নারীপাঠ
আমার নাম নলিনী। আদালতে যেরকম করে হলফনামা শুরু
করে, সেরকম করে
এই বয়ান। যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না। আপনারা
যারা এই মুহূর্তে আমাকে শুনছেন, আমাকে মন দিয়ে শুনুন। শোনাটাই শুধু আপনাদের কাজ, ধর্ম। পিনপতন নীরব থেকেই শুনুন।
আমার নাম নলিনী না হয়ে জবাকুসুম হতে পারত, মার্গারিটা হতে
পারত, আসিয়াবিবি হতে পারত। কথা সেই একই। এটা তো
জানেন আমার জন্মের উপর আমার হাত ছিল না।
আপনাদের সবার মতোই আমার নামটা বাবা-মায়ের দেয়া। আমার ধর্মটাও। ছোটবেলা
থেকে আমাকে যা গেলানো হয়েছে, তাই আমি ধারণ করে এসেছি অলক্ষ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষায়তন আমাকে বেড়া দিয়েছে, পইপই করে সারাক্ষণ মন্ত্র শিখিয়েছে: এই হলো আমি। এই আমার
পাপ এই আমার পুণ্য।
আমি যে কাঠামোতে জন্মেছিলাম, আমার চারপাশে যে হাতগুলো আমাকে কোলেপিঠে বড় করেছে, সেইসব দৃশ্যমান
অদৃশ্যমান হাতগুলো শোভন কার্তিক ছিল না। বড় অসহায় হয়ে বলছি আমার সীমাবদ্ধতা
আমার নারীযন্ত্রে। আপনাদের সমান একটা মাথা নিয়েও আমি হেরে যাই আপনার চোখ কুঁতকুঁত মাংস মাপার দণ্ডে।
আমাকে বাঁচানোর জন্যও আপনাকে আপোষ করতে হয়। সংসারের
এক তুচ্ছ নারীর জন্যও প্রতিষ্ঠান কী মহাহুংকার হয়ে ওঠে সে তো আপনারা সবাই জানেন।
আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই যে ভারতবর্ষে প্রথম মেয়ে রাজা হয়েছিলেন
সুলতানা রিজিয়া। এহেন বিদ্যা ছিল না যে তিনি জানতেন না অথচ কী আশ্চর্য সমস্ত
পারিষদমাপ ছিল রিজিয়ার শরীর। তিনি হেরে গেলেন মসনদের লড়াইয়ে।
আমার নাম যদি খনা হতো, সেই একই ছুরি। আমার স্বামীই
আমার জিব কেটে দিতেন। লিলিথ হলে তো কথাই ছিল না, আপনারাই বলতেন
রাক্ষুসী।
প্যাড পরে আমি বোয়িং চালাতে পারি, নাসা থেকে মহাশূন্যে উড়াল দিতে পারি, নিউজিল্যান্ডের
বাগান থেকে আপেল পেড়ে এনে আস্ত হাঁ করে কচকচ খেতে পারি অথচ উপাসনালয়ে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ
হয়ে যায় অনুভূতির চাবুকে।
আমার মা-ই আমাকে কানে কানে শিখিয়েছেন; নারীর প্রকারভেদ।
পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী, হস্তিনী। ৩৫০ কোটি নারীকে যখন এ শ্রেণিবিন্যাস করা হয়
আমার হাসি পায়। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র আপনার সাথে আমার দেখা হলে ভালো হতো, বিশ্বাস
করুন।
আপনি শীতের রাতে গরম দুধের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে নারী
নিয়ে অশ্রাব্য ওয়াজ করবেন মাইকে অবদমিত পুরুষকূলের সামনে। আবার রাত পোহালেই আমাদের
নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ঢেকুর তুলবেন স্বার্থ জিকিরে।
কাল রাত থেকেই আমি এক ধাবমান ট্রেনের শব্দ শুনছি। ঝিকঝিক
ঝিকঝিক। কোন পথে ছুটছে জানি না। কোথায় তার গন্তব্য তাও জানি না। আমি সত্যি জানি
না। এই ধাবমান গতিশীল ট্রেনটা পতাকা দিয়ে থামিয়ে আমি তাতে উঠতে চাই।
মাথার দিব্যি রইল, আমি ট্রেনটায় উঠছি। কী বললেন? থামিয়ে দেবেন
যাত্রা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন