
"মাল্যবান! আমি তো সন্ধিচুক্তি গোপন রেখেছি! এ ছায়াপ্রহর, ছ'ঘন্টা কাল, কবিতারা ঘিরে ঘিরে থাক... বন্ধু থাকিস!"
"রাই! নিজেকে অতিক্রম করার
নাম কবিতা।
গণ্ডীর চারপাশে লতিয়ে ওঠা কবিতা, ঘরের দরজায় মঙ্গল চিহ্নটি কবিতা... কবিতা অটুট থাক!"
আয়ত বিষণ্ণ চোখ, গাড়িটির কাচের পিছনে...
মাল্যবান। যেখানে সীমারেখা, সেখান থেকে ফিরে এসেছি। আমরা ফিরে তাকাইনি আর। ভিন্নপথের যাবতীয়
সন্ধিচুক্তি মনে থাকে যদি আর দেখা হবে না...
ছায়া ৩
কাট টু
ম্যাসিডন রাজ! অধিক রুধির অবশিষ্ট
নাই, এপত্রের সামান্য বাকী... তদবধি চেতনা
আছন্ন না হউক, একমাত্র এই প্রার্থনা।
রাত্রির প্রথম প্রহরে শিবাভোগ, আমি অঘোরী; আপন মাংসে আপনি নখবিদ্ধ করি, আস্বাদন করি লালা পিত্ত... মরিতে দ্বিধা নাহি।
বীরের প্রতি বীরের শপথ... সে আপন চুক্তি, কষায় স্বেদজলে গোপন রাখিয়াছে, আমরা পাশা খেলিয়াছি
ফল্গুতীরে, সাক্ষী বেদমতী, লুব্ধক নক্ষত্র যে পদ্ম অর্ধ প্রস্ফুটিত, যে লবণাক্ত অমৃতে
আমাদের উচ্চারণ ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়াছিল, তাহা হইতে বেদনা
অধিক প্রকট। ঢেউ দাও, ঢেউ। আত্মহত্যার পরে
পুনরায় জন্ম লহ, সমস্ত জরা, ব্যাধি, অগণিত শোক, ইহা নিমিত্তমাত্র... যুদ্ধ নহে, প্রেম, কলহ কিছুই নহে, আমাদের সমস্ত আয়ুধ রণাঙ্গনে গচ্ছিত রাখিয়া, দুইজনে উত্তরীয়ে এই
যে বিবেক বাঁধিয়াছি, ইহাই সত্য। তথাপি মহামান্য! গৃহদ্বারে অমঙ্গল স্পর্শ, আমি শিবাচক্ষু অঘোরী... ইতিহাস তাহা গোপন রাখিয়াছে। তুমিও জানো নাই, রণক্লান্ত তুমি গর্ভের অন্ধকার খুঁজিয়া বেড়াও, মঙ্গলচিহ্ন ডাকিয়া বেড়ায়। জ্বরতপ্ত তুমি গর্ভজলের দিকে অগ্রসর হও। সেই
একমাত্র আশ্রয়। শিরস্ত্রাণে একটি চোখ জ্বলজ্বল করে, সে পূত পবিত্র
আলোকশিখা প্রতিরাতে আমার বালুকানির্মিত ঘর পোড়াইয়া দেয়। আমি পুনর্বার কপাট দিই, পুর্নবার স্মরণ করি, তুমি বীর, সখা, অতীব গুণান্বিত। আমিও সামান্য নহি; যে অঘোরী পাপ, আপন মাংসে নৈশাহার করে, তাহা হইতে দূরে তোমাকে স্থাপন করি, "পরানসখা, বন্ধু হে আমার"... হৃদয়ে ত্রিশলক্ষ বার
জপ করি, "মা, মা"...
দূরে ফল্গু প্রবাহিত, এইস্থানে ছায়া নাই, নখ দিয়া প্রাণপণ খোদিত করি বালুময় মৃত্তিকা... আমি শব, পবিত্র আসনে ছায়া প্রতিভাত হয় না। আয়ত
চক্ষে বিষণ্ণতা দেখিলে দূর হইতে কল্পনায়, তোমার গৃহদ্বারে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকি, আমি যোগী... আমার অজ্ঞাত কিছু
নহে... একই শূন্যতার দ্বারপ্রান্তে হে
মহামান্য! তুমিও এইক্ষণে জালনিবদ্ধ, অন্ধকারে ভ্রমণ করিতেছ, একা...
আমিও মৃত, একা পরিত্যক্ত... অক্ষর ভিন্ন অন্য আয়ুধ নাই। জল নাই, ছায়া নাই, সামান্য খর্জুর
বৃক্ষটি অসীম আক্রোশে আনখশির বিদ্ধ করিয়াছে। আমি ক্লান্ত... করতলপুটে যে সামান্য স্নিগ্ধ বালুকারাশি এখনো আর্দ্র, তাহাকে প্রশ্ন করি, তাহাকেই সাক্ষী মানি, ম্যাসিডোনিয়া রাজ! এক্ষণে মৃতপ্রায় পরাজিত পুরু হইতে আর কী আচরণ প্রত্যাশা করো?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন