হরীতকী ফলের মতন - ১
(১)
‘...সংগোপন
লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা - তোমার
কবিতা,
কাব্য;’
সেটা ছিলো অঘ্রাণের শেষ বেলা। সাকিন জামশেদপুর বইমেলার ধূসর
আঙিনা। তখনও বাঁধানো হাট, ঘাসের কালিন পাতা অভিরাম ঠিকানায় যায়নি আমাদের বছরকার বইয়ের
সঙ্গে রোমাঞ্চিত সাতদিন।
যেসব বন্ধুদের সঙ্গে সময়হীন আড্ডা দেবার ইচ্ছে হয়, তারা তো সারা বছর এভাবে এক জায়গায় পঞ্চায়তের বটতলা পাততে
পারে না এই কাজের শহরে। প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ-প্রসঙ্গান্তর কথার মেঘে ভিজে সাতটি
সন্ধেবেলা। প্রসঙ্গ তো নয়, সঙ্গই সেখানে
মুখ্য লিপ্সা। আমার এক বন্ধু, মুষ্টিমেয়
একজন,
যার সঙ্গে মুখোস না পরে পদ্য নিয়ে আলোচনা করা যায়, তাকে বলি বিনয় মজুমদার শেষ কবে পড়েছো? আসলে 'ফিরে এসো চাকা' অনেকদিন ছাপা ছিলো না। হঠাৎ 'শতাব্দীর সেরা ভূতের গল্প', 'বিখ্যাত' শিল্পীদের আঁকা ছবিসহ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আরব্য উপন্যাস জাতীয়
বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে থেকে রোগা, ম্লান, হলুদ পাতার বইটি মুখ দেখালো, অরুণা প্রকাশন থেকে ১৯৮৩ সালের সংস্করণ। দাম চারটাকা।
নামপাতাটি ওল্টালেই সেই বিখ্যাত নিবেদন, 'উৎসর্গ, গায়ত্রী
চক্রবর্তী'। তৎক্ষণাৎ
'উৎসর্গ, পর্ণা' লিখে তাকে খুঁজে বেড়ানো ভিড়ের মধ্যে। এই সময়ই সেই বন্ধু, কী নিলে?
'ফিরে এসো'
সে কী? এতোদিন পরে?
আরে না না , একজনকে দিতে হবে।
তখনই তাকে জিগাই, শেষ কবে পড়েছো, বিনয় মজুমদার?
এভাবে গড়িয়ে যায় তার সঙ্গে কবিতার আলাপ। কতশত ঘাসজমি, লেগুন, মোহানা পেরিয়ে
কবিতার স্রোত বয়ে যায় শব্দের ছলে। সময়ও যায়...
হঠাৎ দেখি অসিতদা এসে হন্তদন্ত, আরে শিবাজি চলো চলো-
বলি, কোথায়?
ঐ স্টেজে দেখছো না, গান গাইতে হবে...
বিপন্ন হয়ে এদিকওদিক....
দেখি পকেটে হাত দিয়ে সুদীপ দাঁড়িয়ে আছে। এইতো পাওয়া গেছে।
য়্যাই সুদীপ শোন শোন-
কী হলো? এগিয়ে আসে
সে...
অসিতদা, সুদীপ খুব
ভালো গায়। আজ ওকে দিয়ে গাওয়ান, আমি কাল
আছি...
সুদীপ হতভম্ব, মানে?
যা না বে, আর নখড়া করিস না...
অসিতদা গ্রেফ্তার করে নিয়ে যান সুদীপকে, আমি বাঁচি তখনকার মতো। একটা স্টেজ বাঁধা হয় সেখানে। সবাই
নিজের মতো করে বাংলা গান, পদ্য, কথা বলে মাইকের সামনে। পা ব্যথা হলে অনেকে জমিয়ে শোনে, মাঝে মাঝে আবার উঠে বইয়ের স্টলে ঢুকে যায়।
আজ এসেছে কি? কোথায় গেলো তাহলে?
মাঝে মাঝে কবিতা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ে সে।
একবার প্রশ্ন করেছিলো, কবিতা বোঝার কোনও সরল নিয়ম আছে কি? নাকি যে কোনও রকম নিজস্ব নিয়মে তাকে
বুঝে নিতে হয়?
আমি বলেছিলুম, কবিতা তো বোঝার জন্য নয়, ছোঁয়ার জন্য।
বোঝার জন্য বানানো 'বোঝা' মানুষ অনেক জড়ো করেছে। ঐ ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো
কবিতা। কোনও বুঝদার লোককে কখনো কবিতা পড়তে দেখেছো? হ্যাঁ, অনেক বাংলার অধ্যাপক পাবে, পার্ট টাইম নানা ব্যবসার ফাঁকে সুকুমারমতি বালক বালিকাদের
কবিতার ব্যাখ্যা লিখিয়ে দেন। পরীক্ষায় আসবে এই প্যারাটা, গ্যারান্টি...
এই সব দেখেই তো সেই বরিশালের বাঙাল অধ্যাপকটি পদ্যের
মাংসকৃমি খোঁটা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়েন, ঝরে যান...
'সংশয়ে, সন্দেহে দুলে
দুলে তুমি নিজে ঝরে গেছ, হরিতকী ফলের
মতন।'
বরিশালে তো আমার মামার বাড়ি। তুমি কোন অধ্যাপকের কথা বলছো?
সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, আমার প্রিয়তম সেই কবিতাটি শোনাবার সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায়?
৩রা মার্চ, ১৯৬২
ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিল, 'এই জন্মদিন'।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল বলে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।'...
কবিতাটি আমি বলি, সে শোনে, কয়েক মুহূর্ত হরিতকী ফলের
মতন ঝরে যায়। মনে হয় শুনি সুদূর থেকে সে বলে,
কার লেখা?
আগে বলো, তুমি কি শুধু 'বুঝতে' পেরেছো না
শব্দগুলো কোথাও ছুঁয়েছে তোমাকে?
স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে...
এই কবিতাটা বিনয় মজুমদারের, ওনার বিখ্যাত সংকলন 'ফিরে এসো চাকা'তে রয়েছে।
তুমি বইটা আমাকে এনে দেবে?
নিশ্চয় দেবো, যদি খুঁজে পাই...
(২)
‘...তবু বেদনায়
নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি’।
কয়েকদিন তেনার খোঁজ খবর নেই। ফোনের নাগালের বাইরে থাকেন
তিনি। একটা জায়গায় পাওয়া যাবে নিশ্চিত। বুধবারে একবার ট্রাই নেওয়া যাবে। পর্ণা
প্রতি বুধবার বিকেলদিকে একবার ডি এম লাইব্রেরিতে নিশ্চয় আসে, রবীন্দ্রভবন থেকে গান শিখে ফেরার পথে। স্ট্রেট মাইল রোডে
লাইব্রেরির উল্টোদিকে ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে অফিস
পালিয়ে অপেক্ষা করি। তিনি এলেন শেষ পর্যন্ত। দেখতে পাননি আমাকে। একটু অন্যমনস্ক, অহংকারী পা ফেলা, নীলকালো কামিজ, কাঁধের ব্যাগে
গানের খাতা। বাইরেই অপেক্ষা করি। বেরিয়ে এসে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকে।
নিঃশব্দে পাশে পাশে হাঁটি। দেখেছে, কিন্তু তাকাচ্ছে না। কী হলো আবার? মনে হয় কিঞ্চিৎ গুরুতর ব্যাপার!
কী ব্যাপার, সব নিমন বা নু?
হ্যাঁ, দেখছই তো, ভালো আছি...
পর তনি গড়বড় লাগত...
না কোনও গড়বড় নেই...
চলো পার্কে একটু বসি
নাহ, তাড়া আছে, আজ এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে
তা ফিরবে, আমি পৌঁছে
দেবো। এখানে এক মিনিট দাঁড়াও, আমি বাইকটা
নিয়ে আসি...
বলছি না, আজ বসবো না
কোথাও!
তুমি বসবে, আজ, এখুনি, আর কোনও কথা
হবে না।
থমকে দাঁড়ায়, এতক্ষণ পরে মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে-
কীসের জোর এতো তোমার? কীসের?
সেটা বলবার জন্যই তোমাকে যেতে বলছি...
কিছু বলে না, কিন্তু দাঁড়িয়ে যায়।
একটু পরে জুবিলি পার্কের টাটাবাবার মূর্তির নামোদিকে
দেবদারুর সারি দিয়ে ঘেরা ঘাসজাজিমে দুজনে মুখোমুখি বসে থাকি অন্তঃস্বত্ব মৌনতায়।
বলি, কিছু বলবে?
হুঁ, গত বিষ্যুদবার
তোমাকে বিষ্টুপুরে মেঘানির সামনে দেখলাম, কারুর সঙ্গে কথা বলছিলে...
এতক্ষণে স্পষ্ট হয় রহস্য। হা হা করে হেসে উঠি। তুমি কোথা
থেকে দেখলে আমাকে?
আমি আর পরমা হিন্দুস্তান বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমায় ডাকলে না কেন?
তোমাকে ডা-ক-বো? অত ব্যস্ত ছিলে তুমি, হেসে হেসে...
মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর... ও-ই কি মধুরিমা?
ঠিক বলেছো।
তবে আর কী, আজ উঠি...
আরে বসো, বসো... একটা
ছোট্টো কবিতা শুনিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।
কার কবিতা?
সেটাই তো তুমি বলবে...
বেশ...
‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝরে যায়-
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়েনা; তবে ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত, সহজতম এই
দান-শুধু অঙ্কুরের
উদ্গমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না করে শ্যামল হতে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায়
নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাওনা, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে
যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।
কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, এটা তো আমার কবিতা; তুমি বলছো কেন?
তাই তো, আমি ভাবলাম
এটা আমার কথা তোমাকে শোনাই...
এবার হেসে ওঠে নির্ঝরের মতো শব্দ করে, অনেকক্ষণ...
মনে হচ্ছে শব্দগুলি স্পর্শ করেছে তোমায়!
করেছে, খুব করেছে, জীবনানন্দের মতো, কিন্তু জীবনানন্দ নয়...
ঠিক বলেছো, রক্তাপ্লুত
ট্রাম মনে পড়ে?
হ্যাঁ, বিনয়
মজুমদার...
ফুল মার্ক্স পেলে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন