ইকোটোন
সোমঋতা বাপের বাড়ি থেকে
শ্বশুরবাড়িতে এল। ঘরদোর যে একইরকম নেই বুঝতে পারল যখন চৌবাচ্চায় বসবাসকারী
বাচ্চাটা দেওয়ালের বেয়ে বাইরে এল। এবং
যথারীতি বাচ্চাটার পেন্টুলের সঠিক স্থানে একটি বোতাম নেই। সব বাচ্চা শ্বশুরবাড়ির
জিম্মায় রেখে গিয়েছিল। অনাদরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্রগুলো তার হারিয়ে
গিয়েছে। ও শুধু হাউহাউ করে হেসেছিল। কাটা ঘুড়ির পিছনে সোমঋতা দৌড়ায় নি। ফলে ওর
বাচ্চাদের বয়স বাড়ে নি। বাজনা ধ্বনির মতো সুরেলা গীতির মতো মা কবে বেজেছিল
বাচ্চাদের আর মনে নেই। মায়ের বয়স পেপার ওয়েটের মতো ভারি।
এখানে সবার ঘুমনামবুলি অসুখ।
সোমঋতার মায়ের ছিল তার জন্য পঞ্চাশ পঞ্চাশ ভালোবাসা আর ঘৃণা। সিগারেটবাক্স দিয়ে
বানানো কুকুরটাও এই অংকটা বুঝত। যৌথ পরিবারের সবাই কাজ করছে। একা তারই কিছু করার
নেই। তার ন্যাড়া মাথার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না।
সে নিজের ঘরে ঢোকে। তার
আত্মহত্যা করা ভাইটি এখানে শুয়ে। শোবার সময়ে গায়ে যেমন সর্বক্ষণ চাদর জড়ায়
তেমনি। অন্তত গোটা দশেক সরবিলিনের শিশি ওর মাথার কাছে। এই সময়ে যাকে নিয়ে
সবচাইতে ডিসলেক্সিয়া জড়িত ঝঞ্ঝাট সেই উদাসী বাচ্চাটা হাতে পাজলবক্স নিয়ে ওকে
পাশ কাটিয়ে গেল।
সোমঋতা যে ফুল হাতে নিতে চায়
সেটা পায়রার ডানা হয়ে যায়। ছেলের জন্য অপেক্ষায় ফোন অন না করেই সে কানে ফোন
ধরে থাকে। এভাবে কতকাল অবগাহনে ছিল সাদা অ্যাপ্রনের একোরিয়ামে। তার স্বপ্নের নুড়ি
পাথর বাচ্চারা কুড়িয়ে নিয়ে যায়।
সোমঋতাকে চিনতে পারছে না ওর
পুত্রসন্তান। ও-ও তো একসময় চিনতে পারত না
ওদের। কোমরে সারাক্ষণ তোয়ালে জড়ান ছেলেটি অনাবশ্যক বড় করে রাখা দাঁড়ি
আঁচড়ায়। এই নালক বয়সে সূর্যাস্তের সঙ্গীত গাইছে ওর মাথার টাক। শুষ্ক স্থলপদ্মের
মতো চামড়া শরীরের। মাকে দেখেছিল মোবাইলনিমগ্না ধ্যানমগ্না মৃগাক্ষী। কখনো
মন্ডপের সুরাপানকরা লাউড স্পিকার কন্ঠ মায়ের। সারারাত গমগম করছে হাসিতে। মায়ের
হাসি থেকে ও সাগরের ওপারটুকু চকিতে দেখতে পায়। বেঁচে যাবে যদি বায়ুবস্তুর সংখ্যানাম
ধরে ডাকো।
কত কতদিন বাচ্চাকে লুকিয়ে
রেখেছে পরিচিত শত্রুরা। সোমঋতা এগিয়ে গেল বাচ্চাটির দিকে -- এই বুটান শোন শোন আমি
তোর মা রে! কাছে আয়!
বাচ্চাটা ছুটছে। সোমঋতা পিছন
পিছন। কত অচেনা বারান্দা আর ঘর ওরা পেরিয়ে যাচ্ছে। একসময় সোমঋতা বুটানকে ছুঁয়ে
দিল। কী এক সত্যিকথা ছেলেটাকে বলা হয় নি। আজ বলবে বলেই তো... চকিতে ছেলেটা এক
পুরুষ হয়ে মাথা নত করে দাঁড়ালো। একটা ধূসর লাল গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে
বাড়ি থেকে। খুব নিষ্ঠুর তার চলনভঙ্গি। সোমঋতা দরজায় লণ্ঠন গলায় ঝোলানো ঘোড়া
দেখতে পায়। শালজড়ানো পিঠে লেখা ফুটে উঠেছে
: আমি আর ফিরবো না। সিদ্ধার্থ হতে যাচ্ছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন