বাঁচা
ঘরের পেছনে পুরনো আসবাব, ভাঙা ছাতা, কিছু বাঁশ। সকাল থেকে সেখানে একই
দৃশ্য। বুড়িটার মাথা পেটের
মধ্যে, পা দুটো ঘাড়ের পেছনে, হাত দুটো
কাঁধ থেকে খুলে গিয়ে ঝুলছে। ছেঁড়া কাপড়। কপাল থেকে কালো কালো
চোয়ানো রক্ত।
সাপটা উঁকি মারে। চেরা জিভ বার কয়েক বাতাস
চাখে। হাওয়া, গাছ, ঘাস, ঘরবাড়ি
নিয়ে একটা অনড় ছবি। সকাল থেকে অনেকবার দেখেছে। জবা গাছের ভেজা শেকড়। আজ সকালেও বুড়ি জল দিয়েছে। গাছটার ঠিক পাশের কল
থেকে তখনো ফোঁটাফোঁটা জল ঝরে পড়ছে।
মেয়েটা তার হাতে লেগে থাকা বুড়ির চুল
ওখানে ধুয়েছে। সাপটা আরও একটু এগিয়ে
আসে। খোলা চোখটা আধবোজা। ঘোলাটে। মোটা ফ্রেমের পরিচিত
কালো চশমাটা সাপ দেখতে পেল না। সাপটা মাথা
নীচু করে। ঘাসের জঙ্গলে যেতে যেতে
দূর থেকে একবার তাকায়। তারপর মুখ
ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে যায়।
জায়গাটা আবছা। ঘাসের ডগাগুলো স্থির। ব্যাঙটা
তখনো নড়তে চড়তে পারছিল না। সাপটাকে
সে আগেও দেখেছে। হঠাৎ করে ভেজা শাড়ি
থেকে তার গায়ের ওপর জল ছিটকে পড়েছে, তবুও সে কোলের কাছটাতে বসে থাকে। নড়ে না। বাড়ির এই
কোণটাতে তার বসবাস। নির্জন ভাঙাচোরা বাড়ির
মধ্যে বুড়িটার পড়ে থাকা তার ভালই লাগত। মাঝেমাঝে
একটা লোক এসে ‘চিঠি আছে’ বলে কিছু কাগজ দিয়ে যেত। বুড়িটা দুমড়ে বসে আছে। কখনো বারান্দায় উঠে এসে সে এমনিই বসে থাকতে দেখত। বুড়ির কোলের কাছে চিঠি
আর জুতোর খাঁজে সে, ঘুমিয়ে থাকত।
একটা বেড়ালের পা ওই মাংসপিণ্ডে পড়তে
সে লাফিয়ে উঠে দূরে সরে এসে থাবা বের করে। মানুষটাকে
সে চেনে। চেনে তার লাঠির শব্দ। সামনা সামনি হলে কিছু
দূরে থমকে যেত। এখন কোনও শব্দ নেই দেখে
অবাক হয়। কিছুক্ষণ একটানা নাকি
সুরে যুদ্ধ করার পর সে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পেছনে তাকায়। না; সেই একই দৃশ্য।
মেয়েটা আসে। একটু আগে সে বোঝার চেষ্টা করেছিল, মানুষের
হাত কীভাবে ভাঙা যায়। পা দুটো ভাঁজ হয়ে কতটা মাথার পেছনে আসে। গলার ওপর কতটা চাপ দিলে
দম বন্ধ হয়ে আসে। আশি বছরের বুড়ো চামড়ার
ভাঁজে কতটা চাপ দিলে ফেটে যায়।
এখন সে দেখতে এসেছে, মারা গেলে
কি সত্যি মারা যায়? নড়ে না, ফেরে না, যেমন রাখা
ছিল তেমনি রাখা থাকে? তাকে অবাক করে দিয়ে দুটো আঙুল হঠাৎ জায়গা বদল করে। যেন হাতছানি দিচ্ছে।
সে ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করে। পেছনে তাকাবার
সাহস হয় না।
মারা গেলেও অনেক কিছু জেগে থাকে। চেপে ধরতে চায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন