শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮

অর্ক চট্টোপাধ্যায়




জয়েস-নোরার নোংরা চিঠি : শরীরে যৌনতার প্রতিধ্বনি 



যৌনতা কীভাবে আত্মপ্রকাশ করে নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গতায়? কেমন হয় সে  যৌনতার ভাষা? সে ভাষা কি সেন্সরশিপের গন্ডীর তোয়াক্কা করে? বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইরিশ আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক জেমস জয়েসের, স্ত্রী নোরা বার্ণাকলকে লেখা কিছু প্রাঞ্জল চিঠির আলোচনায় এধরনের নানা প্রশ্ন উঠে  আসবে। কোনটা ব্যক্তিগত আর কোনটা সামাজিক? কোনটা শ্লীল আর কাহারে কয় অশ্লীল? জয়েসের সময়ে ইমেইল ছিল না। ছিল চিঠি। ছিল না ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটার। তাই অন্তরঙ্গ ছবি পোস্ট করা হয়নি তাঁর। জয়েসের এইসব বিস্ফোরক পর্নোগ্রাফিক চিঠি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও সমালোচকমহলে আক্ষরিকভাবেই বিতর্কের ঝড় তোলে। আমরা এখানে এই চিঠিগুলির সঙ্গে জয়েসের সাহিত্যকর্মকে যুক্ত না করে সেগুলোকে স্বতন্ত্র একেকটি টেক্সট হিসেবেই দেখার চেষ্টা করবো। এই চিঠির সঙ্গে জয়েসের সাহিত্যের সম্পর্ক নেই তা নয়। বিশেষত তাঁর লেখা একমাত্র নাটক 'Exiles'এর বিচিত্র প্রেম চতুষ্কোণ অবশ্যই জয়েস-নোরার সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত। আর  সেই সম্পর্কের সঙ্গোপনই তো এই চিঠিগুলির সম্পদ। আমরা সেই জায়গাটা নিয়েই আলোচনা করবো। 

জয়েসের মতো আত্মসচেতন একজন লেখক, যিনি জানতেন, তিনি জিনিয়াস এবং যাঁর কাছে লেখালিখি ছিল ঐ জিনিয়াসকে সার্বজনীনভাবে মান্যতা দেওয়ার জায়গা, তিনি এই চিঠিগুলি লেখবার সময় কি একবারও ভাবেননি এদের সম্ভাব্য পাবলিক লাইফ নিয়ে? তিনি কি জানতেন না, এই চিঠিগুলি গোপন থাকবে না? আর যদি জেনে থাকেন, তবে কি নিজের অজান্তে এক ধরনের self- performance রয়ে যায়নি এই চিঠিগুলিতে? চিঠিগুলির প্রতিলিপি যিনি তৈরী করেছিলেন সেই আলেস্টার জেন্ট্রি বলেছেন:
 Does anyone have the right to read things that were clearly meant only for two specific people...? Now that they have been exposed to the world’s gaze, albeit in a fairly limited fashion, does anybody except these two (who are dead) have any right to make objections about or exercise control over the manner in which these private documents and records of intimacy are used?

আজকের 'sexting'এর যুগে কীভাবে পড়া যায় সাম্প্রতিককালে মঞ্চে অভিনীত  এই চিঠিদের? ২০১৭র মে মাসে লন্ডনে একটি অভিনয় হয় বিখ্যাত খোলামেলা চিঠি নিয়ে যার মধ্যে ছিল জয়েসের চিঠিগুলিও। জনৈক অভিনেতা চিঠিগুলি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:  
He’s obviously massively into anal stuff and scat. To find the specificity of pleasure in that kind of non-normative practice, over a hundred years ago … I found that delightfully shocking. It shook me out of my nonsense view of these practices being new.

যদিও চিঠিগুলি পড়লে বোঝা যায় এই খোলামেলা চিঠির খেলাটা শুরু করেছিলেন নোরা, অথচ আমরা এখনো নোরার লেখা একটি চিঠিও পাইনি। তাঁর চিঠিগুলি প্রকাশ্যে আসার আগে পর্যন্ত শুধু এই সংলাপের একটা দিকেই আলোকপাত করা সম্ভব। ১৯০৯এর ডিসেম্বরে লেখা এবং ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত এই সো-কল্ড 'dirty letter'গুলি নিয়ে জ্যানিন ইউটেল লিখেছেন: "The letters have become herself; she has written herself into the multifaceted figures of the beloved: the wife, the lover, the whore." এই পর্যবেক্ষণ কাব্যিক হলেও কতটা যথার্থ তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায় কারণ চিঠিগুলিতে আমরা নোরার নোরাকে পাই না; পাই জয়েসের নোরাকে। দোসরা ডিসেম্বর, ১৯০৯এর চিঠিতে জয়েস চিঠিগুলির সংবেদী অস্তিত্বের কথা বলেন। তাদের সংবেদের মধ্যেই ধরা থাকে তাদের তথাকথিত অশ্লীল যৌনতা: "There is something obscene and lecherous in the very look of the letters. The sound of it too is like the act itself, brief, brutal, irresistible and devilish." তথাকথিত অশ্লীলের সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে এক  ভায়োলেন্সের ধারণা, তা এই লাইনদুটি থেকে বোঝা যায়। তাই "brutal, irresistible and devilish"এর মতো শব্দ পরম্পরা। এই চিঠিতে জয়েসের প্রেম-প্রতিকৃতি কামনাময় হলেও কামনাসর্বস্ব নয়। তিনি একদিকে 'spiritual love'এর কথা বলেন; আর তার সমান্তরালে বলেন যৌন আকাঙ্ক্ষার কথা: "a  wild beast-like craving for every inch of your body, for every secret and shameful part of it, for every odour and act of it." যৌনতা যে শরীর-কেন্দ্রিক এটা কোন নতুন কথা নয় কিন্তু যৌনতা কীভাবে শরীরকে একক  রূপে না দেখে খন্ড খন্ড করে দেখে, সেই অংশিকীকরণের অভিনব প্রতিরূপ মেলে এই বয়ানে। এক শরীর অন্য শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাকে আণবিকীকরণের মাধ্যমে ধারণ করতে চায়। BDSM সুলভ এই যৌন চাহিদায়  শরীরের সংবেদন, তার বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ, স্বাদ—সবই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেভাবে 'shame' শব্দটি বারবার ঘুরে ফিরে আসে তা অতি আগ্রহব্যঞ্জক। যে বর্ণনাগুলি জয়েস দিচ্ছেন তার অন্তর্গত লজ্জা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবগত কিন্তু সেসব কথা প্রকাশ করতে তিনি লজ্জিত নন: 
My love for you allows me to pray to the spirit of eternal beauty and tenderness mirrored in your eyes or to fling you down under me on that soft belly of yours and fuck you up behind, like a hog riding a sow, glorying in the open shame of your upturned dress and white girlish drawers and in the confusion of your flushed cheeks and tangled hair. It allows me to burst into tears of pity and love at some slight word, to tremble with love for you at the sounding of some chord or cadence of music or to lie heads and tails with you feeling your fingers fondling and tickling my bullocks or stuck up in me behind and your hot lips sucking off my cock while my head is wedged in between your fat thighs, my hands clutching the round cushions of your bum and my tongue licking ravenously up your rank red cunt.

চিরন্তন সৌন্দর্যের মেটাফিজিক্সের সঙ্গে এসে মেশে যৌন স্ক্যাটোলজি। "Open shame" শব্দ-বন্ধটি লক্ষণীয় এবং এক শরীরের উন্মুক্ততার লজ্জায় আরেক শরীরের গরিমা যৌন নিয়ন্ত্রণ ও দাসত্বের ইঙ্গিত নিয়ে আসে। "Confusion of your flushed cheeks and tangled hair"-- এই বিবরণে আবার লজ্জার ধারণাটি ফিরে আসে। এই লজ্জার উল্টোদিকেই থাকে 'pity' তথা করুণার দাস্তান। অন্য শরীরের যৌন শরমের প্রতিক্রিয়া হল করুণাময় ভালোবাসা যা প্রায় খ্রিষ্টধর্মের প্রেম-প্রতীতির সমতুল্য। জয়েসের এই বিবরণে শরীর এবং আত্মার এক সমান্তরাল ভারসাম্য দেখা যায়। ঐশ্বরিক সঙ্গীতের শ্রবণ-সংবেদনের পাশেই থাকে শরীরের খন্ডীকৃত কর্ষণ। আরেকটি অংশ তুলে ধরা যাক:
I have taught you almost to swoon at the hearing of my voice singing or murmuring to your soul the passion and sorrow and mystery of life and at the same time have taught you to make filthy signs to me with your lips and tongue, to provoke me by obscene touches and noises, and even to do in my presence the most shameful and filthy act of the body. You remember the day you pulled up your clothes and let me lie under you looking up at you as you did it? Then you were ashamed even to meet my eyes.  

'Soul' কিম্বা "the passion and sorrow and mystery of life" এই শব্দগুলিতে যেমন এক মেটাফিজিক্স জড়িয়ে আছে, তেমন "filthy signs"এ রয়েছে শরীরের নিবিড় টান। অংশটির শেষে যখন জয়েস নোরার হস্তমৈথুনের কথা বলেছেন সেখানে শরীরের গোপনতার উদ্ভাসনে 'ashamed' শব্দটি আবার নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। এই যৌনতাকে জয়েস বলেছেন এক "brutal madness." চিঠির শেষাংশেও প্রেম যৌনতার এই দোলাচল বজায় থেকেছে: 
The last drop of seed has hardly been squirted up your cunt before it is over and my true love for you, the love of my verses, the love of my eyes for your strange luring eyes, comes blowing over my soul like a wind of spices. My prick is still hot and stiff and quivering from the last brutal drive it has given you when a faint hymn is heard rising in tender pitiful worship of you from the dim cloisters of my heart. 

যৌন ক্রিয়ার নিরসনের পরেই ফিরে এসেছে ভালোবাসার অতীন্দ্রিয় রাহসিকতা। উৎসৃত লিঙ্গের পাশেই জয়েস বসিয়েছেন সঙ্গীতময় হৃদয়কে। আত্মিক প্রেমের পাশাপাশি কিংবা তারই ভেতরে রয়েছে শূকর-শূকরীর সঙ্গে উপমিত সঙ্গম প্রসঙ্গ। 

৩ ডিসেম্বর লেখা চিঠিতে জয়েসকে দেখা যায় আত্মসচেতন রূপে। লজ্জা এখানে নোরা থেকে জয়েসে সঞ্চারিত হতে থাকে। কিছুটা আফসোস করার মতো নিজের 'coarseness'এর সমালোচনা করেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো করে জয়েস লেখেন, তিনি কথা বলার সময় অশিষ্ট শব্দ ব্যবহার করেন না এবং অশ্লীল গল্প শুনেও হাসেন না; অথচ নোরার কথা ভাবলেই কামুক পশুতে পরিণত হন। এই ব্যতিক্রমী আচরণ কি এক ধরনের আধা-সচেতন self- performance নয়? লেখক জয়েসের যে রূপ তাঁর সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করেছে, উনি কি ইচ্ছে করেই তার এক বৈকল্পিক প্রতীস্ব নির্মাণ করতে চেয়েছেন এই চিঠিগুলিতে? এইসব প্রশ্নে অনুমানই সহায়। এরপর এই চিঠিতে যৌন স্মৃতি উদ্রেক করার পিছনে নোরার অগ্রণী ভূমিকার কথা লিখতে থাকেন জয়েস:
It was not I who first touched you long ago down at Ringsend. It was you who slid your hand down inside my trousers and pulled my shirt softly aside and touched my prick with your long tickling fingers, and gradually took it all, fat and stiff as it was, into your hand and frigged me slowly until I came off through your fingers, all the time bending over me and gazing at me out of your quiet saintlike eyes. It was your lips too which first uttered an obscene word. I remember well that night in bed in Pola. Tired of lying under a man one night you tore off your chemise violently and began to ride me up and down. Perhaps the horn I had was not big enough for you for I remember that you bent down to my face and murmured tenderly ‘Fuck up, love! fuck up, love!’ 

যৌনতার মুহূর্তেও চোখের বর্ণনায় 'saint like' শব্দ লক্ষণীয়। এই চিঠিতেই জয়েস এরপর নোরাকে জিজ্ঞাসা করেন অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে কাটানো যৌন মুহূর্ত সম্পর্কে। জয়েসের আগে আর কোন কোন পুরুষশরীর স্পর্শ করেছে নোরাকে? এরকম নানা জল্পনা-কল্পনার পর জয়েস ঘোষণা করেন: "[...] even if you told me with your own lips that half the red-headed louts of Galway had had a fuck at you before me I would still rush at you with desire." জয়েস স্বয়ং এইসব চিঠিকে 'dirty' এবং 'filthy' জাতীয় বিশেষণে বিশেষিত করেন, অথচ যৌনতার এই নোংরা ভাষা তিনি একমাত্র তাঁর প্রেমিকা নোরাকেই বলতে পারেন, এও তিনি জানান। অর্থাৎ এই সো-কল্ড নোংরা, অকপট ভাষা এখানে জয়েস-নোরার সম্পর্ককে অনন্যতা দিয়েছে। যৌনভাষা এখানে নারী-পুরুষের সম্পর্কের এক এক্সক্লুসিভ ব্রিজ। যে পুরুষ বা নারী অন্য কারুর সঙ্গে যৌনভাষা ব্যবহার করতে পারেন না, শুধু একে অপরের ক্ষেত্রে পারেন, সেই ভাষা তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভাষা হয়ে ওঠে। সেই যৌনভাষাই তাদের সম্পর্ক হয়ে যায়। 

৬ ডিসেম্বরের চিঠিতে পাওয়া যায় পোশাকের খোলামেলা বর্ণনা, যেরকম জামাকাপড়ে তিনি দেখতে চান নোরাকে: 
I would like you to wear drawers with three or four frills one over the other at the knees and up the thighs and great crimson bows in them, I mean not the schoolgirls’ drawers with a thin shabby lace border, tight round the legs and so thin that the flesh shows between them but women’s (or if you prefer the word) ladies’ drawers will a full loose bottom and wide legs, all frills and lace and ribbons, and heavy with perfume so that whenever you show them, whether in pulling up your clothes hastily to do something or in cuddling yourself up prettily to be blocked, I can see only a swelling mass of white stuff and frills and so that when I bend down over you to open them and give you a burning lustful kiss on your naughty bare bum I can smell the perfume of your drawers as well as the warm odour of your cunt and the heavy smell of your behind.  

যৌনতার সঙ্গে স্ট্রিপিং-য়ের সম্বন্ধ সহজে অনুমেয়। রোলা বার্থ যেমন বলেছিলেন, নগ্নতার থেকে বেশি উত্তেজক এই নিরাবরণ হওয়া। সংবেদ শরীরের যৌনায়নে প্রধান ভূমিকা নেয়। এই বিবরণটিতে সেই সংবেদ হল গন্ধ। আবারো জয়েস প্রশ্ন করেন তার ভাষায় নোরা শকড হচ্ছেন কিনা। নোরার শরীরের কী কী বিষয় জয়েসকে উত্তেজিত করে-- এই প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া যায়: 
The smallest things give me a great cockstand- a whorish movement of your mouth, a little brown stain on the seat of your white drawers, a sudden dirty word spluttered out by your wet lips, a sudden immodest noise made by you behind and then a bad smell slowly curling up out of your backside.

এই উত্তরে সবথেকে আগ্রহব্যঞ্জক বিষয় হল কীভাবে বাতকর্ম এবং শরীরের  বর্জ্যবস্তুও কামনার পাঠবস্তু হয়ে উঠেছে। বাতকর্ম সংবেদনময় এবং শরীরের সংবেদমাত্রেই জয়েসের কাছে যৌন সংবাদ। ৮ ডিসেম্বরের চিঠিতে তিনি পায়ুকাম নিয়ে আলোচনা করেন নোরার সঙ্গে। ওঁরা দুজনেই এই বিশেষ রতিক্রিয়ায় আগ্রহী এবং পারঙ্গম, এমন একটা ছবিই ফুটে ওঠে এই চিঠি থেকে। পায়ুকামের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবার ফিরে আসে প্রেমপাদের প্রসঙ্গ: 
You had an arse full of farts that night, darling, and I fucked them out of you, big fat fellows, long windy ones, quick little merry cracks and a lot of tiny little naughty farties ending in a long gush from your hole. It is wonderful to fuck a farting woman when every fuck drives one out of her. I think I would know Nora’s fart anywhere. I think I could pick hers out in a roomful of farting women. It is a rather girlish noise not like the wet windy fart which I imagine fat wives have. It is sudden and dry and dirty like what a bold girl would let off in fun in a school dormitory at night. I hope Nora will let off no end of her farts in my face so that I may know their smell also. 

বাতকর্মে সমৃদ্ধ এই অংশটিতে পাদ যে শুধু যৌন উত্তেজক, তাই নয়, এর মাধ্যমে যৌনতার সঙ্গে শরীরের বর্জন প্রক্রিয়ার ঘনিষ্ঠতার সংকেত মেলে। জয়েস নোরাকে আরো 'নোংরা' চিঠি লিখতে অনুরোধ করেন। ৯ ডিসেম্বরের চিঠিতে জয়েস স্ত্রীকে প্রাঞ্জল চিঠি লেখার যে দাবি জানান তার ভিতরে অশ্লীলতার নন্দনতত্ত্বেরও অভ্যাস পাওয়া যায়:
Tell me the smallest things about yourself so long as they are obscene and secret and filthy. Write nothing else. Let every sentence be full of dirty immodest words and sounds. They are all lovely to hear and to see on paper even but the dirtiest are the most beautiful. 
নোংরা নান্দনিক ভাষাই পারে এই উত্তেজনা সৃষ্টি করতে। নোরার চিঠিতে যে যৌন বর্ণনা ছিল তার নানা শব্দ কতটা উচাটন তৈরী করেছে জয়েসের শরীর ও মনে তা আমরা বুঝতে পারি এই চিঠি থেকে। শব্দ নিজেই এক যৌনতা। ভাষার শব্দেরাই সব থেকে সুন্দর-- এই ঘোষণায় অশ্লীল, নান্দনিক হয়ে ওঠে। যে শব্দ কল্পনায় যৌন চাঞ্চল্য তৈরী করতে পারে, তার অনুভুতিপ্রবণতা অনস্বীকার্য।
এই যৌনায়ন থেকেই শরীর হয়ে ওঠে যৌন। কোলাজের খন্ড-নান্দনিকতায় পায়ুপথ, স্তন এবং যৌনাঙ্গের ত্রিফলার কথা লেখেন জয়েস। শরীরের এই আংশিকতা তাকে যৌন সক্রিয়তা দেয়।   

২০শে ডিসেম্বরের চিঠির শুরুতে জয়েস কল্পনা করার চেষ্টা করেন, নোরা ঠিক কীভাবে, কী ভঙ্গীতে হস্তমৈথুন করেন। তিনি কি মৈথুন করার আগে প্রস্রাব  করেন না পরে? এইসব জল্পনার যে দিক নজর কাড়ে তা হল যৌন পার্টনারের একাকী যৌনজীবন নিয়ে আগ্রহ। হস্তমৈথুনের যৌনতা অটো-ইরোটিক। তার জন্য কোন অপর ব্যক্তির প্রয়োজন হয় না। অপরের নিঃসঙ্গ যৌনজীবন নিয়ে এই আগ্রহ যেমন সম্পর্কজারিত, তেমন তা সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের অ-সম্পর্ককেও প্রশ্রয় দিয়ে যায়। সম্পর্ক যেন অ-সম্পর্ক নিয়েও ভাবিত। যৌনতা  এইসব চিঠিতে প্রথাসম্মতভাবে আনন্দ দেয় না কারণ যৌনতা এখানে শরীরের বর্জ্য এবং বর্জন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে। ফ্রয়েডীয় অভিঘাত মাথায় রাখলে শরীরের অ্যানাটমির মধ্যে যৌনতা আর শারীরবৃত্তীয় বর্জন প্রক্রিয়ার এক সমীকরণ দেখা যায়। যৌনাঙ্গ বর্জ্য পরিত্যাগের অঙ্গও বটে আর এই নৈকট্যেই যৌনতা স্ক্যাটোলজিকাল হয়ে ওঠে। স্ক্যাটোলজি যৌনতাকে পর্নোগ্রাফিক হতে না দিয়ে উপভোগের পথরোধ করতে পারে, অথচ শারীরিক বর্জন জয়েসের টার্ন অন পয়েন্ট হয়ে উঠেছে এই চিঠিতে। স্ক্যাটোলজিও যৌন আনন্দ দিয়েছে তাঁকে:  
You say you will shit your drawers, dear, and let me fuck you then. I would like to hear you shit them, dear, first and then fuck you. Some night when we are somewhere in the dark and talking dirty and you feel your shite ready to fall put your arms around my neck in shame and shit it down softly. The sound will madden me and when I pull up your dress

শরীরের সংবেদন জয়েসকে উত্তেজিত করেছে। নোরার প্রস্রাবের শব্দ শুনে যৌন  শিহরণ দেখা দিয়েছে তাঁর শরীরে। শরীরের আপাত-অযৌন আরেক রূপ দেখা গেছে এই চিঠির দ্বিতীয়াংশে যেখানে জয়েস তাঁর খিদের কথা বলেছেন এবং তালিকা দিয়েছেন পছন্দের খাবারের। যৌনতা থেকে খাদ্য—শরীরের আপাত-যৌন অভ্যাস থেকে আপাত-অযৌন অভ্যাস পর্যন্ত একটা গোটা পট পরিবর্তন ঘটে গেছে। 

ভালোবাসার মধ্যে যে নামকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে,  'dirty letter'গুলিতেও তার ছায়া পড়ে। প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরকে নানা নতুন নাম ডাকে। তারা নতুন নামকরণে নিজেদের নতুন পরিচয় বানিয়ে নিতে চায়। জয়েসের নোরাকে দেওয়া নামগুলো এরকম:
Nora, my faithful darling, my sweet-eyed blackguard schoolgirl, be my whore, my mistress, as much as you like (my little frigging mistress! my little fucking whore!) you are always my beautiful wild flower of the hedges, my dark-blue rain-drenched flower.

বৃষ্টিস্নাত ঘনকৃষ্ণ ফুল থেকে বেশ্যা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া এই নামগুলোয় ভালোবাসার অভ্যন্তরে নিরঙ্কুশ আধিপত্যের চেহারা ধরা পড়ে। ভালোবাসার রাজনীতিতে ক্ষমতার বিস্তার এবং শরীরের মানচিত্র জুড়ে সম্প্রসারিত প্রেমে লুটতরাজের দমনচিত্র ফুটে ওঠে।



বাংলা ভাষায় 'নোংরা' শব্দ থেকে অনুস্বার বাদ দিলে পাওয়া যায় 'নোরা'র নাম। জয়েস বাংলা জানলে ভাষার এই খেলায় নির্ঘাৎ খুব মজা পেতেন। জয়েস-নোরার নোংরা চিঠির এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা শরীর, যৌনতা, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, নৈতিকতা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ছুঁয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। আমরা দেখেছি শরীর কীভাবে যৌনায়িত হয় শব্দের নিজস্ব যৌনতায়, দেখেছি লজ্জার প্রতর্ক কীভাবে ঘুরে ফিরে আসে ‘self-censorship’এর প্রকরণ হয়ে। এইসব চিঠি কীভাবে  যৌনতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের ধারণাটিকে সংযুক্ত করে দেখেছে এবং কীভাবে  শারীরিক বর্জ্যের সঙ্গে সংলাপ চালিয়েছে যৌনতা, তাও আমরা লক্ষ্য করেছি। আমাদের সমস্ত আলোচনা শেষপর্যন্ত পাঠের উত্তেজনায় গৃহগমন করেছে। পাঠের  উত্তেজনা, বিষয়ের যৌন-অযৌন চরিত্র নির্বিশেষে, নিজেই কি এক ধরনের যৌন  উত্তেজনা নয়? জয়েস ও নোরা একে অপরকে পাঠই তো করেছেন চিঠি-শব্দের মধ্যিপথ বরাবর। দেশ তথা পৃথিবী জুড়ে চিঠি লেখা যখন প্রায় বন্ধ, তখন আমাদের শব্দ-চিঠিরা চিঠি-শব্দ হয়ে দীর্ঘজীবী হোক, এই অসহায় অভিব্যক্তি দিয়ে শেষ করছি। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন