শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

রঞ্জনা ব্যানার্জী




ভালো বাসা


ঢেড়স ধুয়ে কাটতে হয় নইলে ল্যাতপ্যাতে বিচ্ছিরী লাগে খেতে। ছ’মাসে কত কী শিখলো মিমি! আঁচ কমিয়ে ডুমো করে কাটা ঢেড়সগুলো ছেড়ে দেয় তেলে। গতকাল পেঁয়াজ দিয়ে কষিয়ে লইট্টা মাছ রেঁধেছিল। ওদের ফ্রিজ নেই। কাল রাতভর ঝুম বৃষ্টি পড়েছে। ভেবেছিল ঠিক থাকবে। এখন মাছটা গন্ধ ছেড়েছে। দুটো কৈ আছে এখনো  ডেকচির জলে। জিয়াল কৈ। ছয়টা এনেছিল তূর্য। অনেক দাম। চারটা খাওয়া হয়ে  গেছে। ওদের নড়াচড়ার ছলাৎ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না অনেকক্ষণ। ডেকচির ঢাকনাটা তুলে ভেতরে উঁকি দেয় ও। চাপচাপ অন্ধকার। টিমটিমে লাইটের আলোয় কিছুই দেখা যায় নাঅভিমানে বুক ভার হয়কানে ভাসে, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। ঝুল বারান্দায় ক্যাকটাস। ফ্রিজ। টিভি।  

জেঠতুতো দাদা রাজা’র বন্ধু রাসেলের পরিচিত। মাঝে মাঝেই আসতো রাসেলের সাথেএকসময় চিঠি চালাচালি। সাথে স্বপ্নগুলোও; ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। বারান্দায় ক্যাকটাস। ফ্রিজ। টিভি।    

ইন্টারপরীক্ষার সময় রাজাদা’র হাতেই ধরা খেলসে কী মার! পরীক্ষা শেষ হতেই  পাত্র ঠিক। নির্ঘুম সব রাত! একদিন বিথি এলো বাড়িতেচিরকুটটা ও-ই দিল। ‘চিন্তা ক’র না’কিন্তু বিথি! রাসেল ভাইয়ের সাথে চার বছরের সম্পর্ক। সব জানে। 

দু’দিন বাদে পাত্রপক্ষ। খাওয়া দাওয়ার পরেই ধানদুব্বা ঠেকিয়ে প্রথামত আশীর্বাদবিথি এলো পরদিন। ফ্রিজে তুলে রাখা আশীর্বাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন মা পরদিন এক কাপড়েই ও পালালোরাসেল ভাই আর বিথি বিয়েতে সাক্ষীএরপর ট্রেনে চড়ে সোজা চাটগাঁ। তুর্যের বন্ধুর বাড়িতে ছিল বেশ ক’দিন। অতঃপর এই ‘দিন আনতে পান্তা ফুরায়’ চাকরি আর ছ’মাস ধরে ছালওঠা বাড়িটার বাসিন্দা রাতে তালপাতার পাখায় গরম সরে না, তবুও স্বপ্ন বোনা থামায় না তুর্য  

কালো ধুমসো লোকটাকে বিয়ে করলে কি জীবন অন্যরকম হতো?
  
রোজ একটায় খেতে আসে তুর্য। আধঘন্টা মত থাকে। এরপর রাত ন’টার পর  ফেরেসারাটাদিন এই একলা বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারেই কাটে মিমিরকেবল রান্নাঘরের আলোটা জ্বালানো থাকে নেভালেই আরশোলার উল্লাস! অবশ্য পেছনের একচিলতে ব্যালকনিতে বিকেলের মরা রোদ থামে। খালাম্মার সাথে পরিচয় এই ব্যালকনির সূত্রেই। উল্টোদিকের দোতলার ব্যালকনিটা ওর

এক দুপুরে তূর্য চলে যেতেই এলেন ঘুরেঘুরে ওর ঘরকন্না দেখলেনএকটা টেবিল, দুটো চেয়ার। বেডরুমে খাট, সস্তা আয়নামিমির বাবা কাকাদের শাড়ির ব্যবসা দু’টো টেলিভিশন মায়েরা বাংলা নাটক দেখলে ওরা হিন্দি সিরিয়াল দেখতো জ্যাঠামশাইর ঘরেখালাম্মাকে বলা হয় না কিছুই

প্রস্তাবটা এলো হঠাৎই। ‘টিভি, ফ্রিজ তো থাকা লাগেই বাড়িতেনাকি?’ খাটে পা তুলে জমিয়ে বসেছিলেন খালাম্মা। ‘জামাইরে বলবা, প্ল্যাস্টিক কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ। মাসে তিনহাজারআসলে দশহাজারকমাইয়া বলবা নইলে সন্দেহ করব’

ওদের ফোন নম্বর, লোগো দেয়া অফিসিয়াল ফ্লাইয়ার আছে। মিল্লাত প্ল্যাস্টিক। বড়বড় কর্তাব্যক্তিরা সার্ভিস নেন। তুখোড় ইংরেজি জানা ছেলেমেয়েরা আছে এই লাইনে। মেয়েরাও? কেন নয়? মেয়েদের বুঝি শরীর নেই?  

দু’সপ্তাহ ধরে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনিআজ সকালে তুর্য অফিসে যেতেই  খালাম্মা! স্যামসং ফোনটা হাতে দিয়ে জানালেন, নির্দিষ্ট দশটা নম্বর থেকে ফোন আসবে। সবাই রিটায়ার্ড, বিশিষ্টজন। আপাতত দুপুর দুটো থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সার্ভিস ওর ছদ্মনাম ডিউড্রপঠিকঠাক ক্লায়েন্ট রাখতে পারলে মাস পেরোলেই টিভি।

লইট্টা মাছটা তাওয়াতে আরও পেঁয়াজ দিয়ে টেনে ঝুরো করেবাসি গন্ধটা গেছেপ্রথম মাসে টিভি নয় ফ্রিজই কিনবেখালাম্মা বলেছিলেন পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ভালোবাসার খিদেতে ধুঁকছেসেক্সটকের ভালো ডিমান্ড আজকাল মাঝেমাঝে আহ্‌উহ্‌, ঘন নিঃশ্বাস। চোখ টেপেন খালাম্মা ‘জামাই বাবার আদরের কথা ভাবলেই হবে’লাল হয়ে গিয়েছিল ও।  

কী সুন্দর ফোনটা! ঘড়িতে বারোটা পঁয়তাল্লিশকোনো মতে গায়ে দুই মগ জল ঢেলেই বেরিয়ে আসে। আয়নায় দেখে নিজেকে। ‘হ্যালো ডিউড্রপ বলছি। কেমন আছেন আজ?’   
ভাত তরকারি টেবিলে গোছাতে গোছাতে কথা সাজায় ‘জানো খালাম্মা একটা  চাকরির খোঁজ দিলেন। সেইলস রেপ্রেজেন্টেটিভ। বাড়ি বসেই তিনহাজার’উহু! রাতেই গুছিয়ে বলবে বরং

তুর্য আসছে না। অস্থির লাগছে কল ছেড়ে জগে জল ভরে। পেছনে ডেকচিতে খলবল করে উঠলো মাছদুটো! ঢাকা সরিয়ে উঁকি দেয় ও। অন্ধকারে ঘূর্ণির আভাসযাক জ্যান্ত আছে!

টেবিলে জগ রেখে আবার বেডরুমে ফেরে ও। ফোনটা সাইলেন্ট মোডেদুটো বাজছে প্রায়। কলিং বেল বাজলো? বিছানার চাদরের নিচে ফোনটা তড়িঘড়ি লুকায়হাতপা কাঁপছে। কী-হোলে চোখ রাখে। কেউ নেই।

রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় আবার। ইস মাছের ডেকচির ঢাকানাটা তুলতে ভুলে গেছে! নিচু হতেই ওর চোখ থমকায়। মরা কৈ দুটো ভাসছে জলের ওপরে!  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন