অনন্ত পাণ্ডুলিপি
(১)
আমাদের স্মৃতিপথে
দু একটা গোরুর গাড়ি
চলে যাচ্ছে
রাত জেগে
ফিকে জ্যোৎস্না, কিছু হইচই
কিছু বিলম্বিত অপেক্ষার ঘুম
শস্যহীন মাঠে উড়ে যাচ্ছে
নিশাচর
কাজললতা চোখের পানে চেয়ে আছি
সেই চোখ আজও জাগরণ নিয়ে আসে
(২)
দূর থেকে মনে হয় আলো
তবু সভ্যতার সব আলো ম্লান
মৃত আকাঙ্ক্ষারা পড়ে আছে
তাদেরই বিমর্ষ উজ্জ্বলতা
জেগে আছে কোথাও কোথাও
নীরব সন্ধ্যার চূর্ণ চুলে
ছড়িয়ে পড়েছে অনাদর
প্রদীপ জ্বলেছে যদিও
ফাঁকা উঠোনে অবিরাম
শূন্যতা গড়িয়ে গেছে
(৩)
নক্ষত্রবেদির পরে আজও উদাসীন
ঝাপসা নিরিবিলির প্রশ্রয়ে
তোমাকেই ভেবে যাচ্ছি…
রাষ্ট্র রিরংসা যুদ্ধের দিকে
পৃথিবী চলে যাচ্ছে
আমাদের দরজার উঠোনে
আর সেই নিমগাছ নেই
হাওয়া বয়ে যাওয়া গ্রীষ্মে
এখানে একাকী এসে আর বসি না কখনও
(৪)
কালের কল্লোলে সাঁতার দিতে দিতে
ঘোর হয়ে আসছে প্রচ্ছদ
ভেতরের ক্লান্ত পৃষ্ঠাগুলি
দুঃখবীজ ছড়িয়ে দিয়েছে
অক্ষরগুলি ভাষা পায়নি আজও
যদিও উন্মুখ হয়ে আছে সংকেতে
আর সেই শালিক পাখি
প্রতীকের রং হয়ে ডেকে যেত রোজ
তার ডাকের প্রতিধ্বনি
আমাদের মরমিয়া বৈরাগ্য আড়াল করে দিত
(৫)
তোমার নতুন হলুদ পাড় শাড়ি
মন নিয়ে চলে যেত দূরে
আমি তবু পার্থিব শরীরে
কিছু কি আলোর সন্নিধান
থই থই গান
ছবি আঁকা পরস্পর মেঘ
আর বজ্র নামত আঁধারে
বিকেলের পর বিকেল
পিপাসায় ডুবে যাওয়া দিন
এক আধ ছটাক অপেক্ষায়
বার বার দহন ক্রিয়ায়
অভিমান পুড়ে হত ছাই
(৬)
নিরবধি রশ্মির পতনে
একটি গার্হস্থ্য মুখ নিবিড় হয়ে এলে
এই বাহু, বাহুর বন্ধন
লেপ্টে যেত কোমল শরীরে
অদৃশ্য স্বপ্নফুল পাপড়ি ছড়াত
চুম্বন আকর্ষি হত তার
তবু বেদনার ঠোঁট
সরসীর জলের ছায়ায়
ভেসে যেত আগামীর নৌকারা
যদিও স্তব্ধ ভাষা
যদিও সংগীত সব মূর্ছনার স্বরলিপি
(৭)
কার্যত একাকী একটি শতক চলে যায়
এই তাবৎ জগৎ এক বিক্রমের প্রলোভনে ভরা
হিংসা জাত-ধর্মের সন্দিহান রাত
রাতের নির্ব্যূঢ় অভিশাপ বহন করে যাওয়া ;
জীবন জানে না এসব
জীবন মানে জীবনের উষ্ণতা
জীবন মানে জীবনের গান
কাছাকাছি আসা
আরও কাছাকাছি, মৃত্যুও যথার্থ উত্তর তার
(৮)
সমাজ ধূসর ষাঁড়ের ক্রোধ
মানবিক প্রত্যয় বোঝে না
সম্পর্কের সত্যতা চেনে না
শুধু অন্ধ গহ্বর খুঁড়ে দেয়
আমরা পরাজয়
দুই পারে প্রেমের সৈনিক
চতুরতা ছিল না কোথাও
তবু হাত নিরর্থের অনিত্য পারে
চলে যায়
পর্দা নেমে আসে
সমূহ আশ্চর্য অভিনয়
নাটকের কম্পনে দীপ্ত দীপ
যবনিকা পতন হলে
দর্শকেরও সব শূন্য চেয়ার
মায়াময় হাততালির স্মৃতিরা গড়ায়
(৯)
সারারাত কদর্য উল্লাস ভেসে আসে
রক্তে ভেসে যায় মানবিক চাঁদ
আকাশে আকাশে
এ জ্যোৎস্না দেখি নাকো আমি আর
সভ্যতা নির্মাণ করে কলঙ্কের ঘর
ঘরে ঘরে ধর্ষকের বাস
ঘরে ঘরে অসহিষ্ণু খুনি অভিলাষ
সমাজ বিবর্ণ, মৃত, অন্ধ ছত্রাক
চারিদিকে চতুর ভ্রম, বিবেক নির্বাক
এখানে বসন্ত নেই, দগ্ধ সহবাস
প্রেম খুঁটে খায় ইন্দ্রিয়, বিবাহ হতাশ
পান থেকে চুন খসে, তীক্ষ্ণ বচনে
ধৈর্যের আমলকী ঝরে কাঙ্ক্ষিত বনে
ধুলোর বিষাদ খুঁজে দেখি সেই পথে
তুমি একা চলে গেছ বিজয়ীর রথে
সম্মুখে দাঁড়াইনি আমি, লিখিনি ইতিহাস
সমস্ত জীবন ব্যাপী বয়ে নিয়ে গেছি সর্বনাশ
(১০)
তুমিই বালিকা হয়ে ঢুকে গেলে জাদুর কুয়াশায়
আমি নিরর্থ হাহাকার পথিক নিরন্তর
তুমিই সুদূর হাতছানি
বিশ্বস্ত মরীচিকা অথবা মরুর সম্মোহন
আমি বিমূঢ় যাত্রী
তীর্থ খোঁজা লোক
অনন্ত সন্ধানে ছিটকে আসে রূপকথা
আমি শুধু কথারূপ আঁকি এ ঘোর তামাশা
শহর বিলক্ষণ সাজে অন্তঃসারহীন
গ্রাম উড়িয়ে দেয় পাখি
পদ্মহীন দিঘি
অলীক ভ্রমর ফিরে যায়
সেই পাঠ, পাঠশালা, গূঢ় সমাচার
সমীচীন যা ছিল না তাই আজ সন্দিগ্ধ বিলাসে
সেজে উঠছে
যদিও কিংশুক বড়ো নয় কিছু দামি
আমাকে আমার কাছে রাখি
ভেজাবেড়ালের স্তব বুঝি
নিজেই চুপচাপ থাকি।
(১১)
অথচ বৃষ্টি আসে, কত বৃষ্টি আসে
এই মাঠে আমাদের খুনসুটি বাল্যকাল পড়ে আছে
পিতৃ-পুরুষের ঘাম, সরল কথাবার্তা, উদয়াস্ত শ্রম
তারা সব অনন্ত পাণ্ডুলিপি
তারা সব মুদ্রণহীন মাটি ও নিসর্গে বিলীন
(১২)
এখনও কান্না আসে
কোন্ বেদনার ঐশ্বর্য এত বুক ভার করে রাখে?
আমি পদ্মপাতার কাছে যাই
আমি বাঁশপাতার নির্জন দুপুর চিনি
অথবা গভীর কুয়োর কাছে এসে জল চাই
শোন শোনো, আমার প্রার্থনা শোনো
এই জন্ম অনেক জন্মের প্রান্তে পুনঃ জন্মান্তর
(১৩)
পাঠশালা উঁকি দিচ্ছে
সারি সারি আমগাছ
লাল মোরামের রাস্তা
একাকী সাইকেল এসে দাঁড়ায়
এখানে খোলা জানালায়
সংরাগ পিয়াসী আলো পড়ে
আমিও উজ্জ্বল হতে থাকি
শিহরনগুলি কী সুন্দর মাছ
খেলা করে ; বিশাল সমুদ্র জুড়ে খেলার বৈভব
“তুমি” সেই সর্বনাম
আমার নিষাদ পর্বে ঘোর আনো
কেঁপে যায় হাত
তবু আমি ছাড়িনি ধনুঃশর
আজ শুধু খাতা ও কলম
পাণ্ডুলিপির বিশদ আয়োজন
শব্দ বাক্য পদে ছুটে যায় তির
যদিও বন্ধ সব জানালা
যদিও তোমার হাত কাঁপে না ইশারায়
(১৪)
আমাদের কি বার্ধক্য আছে?
আমাদেরও কি মৃত্যু হয় তবে?
কাঁদুক শতাব্দী কোলাহলে
মঞ্চে মঞ্চে মিথ্যুকেরা ছড়াক বিষাদ
আমরা ক্লান্ত হব না কোনওদিন
আবার জন্ম হবে আমাদের
আবার কুয়োর ধারে এসে
জল তুলে নেবো
সব হৃদয়ের রশি টান দেবো
কাঙাল দুপুরে চুমু খুঁজতে বেরোবো
সাইকেল এসে থেমে যাবে
তুমিও নতুন সংকেতে খুলে দেবে যুগের জানালা
হয়তো কোনও প্রিয়দর্শিনী
আমি নাম ভুলে ডাকব পদ্মপাতা
তেমনি সব শিহরন ফিরে এসে
ঘাই মারবে শরীরে শরীরে
তেমনি কোনও নির্জন দুপুরে
গোরুর গাড়িটি চলে যাবে
হয়তো রিকসায় বদল হয়ে
তোমার একটি হাত খুলে দেবে বুকের কপাট
দেখাবে পুরোনো আত্মা এখনও জীবিত
রাষ্ট্রসংঘ, সমাজ ব্যবস্থা কিছুই পারে না বদলাতে
ধর্ম শুধু ব্যবসা মাত্র
মানবিক স্পর্ধার কাছে সেও হেরে গেছে…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন